সাগরে ‘জেলেদের জাল’ মৃত্যু ডাকছে ডলফিনের

কক্সবাজারের উপকূলে একের পর এক ডলফিন, তিমিসহ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মৃত্যুর ঘটনা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পরিবেশবাদী এবং বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের জন্য।

রিয়াসাদ সানভীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2020, 03:20 PM
Updated : 26 June 2020, 03:20 PM

ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) হিসাবে, ২০০৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দুইশর মত সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মৃত্যুর রেকর্ড আছে বাংলাদেশের জলসীমায়, যার বেশিরভাগই ডলফিন। 

আর কক্সবাজারের পরিবেশবাদী সংগঠন সেইভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসাইন জানিয়েছেন, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, ইনানী এবং কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত মিলিয়ে গত দশ মাসে (গতবছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের জুন) ১৫টি মৃত ডলফিন পাওয়া গেছে।

পরিবেশ ও প্রাণী বিশেষজ্ঞরা মোটা দাগে ডলফিনের মৃত্যুর যে কারণ বলছেন, সেটি হল মাছ ধরার জাল আর জেলেদের অসচেতনতা। সাগরে জালে আটকে আঘাত পেয়েই বেশিরভাগ ডলফিন মারা যাচ্ছে বলে মৎস্যশিকারীদের সচেতন করার কথা বলছেন তারা।

অন্যদিকে তিমির মৃত্যুর কারণ নিশ্চিতে ময়নাতদন্তের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

ডলফিন-তিমির বৈচিত্র্য

সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের নদী এবং সাগরের জলসীমায় সাত প্রজাতির ডলফিন আছে। 

এগুলো হল- শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন, ইরাবতী ডলফিন, ইন্দো প্যাসিফিক হাম্পব্যাক বা গোলাপী ডলফিন, বটল নোজ ডলফিন বা বোতল নাক ডলফিন, স্পিনার বা ঘূর্ণি ডলফিন, চিত্রা বা স্পটেড ডলফিন এবং রাফটুথ ডলফিন। আছে এক প্রজাতির স্তন্যপায়ী পরপয়েস বা পাখনাহীন ডলফিন।

ডব্লিউসিএস দুইবার বাংলাদেশের নদী এবং সাগরে জরিপ করে। প্রথমবার ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল। পরে ২০১৭-১৮ সালে। পরের জরিপের ফলাফল এখনও প্রকাশিত হয়নি।

তাদের প্রথম জরিপ অনুযায়ী চট্টগ্রামের হালদা ও কর্ণফুলী নদী, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন ছিল ৩০০ এবং সারা দেশের নদীর হিসাব যোগ করলে প্রায় এক হাজারের মত। ইরাবতী ডলফিন ছিল ছয় হাজার। বোতল নাক ডলফিন ছিল ২২০০ থেকে ২,৪০০ এর মত। অন্যান্য প্রজাতির ডলফিনের হিসাব পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে ফিনলেস পরপয়েস ছিল ১,৪০০ এর মত।

বাংলাদেশে ডলফিনের অভয়ারণ্য আছে তিনটি- সুন্দরবন সংলগ্ন ঢাংমারী, চাঁদপাই, দুধমুখী এবং মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হচ্ছে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এবং নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন অঞ্চল।

ডব্লিউসিএসর তথ্য মতে, বঙ্গপোসাগরে বাংলাদেশের সীমানায় তিন জাতের তিমি দেখা যায়। এগুলো হল- ফলস কিলার হোয়েল, ব্রিডস, স্পার্ম হোয়েল। সবচেয়ে বেশি আছে ব্রিডিস হোয়েল।

মৃত্যুর খতিয়ান

সেইভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ১২ মে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের শফির বিল এলাকায় ১১ ফুট লম্বা একটি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। ২০ মে কলাতলী পয়েন্টে সাগরে একটি মৃত ডলফিনকে ভাসতে দেখেন দুইজন লাইফ গার্ড। পরদিন লাবণী পয়েন্টে টিবি বুথের কাছে আরেকটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়।

