হুমায়ুন ফরীদি, বিরল গুণের সেই মানুষটি

আমরা যখন আটের দশকে লেখালেখি শুরু করছি তখনই হুমায়ুন ফরীদি লেখক না হওয়া সত্ত্বেও তার নাম এবং খ্যাতির উত্তাপ টের পাচ্ছিলাম। প্রথমত তাঁর অনবদ্য অভিনয়ের কারণে তো বটেই, দ্বিতীয়ত তাঁর সাহিত্য-মুগ্ধ চরিত্রের কারণে। বন্ধুবান্ধব এবং বয়োজেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে যারা তাকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন তাদের কাছে শুনেছিলাম তিনি দেশি বিদেশি সাহিত্যের নিবিড় পাঠক।

রাজু আলাউদ্দিনরাজু আলাউদ্দিনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 May 2013, 10:51 AM
Updated : 29 May 2013, 10:51 AM

তাছাড়া বড় বড় লেখকদের অনেকেই তখন তার বন্ধু। ফলে শিল্পের অন্য ঘরের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের কবিতাকর্মীদের আত্মীয়। তখনই শুনেছি, আমার প্রিয় কবি টেড হিউস ও সিলভিয়া প্লাথেরও অনুরাগী পাঠক তিনি। একজন অভিনেতা কবিতার পাঠক তো হতেই পারেন। কিন্তু আমারই প্রিয় কবিদের অসংখ্য কবিতা নাকি তার মুখস্থ।–এটা ছিলো তার প্রতি আমাকে কৌতূহলী করে তোলার জন্য একটা বড় ব্যাপার ।

এই তথ্যটা বেড়ালের রোমশ শরীরে আদর বুলিয়ে দেয়ার মতো এক অপত্যস্নেহের অনুভূতি এনে দিয়েছিলো। এই মানুষটির জন্য তখনই আমার কৌতূহল ও স্মৃতিকাতরতা তৈরি হয়ে গিয়েছিলো।

‘স্মৃতিকাতরতা’ শব্দটি দেখে কেউ যেন ভেবে না বসেন এর অর্থ না জেনেই আমি ব্যবহার করেছি। যাকে চিনি জানি তাকে নিয়েই কেবল স্মৃতি থাকতে পারে। আর স্মৃতি থাকলে তার জন্য কাতরতাও সম্ভব। তার সঙ্গে আমার এর কিছুই ছিলো না, তাহলে স্মৃতিকারতা কেন? এর কারণ তার সম্পর্কে জানাশোনা থেকেই মনে হয়েছিলো তিনি আমার দূরের কেউ নন।

কবিতা যিনি ভালোবাসেন তিনি তো আমার আত্মীয় হয়েই আছেন কবিতার সূত্রে। সেই কারণেই না দেখা এই মানুষটির জন্য আমার স্মৃতিকারতা তৈরি হয়েছিলো।

কিন্তু তবু সত্যি সত্যি তাকে দেখা হয়নি বহু বছর। সব সময়ই ভেবেছি: একই শহরে যেহেতু আছি, একদিন না একদিন দেখা হবেই। কিন্তু হয়নি। দেশের বাইরে যা্ওয়ার কয়েক বছর আগে থেকেই শুনছিলাম তিনি সিনেমায় অভিনয় করতে শুরু করেছেন।  এর ফলে তার সাথে সত্যি সত্যি দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হতে থাকলো। এদিকে সিনেমায় তার ব্যস্ততা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছিলো।

অন্যদিকে আমারও ব্যস্ততা বাড়ছিলো। এর ফলে পারস্পরিক ব্যস্ততা আমাদের সাক্ষাতের সম্ভাবনাকে আরও দূর-অস্ত করে দিয়েছিলো। এরপর ৯৯ সালে দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় সেই সম্ভাবনারও অপমৃত্যু ঘটে।

২০১০ সালে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম-এ যোগ দেয়ার পর আমি চাচ্ছিলাম হুমায়ুন ফরীদিকে দিয়ে কিছু লেখাতে। এরকম একজন সাহিত্য-মুগ্ধ মানুষ লিখলে নিশ্চয়ই ভালো করবেন।

দেখা করার সপ্তাখানেক আগে তাঁকে বলেছিলাম আমি তার সাথে দেখা করতে চাই। তিনি বললেন, আস একদিন বিকেলবেলা, চলে আস। আচ্ছা, দাড়াও, এই সপ্তায় না, পরের সপ্তায় আস। এমনিই দেখা করতে আসবা নাকি কথাবার্তা বলতে চাও?

আমি বললাম, দুটোই। আপনাকে দেখার ইচ্ছে বহুদিন থেকেই। আপনার সম্পর্কে সেই ছোটবেলা থেকেই এত শুনে আসছি যে আপনাকে না দেখে মরাটা ঠিক হবে না। উনি আমার রসিকতায় খ্যাস খ্যাসে গলায় হাসলেন একটু। ওনার হাসিটা শেষ হতে না হতেই বললাম, শুনেছি আমার কোন কোন প্রিয় কবির অনেক কবিতা নাকি আপনার মুখস্ত। উনি মৃদু আপত্তি করে বললেন, বাড়িয়ে বলেছে কেউ । তুমি কি কবিতা লেখ? কম লিখি। তবে আপনি যাদের কবিতা পছন্দ করেন তাদের কারোর কারোর কবিতা অনুবাদ করেছি, যেমন ঢেউ হিউজ। তাই নাকি? ওর কবিতা এক সময় খুব পড়েছি। আস, তোমার সাথে আড্ডা হবে।

দেখা করার আর আড্ডা দেয়ার এই সুযোগটা শেষতক এলো ২০১১ সালের ১৭ মার্চে। তখন ক্রিকেট খেলা চলছে । কথা হচ্ছিলো ক্রিকেট নিয়ে। শুনেছি তিনি ক্রিকেটের পাগল। আড্ডার এক ফাঁকে তাকে বললাম ক্রিকেট নিয়ে কিছু বলার জন্য। তার সেই কথাগুলো মতামত-বিশ্লেষণ বিভাগে ’হেরেও আমরা ভালো খেলেছি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিলো। আমাদের কলিগ হাসান বিপুল তার কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে  চমৎকার কিছু ছবি তুলেছিলেন। বিপুলকে বললাম, ফরীদি ভাইয়ের সাথে আমার একটা ছবি তুলতে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়িয়ে আমার পাশে এসে দাড়ালেন।

এরপর আরও একবার তার সাথে দেখা করেছিলাম সড়ক দুর্ঘটনায় চলচিত্রকার তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনীরের মর্মান্তিক মