নগরের বাতাসে দূষণ ‘আতঙ্কজনক’ মাত্রায়

বাতাসে সর্বোচ্চ যে পরিমাণ ধুলো বা ক্ষতিকর উপাদান থাকলে তাকে সহনীয় পর্যায় বলা যায়, শীত মৌসুমে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ‘অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা’ ভাসছে দেশের প্রধান নগরীগুলোর বাতাসে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Jan 2017, 03:01 AM
Updated : 21 Jan 2017, 03:01 AM

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ‌্যে এবারই শীত মৌসুমে বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে দেখতে পাচ্ছেন তারা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়াউল হক জানান, বর্ষায় দেশের প্রধান শহরগুলোর বাতাস বেশ ভালো অবস্থায় থাকলেও শীতে বৃষ্টি না হওয়ায় এবং এই সময়েই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চাপ থাকে বলে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ওঠে।

“সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভাসমান ক্ষতিকর বস্তুকণা এখনকার বাতাসে বিরাজ করছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বড় শহরগুলোর মধ‌্যে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি রীতিমত আতঙ্কজনক।”

বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ যেখানে ১০০ পিপিএম পার হলেই বিপদজনক মাত্রায় বলে ধরা হয়, সেখানে গত বুধবার নারায়ণগঞ্জের বাতাসে এর পরিমাণ ছিল ৮২১ পিপিএম, গাজীপুরে ৪৪০ পিপিএম, ঢাকায় ৪১৬ পিপিএম, চট্টগ্রাম ও বরিশালে ৩৫০ পিপিএম।

এর ফলে শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে ঠাণ্ডাজনিত রোগ, শ্বাসনালীর ক্ষতসহ নানা ধরেন মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে শিশু ও বয়স্কদের।

মারাত্মক এই বায়ু দূষণে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি এড়াতে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বায়ুমান

বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এককে। এসব বস্তুকণাকে ১০ মাইক্রোমিটার ও ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস শ্রেণিতে ভাগ করে তার পরিমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করেন গবেষকরা।

> বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ু মানের সূচকে (একিউআই) ‘ভালো’ বলা যায়।

>> এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে ‘মধ্যম’ মানের এবং ১০১-১৫০ হলে ‘বিপদসীমায়’ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

>>> আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১-৩০০ হলে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৩০১-৫০০ হলে ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ‌্যকর’ বলা হয়।

নগরচিত্র

পরিবেশ অধিদপ্তরের নিমর্ল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট-সিএএসই) প্রকল্প পাঁচ বছর ধরে প্রতিদিনের বায়ুমানের তথ‌্য প্রকাশ করে আসছে।

ঢাকার তিনটি, চট্টগ্রামের দুটি পয়েন্টসহ আট নগরীর বাতাসে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস পর্যন্ত অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ নিয়মিত পরিমাপ করা হচ্ছে ‘সিএএসই’ প্রকল্পের মাধ্যমে। 

বাতাসে বস্তুকণা ছাড়াও কার্বন মনো-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, ওজোন, সালফার ডাই অক্সাইডের মাত্রাও পরিমাপ করা হচ্ছে সিএএসই প্রকল্পে।

সিএএসই প্রকল্পের তথ‌্যে দেখা যায়, শীত মৌসুমে দেশের প্রধান নগরগুলোতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ থাকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বা তারচেয়েও খারাপ মাত্রায়।

সিএএসই প্রকল্পের পরিচালক এস এম মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, “আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এ বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীর বাতাসের মান অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। শীতের এ সময়ে শহর এলাকায় এমনিতেই বাতাসের মান খারাপ থাকে। তবে এবার আগের চেয়ে বেশি খারাপ যাচ্ছে।”

 

পাঁচ কারণ

মঞ্জুরুল হান্নান খান বলছেন, শুকনো মৌসুমে এমনিতেই ধুলা বেশি থাকে। কিন্তু শহর এলাকায় পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে মনুষ‌্যসৃষ্ট কারণে। যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে বড় বড় নির্মাণ কাজ চলায় রাজধানীর সর্বত্রই এখন ধুলা।

“শীতের সময় বৃষ্টি থাকে না; তার সঙ্গে নির্মাণ কাজ চলছে পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা না রেখেই। অননুমোদিত ইটভাটাও চলছে বিভিন্ন এলাকায়। রাস্তায় মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়া যানবাহন চলাচলও বন্ধ হচ্ছে না। সব মিলিয়েই বায়ু দূষণ দিনদিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”

বায়ুমান ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ইটভাটা, নির্মাণ কাজ, যাবনাহন, শিল্পকারখানা ও বালুমহাল- এ পাঁচটি বিষয় বায়ুদূষণে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে।

ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ, মোটরযান আইন, ইমারত নির্মাণ আইন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এ ধরনের দূষণের জন্য সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমনা, সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড বা উভয়দণ্ডের বিধান রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে এ আইন প্রয়োগ করা হলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।

“কিন্তু সমন্বিত উদ্যোগ থাকলে বায়ুদূষণ সহনীয় মাত্রায় আনা সম্ভব। রাস্তাঘাটে নিয়ন্ত্রণহীন খোঁড়খুঁড়ি ও অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ বন্ধের পাশাপাশি জনসচেতনতা সৃষ্টি করলে ফল পাওয়া যাবে।”

স্বাস্থ‌্য ঝুঁকি কমাতে ঘরে-বাইরে মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলতে অনুরোধ করেন জিয়াউল হক।

নারায়ণগঞ্জের রাধানগর এলাকার ইটভাটা থেকে বাতাসে মিশছে কালো ধোঁয়া। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

চাই ৫ উদ্যোগ

মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, বাতাসে ক্ষতিকর বস্তুকণা থাকবে, তবে তা সহনীয় মাত্রায় রাখার চেষ্টা নিতে হবে। সেজন‌্য এখনই অন্তত পাঁচটি বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

১. নগরের আশপাশে গড়ে ওঠা অবৈধ ইটভাট বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা নির্মাণে জোর দিতে হবে।

২. অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে খুঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে সকাল-দুপুর-বিকালে অন্তত তিন দফা নির্মাণাধীন রাস্তাঘাটে পানি ছিটাতে হবে।

৩. প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন রাস্তায় বালি, মাটিসহ নানা ধরনের সামগ্রী পরিবহনের সময় মালামাল ঢেকে স্থানান্তর করা প্রয়োজন।

৪. দশ থেকে ২০ বছরের পুরনো যানবহনের দূষিত ধোঁয়া বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

৫. পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি বিআরটিএ, পুলিশ-প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনকে আইনভঙ্গের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে আরও উদ‌্যোগী হতে হবে।

বায়ু দূষণ রোধে করণীয় নির্ধারণে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, পুলিশ, বিআরটিএসহ জড়িতদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।

মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, “প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানাসহ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তা আরও কঠোর করা হবে।”

স্বাস্থ‌্য ঝুঁকি কতটা?

‘ক্লিন ঢাকা গ্রিন ঢাকা’ ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠানে গত বুধবার ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক জানান, ১০ জন চিকিৎসককে দিয়ে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, ঢাকার বাতাস এত দূষিত যে, ২৫ শতাংশ শিশু এবং ৫০ শতাংশ মানুষ ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছেন।

গতবছর একই সমস‌্যা নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ হাসপাতালের চিকিৎসক মাহবুবা আক্তার আরজু সে সময় বলেছিলেন, তাদের কাছে যে প্রবীণ রোগীরা শীত মৌসুমে আসেন, তাদের অধিকাংশের সমস্যা শ্বাসকষ্টজনিত।

“হাঁচি-কাশি নিয়ে রোগী আসছে হরদম। কমন কোল্ড, সাইনোসাইটিস, গলাব্যথা, অ্যাজমা-অ্যালার্জি, শ্বাসতন্ত্রে ক্ষতসহ নানা ধরনের রোগী আসছে আমাদের এখানে। বায়ু দূষণ এর বড় কারণ।”

তিনি বলেন, বয়স্কদের মতো শিশুরাও বায়ু দূষণের কারণে নানা অসুস্থতায় ভুগছে। ‘সিজনাল ডাস্টের’ কারণে শীত মৌসুমে এ ধরনের রোগীই বেশি আসে।

নগরের বায়ু দূষণ নিয়ে কারও দ্বিমত না থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্তর এ নিয়ে আরও সমীক্ষার উদ্যোগ চায়।

মঞ্জুরুল হান্নান খান জানান, বায়ু দূষণের কারণে জনস্বাস্থ্যে কী পরিমাণ নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তার সমীক্ষার একটি প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

“আমরা বিভিন্ন সংস্থার কাছে নানা ধরনের তথ্য পাই। কিন্তু এতো ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে যে তা নিরুপণ করার জন্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি আলাদা সমীক্ষা করা জরুরি। অনুমোদন পেলে তা শিগগির শুরু হতে পারে।”

আরও পড়ুন