এর আগে ৪ এপ্রিল টেকনাফের শাপলাপুর সমুদ্র সৈকতে একটি ডলফিনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পরদিন ইনানী সমুদ্র সৈকতের রয়েল টিউলিপ হোটেলের বিপরীতে সাগরে একটি মৃত ডলফিন ভাসতে দেখা যায়, যেটির আঘাতের চিহ্ন এবং লেজে দড়ি বাঁধা ছিল।

তারও আগে ২২ ফেব্রুয়ারি সেন্টমার্টিন উত্তর সৈকতের কবরস্থানের পাশে সাগর থেকে ভেসে আসা একটি মৃত ডলফিনকে মাটি চাপা দেওয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি দ্বীপের জেটি ঘাটের দক্ষিণ পাশে মাটি চাপা দেওয়া হয় আরেকটি ডলফিন।

২৪ ফেব্রুয়ারি সেন্টমার্টিন পুলিশ ফাঁড়ির সামনে একটি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। পরদিন সেন্টমার্টিন সৈকতের পশ্চিম পাড়ায় মৃত আরেকটি ডলফিনকে মাটি চাপা দেন বিচ কর্মী এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মীরা।

এছাড়া সম্প্রতি টেকনাফ এবং উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় আরও কয়েকটি ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে আসে বলে সেইভ দ্য নেচার জানিয়েছে। তবে লকডাউনের কারণে সেসবের ছবি সংগ্রহ করতে পারেনি তারা।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে গত ২৩ মার্চ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী ও সুগন্ধা পয়েন্টের কাছে ডলফিনের দুটি দলকে খেলা করতে দেখেন স্থানীয়রা। দুটি দলে সেখানে মোট ২০-২৫টা ডলফিন ছিল। 

সেগুলো ইন্দো প্যাসিফিক হাম্পব্যাক বা গোলাপী ডলফিন ছিল বলে দেশের বিশেষজ্ঞরা সে সময় নিশ্চিত করেন। ওই দৃশ্য দেখে সমুদ্র উপকূলের পরিবেশ প্রতিবেশের উন্নতি ঘটেছে বলেও অনেকে আশা প্রকাশ করেন তখন।

কিন্তু এপ্রিলের শুরু থেকেই থেকেই একের পর এক ডলফিন এবং ডলফিন গোত্রীয় পরপোয়েসের মৃতদেহ উপকূলে ভেসে আসতে থাকে।

যদিও এত ডলফিনের মরদেহ ভেসে আসার খবরটি সঠিক নয় দাবি করে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী এবং প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলছেন, সামাজিক মাধ্যমে এ তথ্য ‘ছড়ানো হচ্ছে’।

“এখন পর্যন্ত দুটি ডলফিনের মরদেহ ভেসে আসার প্রমাণ আমরা পেয়েছি।”

এর আগে গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের দড়িয়ানগর প্যারাসেইলিং পয়েন্টে একটি ইন্দো প্যাসিফিক হাম্বব্যাক ডলফিনকে আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। সেটিকে বাঁচাতে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার কাছে সাহায্য চাওয়া হলেও পাওয়া যায়নি। পরে সেটি মারা গেলে বন বিভাগের লোকজন মাটিচাপা দেয়।

এদিকে মৃত তিমি ভেসে আসার সবশেষ ঘটনাটি ঘটে গত ২২ জুন। একটি ব্রিডিস তিমির মরদেহ টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ সৈকতের গোলারচর পয়েন্টে ভেসে আসে।

১৪ জুন কক্সবাজার উপকূলে আরেকটি জীবন্ত তিমি আটকা পরে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, সেটি রক্তাক্ত ছিল। পরে স্থানীয়রা সেটিকে ঠেলে সমুদ্রে নামিয়ে দেয়। এটিই সৈকতে ভেসে আসা সেই মৃত তিমি কিনা সেটি নিশ্চিত করতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা।

