বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে বুনো হাতি?

বুনো হাতির মৃত্যু- বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে এ ধরনের খবরের শিরোনাম অনেকটা গা-সওয়া হয়ে গেলেও বন্যপ্রাণী গবেষক-বিশেষজ্ঞরা এসব ঘটনার মধ্যে বিশালদেহী প্রাণীটির অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ার আলামত দেখছেন।

রিয়াসাদ সানভীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 June 2020, 01:17 PM
Updated : 20 June 2020, 01:17 PM

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় থাকা এশীয় হাতির এভাবে একের পর এক ‘অস্বাভাবিক মৃত্যু’ চলতে থাকলে বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না বলে ধারণা তাদের।

বন বিভাগের হিসাবে, গত এক বছরে হাতি মারা গেছে ১৮টি। হাতির মৃত্যুর ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে বান্দরবানের লামা, দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার এলাকায়।

এর মধ্যে কেবল লামায় গত এক বছরে মারা গেছে চারটি হাতি। আর বন বিভাগ বলছে, এই জুন মাসেই লামা, চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং কক্সবাজারের টেকনাফে একটি হাতি করে মারা গেছে।

লামার বন কর্মকর্তা এস এম কাইছার আহমেদ অবশ্য বলছেন, লামায় যে চারটি হাতি মারা গেছে, তার দুটির বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া একটি পানিতে ডুবে ও অন্যটি বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যায়।

“পানিতে ডুবে মারা যাওয়া হাতির শরীরের আঘাতের চিহ্ন ছিল। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাটি ঘটে গত ১৩ জুন। উপজেলার খালকুইল্যা পাড়ার ঝিরিতে ১২ বছর বয়সী একটি হাতিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।”

গতবছরের ৬, ১৯ ও ৩০ নভেম্বর তিনটি হাতির মৃত্যু ঘটে। এসব ঘটনায় বন বিভাগ মামলা দায়ের করে।

হাতিপ্রেমীদের কাছে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক খবর আসে গত ১১ জুন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা থেকে। এখানকার পাথারিয়াখোলে মাটির নিচ থেকে একটি হাতির মৃতদেহ উদ্ধার করা যায়। ময়নাতদন্তে বেরিয়ে আসে, খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হাতিটিকে হত্যা করা হয়েছিল।

অন্যদিকে বন বিভাগের হিসাবে, গত এক বছরে কক্সবাজারে মারা গেছে সাতটি হাতি। বন্যপ্রাণী গবেষকদের হিসাবে অবশ্য সংখ্যাটি ১২।

কক্সবাজার উত্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, এর মধ্যে চারটি হাতির একটি বার্ধক্যজনিত কারণে এবং তিনটি রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

কক্সবাজার দক্ষিণের বন কর্মকতা মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, গত এক বছরে তার এলাকায় তিনটি বুনো হাতি মারা গেছে। গত ১২ জুন হ্নীলা মরিচ্যাঘোনা এলাকায় বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা যায় একটি পুরুষ হাতি। অন্য দুটো অসুস্থ হয়ে মারা যায়, যেটির ফুসফুস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল ময়না তদন্তের তথ্য আসে।

কেন ঘটছে হাতির মৃত্যু

কক্সবাজার বন বিভাগের দুই কর্মকর্তাই হাতির আবাসস্থল ও চলাচলের পথ নষ্ট হওয়ার জন্য মূলত দায়ী করেছেন রোহিঙ্গা বসতিকে। হাতির আক্রমণে ১৩ জন রোহিঙ্গা নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

হাতির মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে শঙ্কিত বন বিভাগও। তারা এ জন্য দায়ী করছে অপরিকল্পিত উন্নয়নকে, জানিয়েছে নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথাও।

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক হাতির মৃত্যুর ঘটনায় বন বিভাগও শঙ্কিত। অবশ্য শেষ কয়েক বছরে হাতি মারা যাওয়ার যেসব ঘটনা ঘটেছে সবগুলোই হত্যার ঘটনা নয়। বার্ধক্যজনিত কারণেও হাতি মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পেয়েছি এসব ঘটনার পেছনে মানুষ এবং হাতির দ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

