২০১৯: নদীর জীবনে ফেরার বছর

তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির কোনো রাজনৈতিক সুরাহা না মিললেও তুরাগের ‘লিগ্যাল পারসন’ হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে বছরজুড়ে চলেছিল নদীকে তার প্রবাহে ফেরানোর তোড়জোড়।

আইরিন সুলতানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2019, 04:16 AM
Updated : 31 Dec 2019, 10:11 AM

পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি আর পাড় দখলকারীদের উচ্ছেদ বছরের শুরু থেকে আলোচনায় থাকলেও শেষে এসে তা গতি পায়। সারাদেশে একযোগে শুরু হয় নদী তীর দখলমুক্তের কাজ।

নদীর অধিকার প্রাপ্তি

মানুষের মতো নদীও ভোগ করতে পারবে সাংবিধানিক অধিকার। নিউ জিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পর ৩০ জানুয়ারি বাংলাদেশেও আসে এই ঐতিহাসিক রায়।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাই কোর্ট বেঞ্চ  নদীকে ‘জুরিসটিক পারসন বা লিগ্যাল পারসন’ অর্থ্যাৎ জীবন্ত সত্তা  হিসেবে ঘোষণা করেন। 

আদালতের এই রায়ের মধ্যে দিয়ে নদীর মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হওয়াকে স্বাগত জানান সবাই।

ঢাকার আশপাশে বহমান চার নদী  বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ রক্ষায় পূর্বে দেওয়া রায়ের বাস্তবায়ন না হওয়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে দেশের সব নদীর দখল করে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা সরানোর নির্দেশনাও দেয় আদালত। আর পুরো কর্মকাণ্ড সমন্বয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদীর ‘আইনগত অভিভাবক’ ঘোষণা করা হয়।

তুরাগ নদ ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তুরাগ এখন এক মৃতপ্রায় নদী। শহর আর কলকারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত বর্জ্য তুরাগ নদের পানির দূষণের মাত্রা বাড়িয়েছে বহুগুণ। শত শত ইটভাটা আর কলকারাখানা গড়ে উঠেছে এ নদীর দুই তীর দখল করে। দূষণ আর দখলে তুরাগের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে শীত মৌসুমে কোথাও কোথাও একে মনে হয় মরা খাল!

দখলে নদী হারানোর চিত্র

নদী রক্ষা কমিশনের হিসেবে দেশে নদীর সংখ্যা ৪০৬টি হলেও এর একটিও দখলমুক্ত নয়।

গত ১ জুলাই প্রকাশিত হাই কোর্টের এক রায়ে নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে নির্দেশনা দেওয়ার পর নদী রক্ষা কমিশন দখলকারীদের একটি তালিকা উন্মুক্ত করে। নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে নদী দখলকারীদের বিভাগভিত্তিক তালিকায় দেশের ৬২ জেলায় নদী, খাল-বিল, জলাশয়-জলাধার দখলকারী হিসেবে ৪৬ হাজার ৮৩৯টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম প্রকাশ পায়।

এর মধ্যে নোয়াখালী জেলায় নদী দখলকারীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি; ৩ হাজার ৫৮৩ জন।

এসব দখলকারীদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী, প্রভাবশালী ব্যক্তি। এছাড়াও বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ ও আবাসন প্রকল্পগুলোও  নদী-জলাশয়গুলোর জায়গা হাতিয়ে নিচ্ছে।

বাদ যায়নি নদী পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ভূমিকা রাখা অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিওটিএ) নামও।

বুড়িগঙ্গা দখল করে ইকো পার্ক গড়ে তোলার অভিযোগ অস্বীকার করে বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান কমোডর মাহবুবুল ইসলাম বলেন, বরং বেদখল হওয়া জমিটি উদ্ধার করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

বুড়িগঙ্গা দখলকারীর তালিকায় আরও এসেছে মেসার্স ম্যাক এন্টারপ্রাইজেস লিমিটেড, চান টেক্সটাইল মিল লিমিটেডসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নাম।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বসিলায় তুরাগের একটি অংশ  দখল করে অবৈধভাবে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছিল আমিন অ্যান্ড মোমিন ডেভেলপমেন্টস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি। 

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকার ফার্মগেইটে জাতীয় নদী রক্ষা অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে ‘নদীর উন্নয়নে পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার দায়-দায়িত্ব’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে নদী-খালসহ অন্যান্য জলাশয়গুলো ইজারা দেওয়ার সমালোচনা করলেও বিভিন্ন সময় নদী ইজারা দেওয়ার খবর এসেছে গণমাধ্যমে।

নদীকে কখনও খাস জমি হিসেবে ইজারা দেওয়ার নিয়ম না থাকলেও  যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের রাধানগর গ্রামে ভায়না নদী আরএস পর্চায়  হয়ে ওঠে ধানি জমি।  আর এভাবে  ‘সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে’ খণ্ড খণ্ড করে মাছের ঘের ও চাষের জমি হয় ভায়না নদী।

জাতীয় বা স্থানীয়- কোনো ধরনের নির্বাচনে প্রার্থীর বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ থাকলে তাকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে  নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশনা দিয়েছিল হাই কোর্ট।

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার শাপলাপুর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী আবদুল খালেকের নাম পাওয়া যায় নদী রক্ষা কমিশনের দখলকারীদের তালিকায়। বাঁকখালী নদী দখলের কারণে তাকে নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে  নির্দেশ দেয়া হয় হাই কোর্ট থেকে, যা পরে  সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এসে স্থগিত হয়ে যায়।  আইনি বাঁধা কাটিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিতেও যান আওয়ামী লীগ সমর্থিত এই চেয়ারম্যান।

