সীতাকুণ্ড উপকূলজুড়ে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার পরও পরিত্যক্ত জাহাজ কাটার ক্ষেত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ‘পরিবেশগত ছাড়পত্রের’ তোয়াক্কা করছেন না মালিকরা।
Published : 07 Nov 2016, 10:22 AM
শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে জাহাজ কাটার অনুমতি মেলার পর পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এ ধরনের ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও মালিকরা তা মানছেন না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। নিয়ম না মানা ইয়ার্ড মালিকদের বিরুদ্ধে তারা ব্যবস্থা নেবেন।
সীতাকুণ্ডের মাদাম বিবির হাট, কুমিরা, ভাটিয়ারি, সোনাইছড়ি, জাহানাবাদ, কদমরসূল, বাঁশবাড়িয়া উপকূলজুড়ে চালু থাকা ৬০টি ইয়ার্ডে এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কাটার জন্য এসেছে ১৯০টি পরিত্যক্ত জাহাজ।
এর মধ্যে মাত্র ১২টি জাহাজের জন্য মালিকরা পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন করেছেন বলে পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিদর্শক হারুনুর রশিদ খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বাংলাদেশের জলসীমায় পরিত্যক্ত জাহাজ আসার পর বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি প্রতিবেদন দিলে শিল্প মন্ত্রণালয় তা কাটার অনুমতি দেয়।
এরপর ইয়ার্ডে থাকা জাহাজ কাটা শুরুর আগে ‘বিপজ্জনক বর্জ্য ও জাহাজ ভাঙা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১১’ এর ১৯ (১) বিধি অনুযায়ী পরিবেশগত ছাড়পত্র নিতে হয়।
পরিত্যক্ত জাহাজের রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া এবং বর্জ্য, বিশেষ করে অ্যাজবেস্টস, গ্লাসহোল, লুব্রিক্যন্ট ওয়েলসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত বিবরণ ওই ছাড়পত্রের আবেদনে উল্লেখ করতে হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত দশ মাসে মাত্র ১২টি জাহাজের জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র চাওয়া হয়েছে। বাকিরা নিয়মের তোয়াক্কা না করে জাহাজ ভাঙ্গা শুরু করেছে। পরিবেশ ছাড়পত্রের আবেদন না করেই এসব জাহাজের কোনটি পুরোপুরি, কোনটির ২০ থেকে ৮০ শতাংশ কেটে ফেলা হয়েছে বলে আমরা খবর পেয়েছি।”
ওই কর্মকর্তা বলেন, ইয়ার্ড মালিকরা শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ভাঙার অনুমতি পেলে আর পরিবেশ ছাড়পত্রের তোয়াক্কা করেন না।
“অথচ আমদের পক্ষ থেকে ইয়ার্ড মালিকদের জাহাজ ভাঙার আগে নিয়ম মেনে ছাড়পত্রের আবেদন করতে চিঠি দেওয়া হয়।”
আটকে আছে আইন
# ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ, দূষণ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার অভাবের কারণে বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা শিল্প নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নেতিবাচক শিরোনাম হওয়ায় গত বছর ‘বাংলাদেশ জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ আইন’ শিরোনামে একটি আইন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। সেই খসড়া এখনও বিল আকারে সংসদে ওঠেনি।
# এ আইনের আওতায় ‘জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ বোর্ড’ গঠনের কথা খসড়ায় বলা হয়, যে বোর্ড ইয়ার্ড স্থাপনের অনুমতি দেবে, রিসাইক্লিং ফ্যাসালিটি প্ল্যান তৈরি করবে। শ্রমিক নিরাপত্তা ও স্বার্থ সংরক্ষণ, দূষণ রোধ ও পরিবেশের বিষয়গুলো দেখবে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃত মান নিশ্চিত করতে পরিবেক্ষণ করবে।
# পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য জাহাজ আমদানিতে মিথ্যা তথ্য দিলে ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা, বা ছয় মাসের কারাদণ্ড; বোর্ডের অনুমতি ছাড়া ইয়ার্ড নির্মাণ করলে ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা জরিমানা, বা এক বছরের কারাদণ্ড এবং বোর্ডের কর্মকর্তাদের পরিদর্শনের সময় কেউ যদি ‘যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া’ সহযোগিতা না করে, সেক্ষেত্রে ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদণ্ডের কথা বলা হয় খসড়া আইনে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মাসুদ করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিপজ্জনক বর্জ্য ও জাহাজভাঙ্গা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা অনুযায়ী পরিত্যক্ত জাহাজ ভাঙ্গার আগে ইয়ার্ড মালিককে অবশ্যই পরিবেশ ছাড়পত্র নিতে হবে।
“কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছি।”
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) অর্ন্তভুক্ত একটি ইয়ার্ডের মালিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জাহাজ পরিদর্শনের সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন প্রতিনিধিও থাকেন। তাদের সমন্বিত প্রতিবেদনের পর এটি শিল্প মন্ত্রণালয় কাটার অনুমতি দেয়। সুতরাং আলাদা করে পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করেন না।
আরেক ইয়ার্ড মালিক দাবি করেন, গত দুই বছরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ড নিয়ে ‘নেতিবাচক আলোচনার’ পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। এখন আগের চেয়ে ‘নিরাপদ’ পরিবেশে এবং শ্রমিকদের ‘ঝুঁকি কমিয়ে’ জাহাজ কাটা হয়। জাহাজের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছে। এ কারণে মালিকরা আর পরিবেশ ছাড়পত্রের ‘ঝামেলা’ নিতে চান না।
জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প
>> বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ইস্পাতের চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশের জোগান দেওয়া হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে। এই ব্যবসার আকার প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ২০১১ মাসের মার্চে সরকার জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা ও জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণকে শিল্প ঘোষণা করে।
>> তবে গত কয়েক বছরে চীনের সস্তা স্টিলের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে মার খেয়েছে স্ক্র্যাপ লোহার ব্যবসা। ভারত ও পাকিস্তানের জাহাজ ভাঙা শিল্প অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ২০১০ সালে যেখানে দেড়শর বেশি ইয়ার্ড ছিল, এখন তা নেমে এসেছে এক তৃতীয়াংশে।
আর্ন্তজাতিক কোম্পানি ‘মায়ের্সক’ এর এই অয়েল ট্যাংকারটি দ্বিতীয়পক্ষের হাত ঘুরে ‘প্রডিউসার’ নাম নিয়ে বাংলাদেশে এসেছে।
সব নিয়ম মেনে অনুমতি শেষে জাহাজটি কাটার জন্য ইয়ার্ডে আনা হয়েছে বলে মালিকপক্ষ দাবি করলেও ডেনিশ গণমাধ্যম বলছে, বাংলাদেশের ইয়ার্ডে সেই ‘অনিরাপদ পরিবেশেই’ জাহাজটি কাটা হচ্ছে।
ডেনিশ গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, জাহাজটি বিক্রি বা ভাঙার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইন ও আর্ন্তজাতিক মানদণ্ড রক্ষা করা হচ্ছে না। তাছাড়া ওই জাহাজে ‘বিষাক্ত বর্জ্য’ রয়েছে যা পরিবেশ ও শ্রমিকদের ঝুঁকিতে ফেলছে।
এ অভিযোগ ওঠার পর পরিবেশ অধিদপ্তর জাহাজটিতে তেজস্ক্রিয় বর্জ্য আছে কি না তা পরীক্ষার জন্য শনিবার সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে।
তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলার পাশাপাশি জাহাজটি কাটা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।