মহামারী: বর্ষায় খরা দেখছে নার্সারি, বৃক্ষমেলাও অনিশ্চিত

লকডাউনের বিধিনিষেধ শিথিল হলেও করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যে বৃক্ষমেলার আয়োজন এবার অনিশ্চিত; বর্ষার আগমনে প্রকৃতি সতেজ হয়ে উঠলেও চাঙ্গা হতে পারছে না নার্সারিগুলো।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2020, 04:11 AM
Updated : 2 July 2020, 04:55 AM

চালু হওয়ার পর গত প্রায় ১৫ বছর ধরে সারা দেশে জেলা-উপজেলায় নিয়মিতই বৃক্ষমেলা হয়ে আসছে। বর্ষা ঋতুতে প্রতি বছর জুনে ঢাকায় মাসব্যাপী জাতীয় বৃক্ষমেলায় চলে ফলজ-বনজ গাছের বিকিকিনি। এবার জুন পেরিয়ে গেলেও মেলার আয়োজন অনিশ্চিত।  

ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে আয়োজিত এই মেলায় বছরে এক কোটির মত চারা ও গাছ বিক্রি হয়ে হয়; যার আর্থিক মূল্য ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা।

মহামারীতে গত তিন মাসে মানুষের কাজ ও চলাচলের পরিধি সীমিত হয়ে আসায় নার্সারিতে যাচ্ছে কম মানুষই। আর তাতে কমে গেছে নানা ধরনের গাছ ও চারা বিক্রির সুযোগ। ক্রেতা পাওয়া যাবে না ধরে নিয়ে নার্সারিগুলোও নতুন করে চারা তৈরিতে যাচ্ছে না।

নার্সারি মালিকদের মনে মেলা নিয়ে অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই; জুন থেকে অগাস্ট পর্যন্ত সারাদেশে যে বৃক্ষ রোপন অভিযান চলে, সেই কর্মসূচিও এবার কার্যকর হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

বন অধিদপ্তরের সামাজিক বনায়ন উইংয়ের উপ-প্রধান বন সংরক্ষক গোবিন্দ রায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা দেখছি, নার্সারি ছাড়াও পুরো সামাজিক বনায়নের ওপর করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বড় প্রভাব পড়ছে। তবে ক্ষতির পরিমাণটা এখনই বলা যাচ্ছে না।”

ঢাকার আগারগাঁওয়ের জান্নাত নার্সারির মালিক খন্দকার শরিফুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত বছর এই সময়ে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার গাছ ও অন্যান্য চারা বিক্রি করেছেন তারা। এখন ৮-১০ হাজার টাকার বেশি বিক্রি হচ্ছে না।

“করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। ঢাকার বেশির ভাগ ক্রেতা ছাদ বাগানের জন্য গাছ কেনেন। এখন তারা সেইভাবে গাছ কিনতে আসছেন না।”

বাড়ির ছাদে ছোট একটি বাগান করেছেন রাজধানীর সেগুনবাগিচার বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিক। সেই বাগানের জন্য তিনি প্রতি বছর নার্সারি থেকে ছোট-বড়  ফুল ও ফলের গাছ কেনেন। এবারও কিছু ফলের গাছ কিনবেন বলে ভেবেছিলেন; কিন্তু তা আর হয়নি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের ভয়ে বাড়ি থেকে বের হই না। প্রয়োজনীয় বাজার সদাই যখন লাগে তখনই বের হই। ছাদের জন্য কিছু গাছপালা দরকার। কিন্তু ভালো নার্সারি আশপাশে নেই, আগারগাঁওয়ে যেতে তো সাহস পাচ্ছি না।”

গত এপ্রিলে লকডাউনের মধ্যে স্টেডিয়াম মার্কেটের পাশে বিবরণ এক নার্সারি

বছরের নভেম্বর থেকে জানুয়ারি জুড়ে থাকে ফুলের মৌসুম। শীতকালে নার্সারিতে ফুলে ফুলে ভরা থাকে নানা গাছ। তখন ফুল গাছের বিক্রি বেড়ে যায়।

জুন থেকে অগাস্টে বর্ষা থাকে। এটা ফলেরও মৌসুম। নার্সারির পরিচর্যায় থাকা ফলজ গাছে ফুল-ফল ধরা থাকে বলে এই মৌসুমেই বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি।

প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য বৃক্ষমেলায় দেশি ফুল-ফল আর ঔষধি গাছের সমাহারের মধ্যেও নানা জাতের বিদেশি গাছ থাকে।

আগে মেলায় ফলের গাছ আর ঘর সাজাতে বাহারি গাছ প্রাধান্য পেলেও ঋতুবৈচিত্র্য আর নগরীর সৌন্দর্যবর্ধনের দিকটি মাথায় রেখে ইদানিং বিভিন্ন জাতের ফুলের গাছও গুরুত্ব পাচ্ছে।