চলতি বছরের জানুয়ারিতেও আরেকটি তিমির মৃতদেহ সেন্টমার্টিন দ্বীপ সংলগ্ন সমুদ্রে ভাসতে দেখা গিয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

পরিবেশবাদীরা বলছেন, সমুদ্র সৈকত এবং সংলগ্ন সাগর এলাকা লকডাউনের সময় কোলাহলহীন থাকায় ডলফিন, পরপয়েসের মত প্রাণী সৈকতের কাছাকাছি বিচরণ করছে। তাদের অধিকাংশের মৃত্যু ঘটছে মাছ ধরার জালে, জেলেদের অসচেতনতার কারণে।

মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি এবং নিরাপদ প্রজননের জন্য সরকার ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাগরে মৎস্য আহরণ বন্ধ নিষিদ্ধ করলেও অনেকেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ছোট নৌকা ও ট্রলার নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে।

সেইভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসাইন বলেন, “জেলেরা ডলফিনকে অনেক সময় টার্গেট করে। কারণ ডলফিন যেখানে থাকে সেখানে মাছ থাকে। তারা সমুদ্রের সেই অঞ্চলে জাল ফেলে, তখন ডলফিনও জালে আটকা পরে। তখন তারা বের হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে পাখনায় আঘাত পায়।

“আবার অনেক সময় জেলেরা তাদের জাল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করে। অনেক সময় লগির আঘাত ডলফিনদের মাথায় লাগে। ডলফিন খুবই স্পর্শকাতর প্রাণী। আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা তাদের খুব কম। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা মারা যায়।”

তিনি বলেন, এসব ব্যাপারে জেলেদের সচেতন করতে হবে। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী ১২টি সামুদ্রিক প্রাণী দেখভালের দায়িত্ব বন বিভাগের। কিন্তু তাদের এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেই।

“তাদের দোষ দিয়েও তো লাভ নেই। তাদের অবকাঠামো কই, জনবল কই? এজন্য সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আলাদা কাঠামোর অধীনে সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষা এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ইউনিট গঠন জরুরি।”

পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপ পরিচালক শেখ নাজমুল হুদা বলেন, “নিষেধাজ্ঞার মাঝেও অনেকে কিন্তু গোপনে জাল নিয়ে মাছ ধরতে যাচ্ছেন। ডলফিনের মৃত্যুর জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে জালে আটকে পরার ঘটনাই দায়ী।”

একই ধরনের মতামত দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান।

তিনি বলেন, “প্রধানত ডলফিন মারা যায় জালে আটকে। তাই জেলেদের ব্যাপকভাবে সচেতন করা ছাড়া বিকল্প নেই। আইন অনুযায়ী সাগরের প্রটেক্টেড এরিয়াগুলো দেখভালের দায়িত্ব বন বিভাগের। কিন্তু সেগুলো দেখভালের মতো লোকবল এবং অবকাঠামো তো নেই, ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা আছে। তাই শুধু ঘোষণা করলেই হবে না, সেগুলো রক্ষায়ও উদ্যোগী হতে হবে।”

অন্যদিকে তিমির মৃত্যুর কারণ জানতে ময়না তদন্তের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরী।

তার মতে, অন্তত মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা গেলে একদিকে যেমন রেকর্ড থেকে যাবে, তেমনি ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করা সহজ হবে। 

ডব্লিউসিএসের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “যেহেতু বন বিভাগের লোকবল এবং অন্যান্য লজিস্টিকের সঙ্কট আছে তাই সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মৎস্য বিভাগ এবং কোস্টগার্ডের সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। আরও বেশি মেরিন প্রটেক্টেড অঞ্চল গড়ে তোলা প্রয়োজন, বিশেষ করে সোনাদিয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে।”

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী তিমি বা ডলফিন হত্যার দায়ে কেউ অভিযুক্ত হলে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড হতে পারে। তিমি বা ডলফিনের দেহাবশেষ সংগ্রহ করলে তার জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের সাজা অথবা এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড হতে পারে।