লকডাউনে ‘প্রকৃতির মেরামত’ ঘিরে নতুন শুরুর আশা

লকডাউনে মানুষের চলাচল সীমিত হওয়ায় কক্সবাজার সৈকতে দেখা মিলছে ডলফিন-বিরল কচ্ছপের, বুড়িগঙ্গার পানি কিছুটা স্বচ্ছ হয়ে কমেছে দুর্গন্ধ, ঢাকার আরেক নদী তুরাগে উঁকি দিচ্ছে শুশুক; প্রকৃতির এই মেরামত আগামীর প্রত্যাশিত স্বাভাবিক দিনগুলোতেও বজায় রাখার দাবি জানাচ্ছেন পরিবেশকর্মী ও বিশেষজ্ঞরা।

আইরিন সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2020, 04:55 PM
Updated : 15 May 2020, 05:17 PM

তাদের আশা, মানুষের টিকে থাকার প্রয়োজনে নদী-পরিবেশ ও প্রাণিজগতের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করাটাই হয়ে উঠুক এই মহামারীর শিক্ষা।

বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সমন্বয়ক মিহির বিশ্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই পৃথিবীর অধিকার শুধু মানুষের একার নয়, অন্যান্য প্রাণি ও উদ্ভিদেরও অধিকার আছে।

“আমরা নদীর আইনি সত্তার জন্য লড়াই করেছি; সেটা স্বীকৃত হয়েছে। প্রকৃতিতে অন্য যে প্রজাতি আছে তাদের অধিকার অক্ষুণ্ন না রাখলে আমরা মানুষ হিসেবে টিকে থাকতে পারব না।”

এ বছরের শুরু থেকেই মহামারীর প্রকোপ বাড়তে থাকায় মানুষের চলাচল, যানবাহন আর শিল্পায়ন স্থবির হতে শুরু করে। এই ফাঁকে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, ‘গ্যাস চেম্বার’ হিসেবে পরিচিত ভারতের দিল্লিতে বায়ুর গুণগত মানে অল্প থেকে বিস্তর উন্নতি ঘটেছে বলে বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে।

 

নিউ মার্কেট থেকে নীলক্ষেত ও আজিমপুরের পথ যেন চেনা যায় না। ছবি: সাদ আব্দুল্লাহ

বাংলাদেশে গত ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া লকডাউন পরিস্থিতি কয়েক দফায় বাড়িয়ে আগামী ৩০ মে পর্যন্ত করা হয়েছে। সারা দেশ অবরুদ্ধ হওয়ার পর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার বাতাসে বিষের মাত্রা কমতে দেখা গেলেও বায়ুমান তখনও ‘অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়েই ছিল।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাংলাদেশে পুরোপুরি লকডাউন কার্যকর হয়েছে এপ্রিল থেকে। এ সময়টা সারা দেশেই অধিদপ্তরের এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং স্টেশন চালু ছিল।

ঢাকার বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) উপস্থিতি কমে আসার চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “লকডাউনের আগে মার্চে ঢাকার বাতাসে পিএম ১০ প্রতি ঘনমিটারে গড়ে ১৬২ মাইক্রোগ্রাম ছিল। এপ্রিলে তা নেমে আসে ১১৭ মাইক্রোগ্রাম। আরও ক্ষুদ্র ধূলিকণা পিএম ২.৫ মার্চে পাওয়া গেছে প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম, এপ্রিলে সেটা কমে আসে ৪৫ মাইক্রোগ্রামে।”

বাতাসে পিএম ১০ ও পিএম ২.৫ এর উপস্থিতির ভিত্তিতে বায়ু মানের সূচক (একিউআই) নির্ধারিত হয়। একিউআই শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে সেই এলাকার বাতাসকে ভালো বলা যায়। ৫১-১০০ হলে বাতাসের মান মডারেট বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ধরা হয়। একিউআই ১০১-১৫০ হলে সেই বাতাস স্পর্শকাতর শ্রেণির মানুষের (শিশু, বৃদ্ধ, শ্বাসকষ্টের রোগী) জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং ১৫১-২০০ হলে তা সবার জন্যই অস্বাস্থ্যকর বিবেচিত হয়।

নির্মাণ কাজ ও যানবাহন বন্ধ থাকা এপ্রিলে বায়ুমানের উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জিয়াউল বলেন, “তবে আমরা জানতে পেরেছি, প্রায় ৭০ শতাংশ ইটভাটায় কাজ চলেছে। আমাদের বায়ুমান আরও ভালো হতো যদি এগুলো বন্ধ থাকত।” 