সৌখিন বাগানিদের অনেকের কাছে বৃক্ষমেলার অন্যতম আকর্ষণ হল বনসাই;  স্টলে স্টলে ক্যাকটাস ও  নানা জাতের অর্কিড সাজিয়ে রাখতেও দেখা যায় বিক্রেতাদের।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘অথৈ-জল’ নার্সারির স্বত্বাধিকারী সঞ্জিত বণিক বলেন, “এখন হচ্ছে চারা লাগানোর মৌসুম। এই সময়ে বিভিন্ন ফল গাছের চারা বিক্রি বেড়ে যায়।

“কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এবার সেই প্রস্তুতি আমাদের নেওয়া হয়নি। মানুষের তো গাছ লাগানোর আগ্রহ এখন কম। আমাদের বিক্রিও গত বছরের অর্ধেকে নেমে এসেছে।”

সারাদেশে প্রায় ২০ হাজার নার্সারি রয়েছে; যেখানে কর্মীরা ফল ও ফুলের চারা উৎপাদন করে থাকেন। কৃষকদের উৎপাদিত চারা এনেও নার্সারিতে বিক্রি করা হয়।

পাশাপাশি ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে বিভিন্ন গাছের চারা আমদানি করেন বড় নার্সারির মালিকরা।

তারা বলছেন, কোভিড-১৯ সঙ্কটে নার্সারিগুলোতে বিক্রি কমে গেছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। তাতে বহু কর্মীও বেকার হয়ে পড়েছেন। জেলা শহরের নার্সারিগুলোতে বলতে গেলে বিক্রি নেই।

মহামারীর এই দুর্দিনে তাদের জন্য সরকার থেকে তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করলেন অনেকে। তাদের দাবি, বিনামূল্য সার ও কীটনাশক দিলেও কিছুটা উপকার হবে তাদের।

নতুন করে চারা করা হয়নি, ফলে নার্সারিগুলোতে আগের মত বেশি গাছ নেই

নার্সারির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নার্সারি ম্যান সোসাইটির সভাপতি মেসবাহ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা আমাদের লোকসানের বছর। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকেই প্রতিটি নার্সারির বিক্রি তলায় নেমে এসেছে।

“যেসব চারা গাছ ছিল সেগুলো অল্পস্বল্প বিক্রি করে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সমস্যাটা হয়েছে নতুন করে চারা করা হয়নি। ফলে এখন দেখবেন নার্সারিগুলোতে আগের মত বেশি গাছ নেই। যেগুলো আছে তা তুলনামূলক বড় গাছ। এগুলোর দামও বেশি পড়বে।”

মেসবাহ বলেন, বিক্রিই যেখানে নেই, সেখানে চারা তৈরির জন্য নতুন করে বিনিয়োগ করার ঝুঁকি নিতে পারছেন না নার্সারি মালিকরা। ফলে গাছ লাগানোর মৌসুমে এর একটা প্রভাব পড়বেই।

এই সঙ্কট থেকে উত্তরণে সরকারের সহায়তা চেয়ে তিনি বলেন, “অন্যান্য কৃষকের মত নার্সারির মালিকদেরও যদি সরকার বিনামূল্যে সার-কীটনাশকের ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে আমরা চারা উৎপাদন করে রাখতে পারতাম।”

এই পরিস্থিতিতে বৃক্ষমেলা আয়োজন করা হলেও তাতে আর্থিক ক্ষতি পোষানো যাবে না বলে মনে করছেন রাঙ্গাবন নার্সারির মালিক মেসবাহ উদ্দিন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন,  মেলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে দুটি আবেদন করেছিলেন তারা। শেষের আবেদনে মেলা পিছিয়ে করার দাবি জানানো হয়েছে।

“মেলা হলে করোনাভাইরাসের মধ্যে মানুষের সমাগম হবে। আবার মেলার আয়োজন যদি করেও তখন বিকালের মধ্যে বন্ধ করে দেবে, তাতে মানুষ মেলাতে আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। তাই প্রকৃতপক্ষে নার্সারি মালিকদের কোনো উপকার হবে না।”

রাজধানীতে জাতীয় বৃক্ষ মেলার আয়োজনে সরকারি-বেসরকারি মিলে ১০০টির মত নার্সারি অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় জানিয়ে মেসবাহ বলেন, এই মেলা জেলা পর্যায়েও হয়।

“জেলা পর্যায়ের নার্সারিগুলোরও এবার মেলায় যাওয়ার মত প্রস্তুতি নেই। তাদের কাছেও নতুন চারা নেই। তাদেরও বিক্রি নেই।”

বন অধিদপ্তরের সামাজিক বনায়ন উইংয়ের উপ-প্রধান বন সংরক্ষক গোবিন্দ রায় বললেন, এবার জুন পেরিয়ে গেলেও মেলার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

“পরিস্থিতি দেখে তার মনে হচ্ছে, এবার বৃক্ষ মেলার আয়োজন হয়ত হবে না।”

পুরনো খবর