মানিকগঞ্জের সিংগাইরে ধলেশ্বরী নদীর জমি দখলদারদের তালিকায় মেলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এক সাংসদের নাম।

ঝিনাইদহ-২ আসনের সংসদ সদস্য তাহজিব আলম সিদ্দিকী প্রতিষ্ঠান মানিকগঞ্জ পাওয়ার জেনারেশনস লিমিটেডের দখলে ধলেশ্বরীর প্রায় সাড়ে ১১ একর জমি।

 

নদী পাড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ও জরিমানা

পতেঙ্গায় নদীর মোহনা থেকে শুরু করে মোহরা পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা আড়াই হাজার অবৈধ স্থাপনা গিলতে বসে চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলীকে। ২০১৬ সালে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ কর্ণফুলীর দুই তীরের স্থাপনা সরাতে ৯০ দিন সময় বেঁধে দিলেও দুই বছর পার করে তা নিয়ে চট্টগ্রাম প্রশাসনের হেলদুল দেখা যায় এ বছরই।

সুন্দরবনের অদূরে পশুর ও চুনকুড়ি নদীতে অবৈধভাবে এলপিজি প্লান্ট নির্মাণ করায় অ্যানার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে সেপ্টেম্বরে সাড়ে ১০ লাখ টাকা জরিমান করে খুলনার ভ্রাম্যমাণ আদালত।  

ডিসেম্বর থেকে দেশের ৬৪ জেলায় একযোগে অবৈধ দখলকার উচ্ছেদের অভিযান শুরু হলেও বছর জুড়ে তুরাগের বিভিন্ন অংশ পুনরুদ্ধারে সক্রিয় থেকেছে বিআইডব্লিউটিএ।

বছরের শুরুতেই আমিন অ্যান্ড মোমিন ডেভেলপমেন্টস লিমিটেডের কব্জা থেকে মাটি ভরাট করা তুরাগের একটি অংশ উদ্ধারের পর খনন করে ২৫ জুলাই তা নৌ চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। চ্যানেলটির  দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ হাজার ফুট, চওড়ায় ২৫০ থেকে ৪০০ ফুট।

ভরাট একটি চ্যানেল পুরোপুরি উদ্ধার করার ঘটনা ‘এই প্রথম’ বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম-পরিচালক এ কে এম আরিফ উদ্দিন।

ফেনী নদী

তিস্তার সঙ্গে আলোচনায় ফেনী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে একাধিক চুক্তি-প্রকল্প সই হলেও তিস্তা চুক্তিতে লাগেনি সুখবরের ঢেউ। এই নিয়ে রাজনীতি ও সোশাল মিডিয়ায় চলা সমালোচনাকে আরও জোরালো করে ফেনী নদী থেকে ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি ভারতের ত্রিপুরাকে দেওয়ার চুক্তি।

তবে ‘মানবিক’ দিক বিবেচনা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পাশাপাশি মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার এই অভিন্ন ছয় নদীর পানি বন্টনে যৌথ নদী কমিশনের কারিগরি পর্যায়ের কমিটির খসড়া  ‘ফ্রেমওয়ার্ক অব ইন্টেরিম এগ্রিমেন্ট’ করা নিয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মনোযোগী হওয়ার বিষয়টিও সামনে আসে।  

ফেনী নদীর উৎসমুখ নিয়ে দুই দেশের নদী গবেষকদের মধ্যেই দাবি রয়েছে। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমে স্থানীয় ও নদীকর্মীরা বারবার জানিয়ে আসছিলেন ফেনীর উৎসমুখ বাংলাদেশের ভেতরেই। গত অক্টোবরে ভারত সফর শেষে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এই নদীর উৎপত্তিস্থল খাগড়াছড়িতে।

বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে এক চুক্তিতে নৌ ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য গঙ্গা-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র দিয়ে কলকাতা-ঢাকা-গুয়াহাটি যাওয়ার জলপথ উন্মুক্ত হয়  এ বছর।

নদী ও জলাশয়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদে তুরাগ তীরের কামারপাড়া অংশে অভিযান।

নদী রক্ষায় শংকা তবুও

রাজধানীকে ঘিরে থাকা নদীগুলো ছাড়াও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী দখল ও দূষণমুক্ত করে নাব্য ফেরাতে গত এপ্রিলে একটি  ‘মহাপরিকল্পনার’ খসড়া চূড়ান্ত করে সরকার। ১০ বছরে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এর আওতায় শুরুতে এক বছরের মধ্যে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে।

নদী দখলকারীদের ফৌজদারি অপরাধের আওতায় এনে তাদের কঠোর শাস্তি দিতে আইনে সংশোধন আনার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে গত অগাস্টে বলেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার।

অন্যদিকে নদী দখলকারীর তথ্য দিলে তথ্যদাতাকে পুরস্কৃত করার ঘোষণাও দেয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়।

এদিকে বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযানে গিয়ে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের যেমন বাধার মুখে পড়েছেন তেমনি উচ্ছেদের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার দখল হওয়ার নজিরও রয়েছে।

ডিসেম্বরে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে উচ্ছেদ কার্যক্রমে টঙ্গীতে  দুপুরে উচ্ছেদের পর বিকালেই তুরাগ তীর দখল করে দোকানিদের ব্যবসা শুরু করতে দেখা যায়।

এসব মিলিয়ে সরকারের নদীর দখল উচ্ছেদ কাজকে ‘ক্রটিপূর্ণ’ বলেই মনে করছেন নদী ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর কর্মীরা। উচ্ছেদ হলেও এর প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না এমন অভিযোগ ছিল বছরের বিভিন্ন সময়েই। 

আরও পড়ুন