লকডাউন: বায়ুমানে সীমিত স্বস্তি

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে মানুষ এখন ঘরবন্দি, যানবাহন চলাচালও সীমিত; তাতে ঢাকার বাতাসে বিষের মাত্রা কমতে শুরু করলেও বায়ুমান এখনও রয়েছে ‘অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 April 2020, 05:27 AM
Updated : 4 April 2020, 05:44 AM

বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ভারী বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) হিসাব করে যে বায়ুমান সূচক (একিউআই) তৈরি করা হয়, তাতে দুপুর থেকে বিকালে ঢাকায় বাতাসের মান থাকছে ৯০ থেকে ১১০ এর মধ্যে। রাতে তা বেড়ে ১৬০ বা ১৭০ হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এমনিতে ঢাকায় ২০০ বা এর উপরে পাই। যানবাহন চলাচল এবং নির্মাণ কাজ কমে যাওয়ার কারণে দিনে এখন দূষণের মাত্রা কমেছে। ট্রাক চলার কারণে দিনের তুলনায় রাতে একটু বেশি পাওয়া যাচ্ছে।”

বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এককে। এসব বস্তুকণাকে ১০ মাইক্রোমিটার ও ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস শ্রেণিতে ভাগ করে তার পরিমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করেন গবেষকরা।

পিএম ২.৫, পিএম ১০ ছাড়াও সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এবং গ্রাউড লেভেল ওজোনে সৃষ্ট বায়ুদূষণ বিবেচনা করে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বা একিউআই নম্বর হিসাব করা হয়, যার মধ্য দিয়ে আসলে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বোঝার চেষ্টা করেন গবেষকরা। একিউআই যত বাড়তে থাকে, বায়ুমান তত ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচিত হয়।

একিউআই শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকলে সেই এলাকার বাতাসকে ভালো বলা যায়। ৫১-১০০ হলে বাতাসের মান মডারেট বা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য ধরা হয়।

একিউআই ১০১-১৫০ হলে সেই বাতাস স্পর্শকাতর শ্রেণির মানুষের (শিশু, বৃদ্ধ, শ্বাসকষ্টের রোগী) জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং ১৫১-২০০ হলে তা সবার জন্যই অস্বাস্থ্যকর বিবেচিত হয়।

আর একিউআই ২০১-৩০০ হলে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ পেরিয়ে গেলে সেই বাতাসকে বিপদজনক ধরা হয়।

বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে বায়ুমান সাধারণত ভালোই থাকে। তবে বর্ষা শেষে ধুলা বাড়তে থাকে বলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ হয়ে ওঠে।

মেট্রোরেলসহ চলমান কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ঢাকা গত কয়েক বছর ধরেই ধুলার রাজ্যে পরিণত হয়েছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন এলাকার ইটভাটার দূষণ।

এ কারণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় বাংলাদেশের রাজধানীর নাম উপরের দিকেই থাকছে বেশ কিছুদিন ধরে। শীত এলেই নাক-চোখ ও শ্বাসতন্ত্রের অসুখ নিয়ে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে দূষণ কমাতে উচ্চ আদালতকেও গত দেড় বছরে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন আদেশ-নির্দেশ দিতে হয়েছে।

সরকারের পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট-সিএএসই প্রকল্পের একিউআই আর্কাইভের তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত বায়ুমান সূচকে ঢাকার বাতাসের মান ছিল ২০০ এর বেশি। কোনো কোনো দিন তা ৩০০ ছাড়িয়ে বিপদজনক মাত্রায় পৌঁছাতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একিউআই ওঠে ৩৬৩ তে।

তবে দেশে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ঢাকায় কমতে থাকে মানুষের চলাচল। সেইসাথে কমতে থাকে বায়ুদূষণের মাত্রা। ১৪ মার্চ ঢাকায় একিউআই নেমে আসে ১৮৩ তে, ১৫ মার্চ তা আরও কমে ১৬৯ হয়।

১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হলে দিনের প্রথম ভাগে রাস্তায় মানুষের চলাচল আরও কমে আসে। ২২ মার্চ সিএএসই এর প্রকাশিত বায়ুমানে ঢাকার বাতাসের একিউআই ছিল ১৫৮।

করোনাভাইরাসের মহামারী ঠেকাতে অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও গত ২৬ মার্চ থেকে অফিস আদালত, যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্য অনুযায়ী, ২৯ মার্চ ঢাকার একিউআই নেমে আসে ১২০ এ, যা চলতি বছরে ঢাকায় সবচেয়ে ভালো বায়ুমানের সূচক। পরদিনও ঢাকায় একিউআই ছিল ১৫০ এর কম।

তবে লকডাউনের মধ্যেই পরের দুদিনে একিউআই বেড়ে ১৭৩ হয়। অবশ্য তা ফেব্রুয়ারি ও মার্চের প্রথমার্ধের তুলনায় কম।

এখন বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত ঢাকায় একিউআই মোটামুটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় থাকলেও রাতে মানের অবনতি হওয়ায় দৈনিক গড় আর সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকছে না।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইন্টারন্যাশনালি দেখলাম দূষণের মাত্রা কমেছে। সাধারণত অন্যান্য সময় আমাদের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ২০০ এর উপরে থাকে। সেখানে এখন মোটামুটি দেড়শর কাছাকাছি আছে।”

 অবশ্য বিশেষ পরিস্থিতিতে বায়ুমানে এই সাময়িক পরিবর্তনে খুব বেশি স্বস্তির কিছু দেখছেন না তিনি। বরং স্বাভাবিক সময়ে ঢাকার বায়ুমান স্বাস্থ্যকর রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছেন।

“কনস্ট্রাকশন কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, সেগুলোতে যেন ডাস্ট পলিউশনটা কম হয়, আনঅথরাইজড আনফিট গাড়ি চলে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। ঢাকার চারপাশের ইটভাটাগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দিতে হবে।”

 বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, “দেখে মনে হচ্ছে, আমরা বায়ুদূষণ থেকে আপাতত রক্ষা পেয়েছি, কিন্তু তা তো ঠিক না। রাস্তায় মানুষ বাড়লেই এটা আবার আগের মত হয়ে যাবে।”

দূষণের উৎসগুলো দমন করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “কতগুলো শিল্পকারখানা থাকবে, দূষণ কতটুকু হবে- এগুলোর পরিকল্পনা তো সরকারের নাই। শিল্পকারখানা করলেন, তার জন্য তো বিজ্ঞানভিত্তিক বর্জ্য নিষ্কাশন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।

“আবার কলকারখানা চালু হবে, আবার মানুষ ফিরে আসবে, আবার দূষণ হবে। শহর তো ভালো থাকবে না। উন্নয়ন লাগবে আমাদের, কিন্তু উন্নয়নের জন্য পরিবেশ দূষিত হবে, সেটার জন্য কি করতে হবে তা তো রাষ্ট্রের জানার কথা।”