“যেমন কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফ বেল্টে ৪২ বুনো হাতির বিচরণ ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের পর থেকে যখন ব্যাপক রোহিঙ্গা ক্যাম্প গড়ে উঠে তখন হাতির বিচরণ স্থল এবং খাদ্যের উৎস নষ্ট হয়ে যায়। ফলে সে অঞ্চলে একের পর এক হাতির কারণে মানুষ এবং মানুষের হাতে হাতি হত্যার ঘটনা আমরা দেখছি।”

ঘটনা যাই ঘটুক বন বিভাগ বসে নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “হাতির মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হচ্ছে। বেশ কয়েকজনকে আটক করে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।

“শেরপুরের ঝিনাইগাতিসহ তৎসংলগ্ন অঞ্চলে জনগণকে সচেতন করতে এলিফেন্ট রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছিল ২০১৫-১৬ সালে। এর মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে হাতি লোকালয়ে হানা দিলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে হাতি তাড়ানো সম্ভব হয়। আমরা দেখেছি এতে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব সেখানে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।”

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক জহির আকন বলেন, “হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়ছে এটি হচ্ছে মূল সত্য। হাতির নির্দিষ্ট একটা ট্র্যাক থাকে। দেখা গেছে সেখানে এখন মানব বসতি, কৃষি জমি, উন্নয়নমূলক নানা কর্মকাণ্ড হচ্ছে, ফলে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে।”

বন বিভাগের হিসাবই বলছে, হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব কতটা বেড়েছে।

বন বিভাগের বন্যপ্রাণী এবং প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ সালে হাতির আক্রমণে মারা গেছে ৩৫ জন, আহত হয়েছে ১৭ জন। ১১০টি বাড়িঘর, গাছপালা, ফসলের ক্ষতি সাধনের ঘটনা ঘটেছে। হাতির আক্রমণে মানুষ মারা গেলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় এক লাখ টাকা, আহত হলে ৫০ হাজার টাকা। সম্পদের ক্ষতি হলে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

২০১৯ সালে যেখানে ২৬ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে সেখানে এবছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ৪৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা, অবস্থা নিয়ে গবেষণা করেছে বন বিভাগ এবং আইইউসিএন। ২০১৭ সালে তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বনাঞ্চলে আবাসিক বুনো হাতি আছে ২৬৮টি। এর মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ হাতি ৬৭টি, প্রাপ্ত মাদী হাতি ১৭২টি এবং বাচ্চা হাতি ২৯টি।

এছাড়া দেশের সীমান্তবর্তী দেশের পাঁচটি বনাঞ্চলে ৯৩ থেকে ১০৭টি পরিযায়ী হাতির বিচরণের কথা বলা হয়েছে। গবেষণায় নয়টি বিভাগীয় বন অফিসের আওতায় হাতি চলাচলের ১১টি রুট চিহ্নিত করা হয়েছিল, যার মোট দৈর্ঘ্য ১৫১৮ কিলোমিটার।

আইইউসিএনের হিসাবে, বাংলাদেশের আবাসিক হাতির বিচরণ বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৬৫টি হাতির বাস। এরপরে আছে কক্সবাজার দক্ষিণে ৬৩টি, উত্তরে ৫৪টি, লামা বন বিভাগের আওতায় ৩০টি, বান্দরবান বিভাগের আওতাধীন ১১টি, পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণে ২৮টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরে ১৩টি বুনো হাতির বাস। ময়মনসিংহ এবং সিলেট অঞ্চলে কোনো আবাসিক বুনো হাতি নেই।   

আইইউসিএনের বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রাকিবুল আমীন বিডিনিউজ টোয়েটিফোর ডটকমকে বলেন, “হাতি চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট রাস্তা যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে। আমরা দেখতে পাচ্ছি তাদের সেই এলাকাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে মিয়ানমার পর্যন্ত এশিয়ান হাতির আন্তর্জাতিক চলাচলের পথ রয়েছে। সেই পথের বিভিন্ন স্থানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, রোহিঙ্গা ক্যাম্প স্থাপনের ফলে তারা চরম ঝুঁকিতে পড়েছে।

“বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি হাতি কিন্তু শ্রীলঙ্কায় আছে। কিন্তু সেখানে হাতি এবং মানুষের সহাবস্থানের বিষয়টি মাথায় রেখে পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে সে বিষয়টি অনুপস্থিত। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। হাতি মানুষের দ্বন্দ্ব বেড়েছে। হাতির বিচরণক্ষেত্র রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অন্তত দেড়শ বার হাতির হামলার ঘটনা ঘটেছে।”

ধুঁকতে থাকা বুনো হাতির জন্য আসন্ন আরেকটি বড় বিপদ হিসেবে দেখা হচ্ছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের ঘুনধুম পর্যন্ত চলমান ১২৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প। রেলপথটি গেছে বুনো হাতির অন্যতম তিন বিচরণক্ষেত্র চুনতি ও ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে। যার দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। এই প্রকল্পে পড়েছে হাতি পারাপারের পথ অন্তত ২১টি।

যদিও এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমানের দাবি, বুনো হাতিসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দায়িত্ববোধের জায়গা এই প্রকল্পে কয়েকটি ওভারপাস এবং আন্ডারপাস নির্মাণসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

“পৃথিবীর আর কোনো জায়গায় রেললাইনে শুধু হাতির জন্য এ ধরনের ব্যবস্থার রাখার দৃষ্টান্ত নেই,” বলেন তিনি।

তবে এখন পর্যন্ত নেওয়া পদক্ষেপগুলোকে পর্যাপ্ত মনে করছেন না গবেষকরা। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান বলেন, “হাতি কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম একই পথে ধরে চলে। এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের সবাই মোটামুটি অবহিত। আর হাতি চলাচলের পথ নিয়ে ইতোমধ্যেই ম্যাপিংও হয়েছে। তারপরও হাতি চলাচলের পথে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠছে, মানুষের বাসস্থান ক্ষেত খামার হচ্ছে। রেললাইন, রাস্তাঘাট নির্মাণ হচ্ছে। এ জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আমরা।

“অন্যদিকে হাতির প্রজনন হার কিন্তু খুব কম। একটি মাদী হাতি চার বছরে একটি শাবকের জন্ম দেয়। আমাদের দেশের হাতির বর্তমান যে সংখ্যা তার সাথে মারা যাওয়ার হার হিসাব করলে বলতে পারি, বাংলাদেশ থেকে আমাদের আবাসিক হাতি বিলুপ্ত হতে বেশি সময় লাগবে না। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায়ই হাতির বড় আবাস। সেখানে এখন বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা বসতি। শুধু যে বসতি এলাকাগুলোই সমস্যা সৃষ্টি করছে তা না, আশপাশের অঞ্চলের বনভূমিও উজাড় হচ্ছে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহসহ রোহিঙ্গাদের জীবনধারণের প্রয়োজনে।”

বন্যপ্রাণী গবেষক শাহরিয়ার সিজার রহমান বলেন, “হাতি এমন একটি প্রাণী যারা বনে যদি তাদের খাবার প্রাকৃতিকভাবে পায়, তাহলে লোকালয়ে আসবে না। কিন্তু এখন সব অঞ্চলে, বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে ভয়ংকরভাবে বন উজাড়, গাছ কাটা চলছে।

“এক সময় মাতামুহুরি রিজার্ভসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় হাতি ছিল। কিন্তু এখন অব্যাহতভাবে বসতি স্থাপন, বন উজাড়ের কারণে মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে সাঙ্গু সংরক্ষিত বনে কিছুসংখ্যক টিকে আছে। তারা মিয়ানমার- বাংলাদেশে যাওয়া-আসা করে।”

এক গবেষণায় ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ওই অঞ্চল ছাড়াও কাসালং সংরক্ষিত বনে হাতির অস্তিত্বের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।