বাষু দূষণ রোধে অধিদপ্তরের পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সার্বিক বায়ু দূষণ কমিয়ে আনায় উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে আমরা একটা নির্দেশনা করেছি। ওটা সমন্বিতভাবে বাস্তবায়নে নামলে বায়ু দূষণ অনেকটা কমে যাবে। মানে লকডাউনের আগে যে খারাপ অবস্থা ছিল, সেটা আর ফিরে নাও আসতে পারে।” 

বায়ু দূষণের সাথে নদী দূষণের ‘গভীর সম্পর্ক’ রয়েছে জানিয়ে নদীকর্মী মিহির বিশ্বাস বলেন, নদীর পানিকে ভালো রাখতে হলে বায়ুর মানও ভালো রাখতে হবে।

 

নদী দূষণ চিত্রে এই সময় কোনো পরিবর্তন দেখা গেছে কি না জানতে চাইলে রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গার উদাহরণ টেনে মিহির বিশ্বাস বলেন, “পানিটা একটু স্বচ্ছ দেখা যাচ্ছে। মাছের আনাগোনা-লাফালাফি দেখা যাচ্ছে। আশপাশের অধিবাসীদের সাথে আমার প্রায়ই কথা হয়, তারা বলছে দুর্গন্ধটা কমেছে।”

তবে লকডাউন উঠে গেলে আবার নদীতে আগের মতো ময়লা-আবর্জনা ও কারখানার বর্জ্য ফেলা শুরু হলে এই পরিবর্তন স্থায়ী হবে না বলে সতর্ক করেন তিনি।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে বুড়িগঙ্গা পরিদর্শন করেছেন নদী নিরাপত্তার সামাজিক সংগঠন নোঙরের সভাপতি সুমন শামস। নদীর পানি আগের মতো কুচকুচে কালো না দেখা গেলেও এটাকে বড় পরিবর্তন মনে করছেন না তিনি।

পরিবর্তন ‘বেশি না কম’ তা বুঝতে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এই নদীকর্মী বলেন, “এর আগে আমরা কখনও এভাবে একটানা আবদ্ধ থাকিনি, লকডাউনে থাকিনি। এই সময় থেকে শেখার আছে…এই যে নদীটা কিছুটা পরিষ্কার হল, এর ওপর ভিত্তি করে একটি সুন্দর পরিকল্পনা করা যেতে পারে।”

লকডাউনের এই সময়ে যখন দূষণ কমছে, তা পর্যবেক্ষণ ও তার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা যায় কি না সে বিষয়ে সরকারের নদী সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

শামস বলেন, “আমরা হাই কোর্টের মাধ্যমে রায় এনেছি, সব নদীর অভিভাবক নদী রক্ষা কমিশন। এই রকম সংকটকালে সরকারকে, নদীকর্মীদের তারা পরামর্শ দেবেন এটা আমাদের প্রত্যাশা ছিল। আমাদের এ সময় গাইড করবে কে?”

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ আকর্ষণ করলে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার বললেন, লকডাউনের কারণে সংস্থার ‘অনেক সরেজমিন কাজ’ বন্ধ রয়েছে।

লকডাউনের এই দুই মাসে নদী দূষণ চিত্রে বড় কোনো পরিবর্তন নেই বলেই মনে করছেন তিনি।

এই অভিমতের পেছনে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, এই মৌসুমে বৃষ্টির কারণে পানিতে বরাবরই দুর্গন্ধ কমে আসে।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, “আর এই সময় যেহেতু অপারেশন চলছে না তাই দখলের চিত্র তো সেভাবেই আছে। অবৈধ বালু উত্তোলন কমেছে বলে আমরা মনে করি না। বর্ষা তো চলে আসবে, এই যে বালু উত্তোলনটা করেছে তার বিরূপ প্রভাব (নদী ভাঙ্গনে) পড়তেও পারে। শিল্পায়ন বন্ধ থাকায় তরল বর্জ্য কিছুটা কমেছে। কিন্তু বাসাবাড়ির বর্জ্য তো আগেরই মতই ডাম্পিং হচ্ছে।”

সম্প্রতি তুরাগ নদীতে শুশুক দেখা যাওয়ার বিষয়টি কয়েকটি গণমাধ্যমে এসেছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন পর এই নদীতে দেখা মিলেছে শুশুকের।

তবে বন্যপ্রাণী গবেষক সীমান্ত দীপু একে ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হিসেবেই দেখছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকমকে বলেন, “এগুলো সব সময়ই ছিল। এমন না যে রাতারাতি দুই-চার মাসের মধ্যে সব কিছু বদলে যাবে।”

জনসমাগমহীন সমুদ্রে গোলাপি ডলফিনের তীরের কাছাকাছি এসে জলকেলির ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “আমাদের লকডাউনের ফলে জেলেদের চলাচলটা কমে গিয়েছিল, তাতে করে ডলফিনদের চলাচলের জায়গাটা বেড়ে গিয়েছিল।”

 

মহামারীর এই সময়েও প্রকৃতির ওপর মানুষের আচরণে তেমন একটা পরিবর্তন দেখছেন না জানিয়ে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) এই গবেষক বলেন, “খারাপ দিকটা হচ্ছে, রিমোট এরিয়াতে যেখানে ব্রিডিং এরিয়া…মাছ ধরা বা জাল পাতা নিষেধ, লকডাউনের এই সময় হয়ত আইনি নজরদারি নাই, এই ফাঁকে জেলেরা মাছ ধরার সুযোগ নিচ্ছে।”

ঋতুবৈচিত্র্যে এই দুই-তিন মাস খুব গুরুত্ব রাখে জানিয়ে সীমান্ত দীপু বলেন, “এই সময় মাইগ্রেশন পিরিয়ড, এই সময় ব্রিডিং হয় প্রাণিদের। পরের বছর আমরা বুঝতে পারব, এই সময়টা কতটা সাকসেস হয়েছে প্রাণিদের জন্য।”

‘প্রকৃতির ফেরা’ নিয়ে অনেকেই যে সম্ভাবনা দেখছেন, তা আসলে সবার অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন এই বন্যপ্রাণি গবেষক।

দেশের মানুষকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মতো দেশে এটা সম্ভব না যে কর্তৃপক্ষ জনে জনে গিয়ে সতর্ক করবে। সাধারণ মানুষ যদি দায়িত্ব না নেয়, তাহলে এটা জীববৈচিত্র্যের জন্য খারাপ।”

প্রকৃতির প্রতি মানুষের ‘আচরণ’ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন বেসরকারি সংগঠন ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের সহপ্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার রহমান সিজারও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা আসলে প্রকৃতিরই অংশ। ফরেস্ট ওয়াইল্ড লাইফ বিভিন্ন ভাইরাসের একটা রিজার্ভার হিসেবে কাজ করে। ওরা ওদের মতো থাকলে কিন্তু সেটা আমাদের শরীরে আসবে না।

“কিন্তু বনে গিয়ে ওদের জায়গা ধ্বংস করে দেই, বন্যপ্রাণি ধরে এনে বাজারে বিক্রি করি, তখন তো স্বাভাবিকভাবেই ওই রোগগুলো চলে আসবে।”

‘মানুষ ঘরে ঢোকার সাথে সাথে’ জীববৈচিত্র্য ফিরে আসতে শুরু করেছে, এমন  ‘সহজ’ করে ভাবার কোনো সুযোগ দেখছেন না এই বন্যপ্রাণি গবেষক।

অপরাধীরা এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে বলে সতর্ক করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “লাউয়াছড়ায় এখন টুরিস্টদের আনাগোনা নেই। পাশাপাশি সরকারেরও পেট্রোলিং (নজরদারি) নাই এখন। এটা বন্ধ হওয়ার কারণে কিন্তু ওখানে চুরি করে বন্যপ্রাণি ধরা বেড়েছে, শিকারটা বেড়েছে। সেটা কেউ দেখছে না। বাস্তবে আসলে সেটা হচ্ছে।”

গত ৮ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর হালদা নদীতে ভাসমান অবস্থায় একটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়, সেটিকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে হত্যা করা হয়েছিল।

 সতর্ক করে শাহরিয়ার রহমান সিজার বলেন, “সাগরে মাছ ধরার জালে মা কচ্ছ আটকে যায়। যেহেতু সরীসৃপ, ওরা কিছুক্ষণ পর পর পানির উপর উঠে ওদের নিঃশ্বাস নিতে হয়। জালে যখন আটকে যায় নিঃশ্বাস নিতে না পেরে দম আটকে মারা যায়। এসব কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না।”

অন্যদিকে পাথর তোলা, গাছকাটা এখনও চলছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি। 

নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই প্রকৃতির প্রতি সদয় হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিজার বলেন,  “প্রকৃতির উপর অত্যাচার করে আমরা নিজেরা টিকতে পারব না, আমাদের অর্থনীতি যতই শক্তিশালী হোক।

“আমরা যেন কিছুটা অত্যাচার কমাই- সেটাই হোক এই মহামারীর শিক্ষা। না হলে কিন্তু এটা মাত্র শুরু, এর থেকেও ভয়াবহ পরিস্থিতি আসতে পারে।”

আরও পড়ুন