‘বন্যদের তাদের মতো থাকতে দাও’

করোনাভাইরাসে লাখো মানুষের মৃত্যুতে বিষণ্ন মন জুলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের প্রধান ডমিনিক জার্মির; তবে তা ছাপিয়ে উঠেছে রাগ।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 April 2020, 06:43 PM
Updated : 26 April 2020, 05:53 PM

তার মতে, মানুষের লোভের কারণে এই মহামারী অবশ্যম্ভাবীই ছিল, আর মানুষ চাইলেই তা এড়াতে পারত।

মানুষ সেই কাজটি করল না বলেই ক্রোধ জুলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের মহাপরিচালক জার্মির।

মানুষ কী করছে, যা এই মহামারী ডেকে এনেছে, তা নিয়ে তিনি লিখেছেন যুক্তরাজ্যের দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্টে।

তার ভাষ্যে, মানুষ যেভাবে বনের পরিবেশ ধ্বংস করে বন্যপ্রাণী নিয়ে বাণিজ্যে মেতে উঠেছে, তার ফল এখন ভোগ করছে এই মহামারীতে পড়ে।

“মহামারীর এই ভয়াবহতা আর বিষাদের মধ্যে আমার মনে জাগছে ক্রোধ, সেই সঙ্গে হতাশা। কারণ এমনটা অভাবনীয় ছিল না, আর এটা প্রতিরোধও করা যেত।”

জুলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের মহাপরিচালক ডমিনিক জর্মি।

জুলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের মহাপরিচালকের কথায় সায় মেলে জুলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার দের বক্তব্যেও।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সার্স, ইবোলা, সোয়াইন ফ্লু, নিপা ভাইরাস- সবকিছুই প্রাণী থেকে এসেছে। বাদুড়ে ২৮ ধরনের ভাইরাস রয়েছে, যার একটি নিপা ভাইরাস।

“কিন্তু এটি তো বাদুড়ের কোনো ক্ষতি করে না। কিন্তু মানুষের তো করে। যেগুলোতে মাঝে মাঝে মানুষ সংক্রমিত হয়।”

তপন কুমার বলেন, “মানুষ যদি বন দখল করে, বন্যপ্রাণীর জন্য যদি সে হুমকির কারণ হয়, তাকে যদি বন্দি করতে চায়, তাহলে তো স্বাভাবিকভাবে প্রাণীর কনটাক্টে চলে যাবে মানুষ। তখন তাদের থেকে সংক্রমিত হবেই।”

“এজন্য বনের প্রাণীকে বনে রাখা উচিৎ, আর মানুষেরও তাদের জায়গায় থাকা উচিৎ,” বলেন তিনি।

যে নতুন করোনাভাইরাস এখন গোটা বিশ্বকে প্রায় অচল করে দিয়েছে, সেই ভাইরাসটিও বাদুড় থেকে অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে মানবদেহে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

এজন্য আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহরের একটি বন্য প্রাণীর বাজার। ধারণা করা হচ্ছে, ওই বাজার থেকেই প্রথম প্রাণঘাতী এই ভাইরাসটি মানবদেহে উঠে আসে।

চীনের ওই বাজারটিতে বিচিত্র ধরনের বন্যপ্রাণী পাওয়া যেত। আর বিশ্বজুড়ে বন্যপ্রাণীর একটি বাজার রয়েছে, যার বড় অংশই অবৈধ।

চীনের উহান শহরের সেই মার্কেট, যেখান থেকে নতুন করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

ডমিনিক জার্মি বলছেন, “মানুষের নিষ্ঠুরতায় দশকের পর দশক যেভাবে বন্য পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছিল, তাই আমাদের এই ধরনের ঝুঁকির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

“আর এটা গোপনীয় কোনো বিষয় ছিল না, যদিও বিশ্ব নেতারা এখন এটা অপ্রত্যাশিত বলে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন। আসল সত্য হল, এমনটা হবে, তা আমরা জানতাম।”

ভবিষ্যতে ঝুঁকি কমিয়ে আনতে বন্যপ্রাণী নিয়ে ব্যবসা বন্ধে এখন থেকে তৎপর হবে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান জুলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের প্রধান।

তিনি বলেন, যেখানে বন্যপ্রাণী কেনা-বেচা হয়, সেই বাজারগুলো বন্ধ করতে হবে।

করোনাভাইরাসের মহামারীতে অবরুদ্ধ অবস্থায় বন্যপ্রাণী বিক্রি, পাচার ও এ সংক্রান্ত অপরাধও কমে যাওয়ার খবর দিয়েছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।

ঢাকার বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক এ এম এম জহিরউদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আন্তর্জাতিকভাবে বন্যপ্রাণী পাচার বন্ধ হয়ে গেছে, যে রুটগুলোতে পাচার হত, তা বন্ধ হয়ে হয়েছে। দেশের ভেতরে বন্যপ্রাণীকেন্দ্রিক যে অপরাধগুলো হত, তা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।”

জানা তথ্য বলছে, বাদুড় থেকেই এসেছে নতুন করোনাভাইরাস

বন্যপ্রাণীর বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বদলানোর উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, মানুষের কল্যাণে ইকোসিস্টেমকে ঠিক রাখতে বন্যপ্রাণীকে তার নির্দিষ্ট জায়গায় রাখাতে হবে।

“সবাই যখন ঘরে আছে, তখন ওরা ওদের জায়গায় নিরাপদ আছে। আমরা এখান থেকে শিক্ষা পেতে পারি যে, আমরা যদি প্রকৃতিকে নষ্ট না করি, পরিবেশকে পরিবেশের মতো থাকতে দিই, তাহলে পরিবেশও ভালো থাকবে, আমরাও ভালো থাকব।”

জুলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার দে বলেন, “হাতির আবাসস্থল আমরা দখল করি, কিন্তু হাতি থেকে তো অনেক রোগ ছড়ায়। বাঘে এক ধরনের ভাইরাস থাকে, সে যখন লোকালয়ে চলে আসে, তখন মানুষ সে ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। সেকারণে মানুষের প্রাণী থেকে দূরে থাকতে হবে।”

ডমিনিক জার্মিও বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারী, যার প্রভাব মানুষের জীবন ও অর্থনীতিতে পড়েছে, তা আমাদের সেই উপলব্ধি এনে দিয়েছে যে মানুষ আর বন্য প্রাণীর মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে আমরা নতুন করে ভাবতে হবে।”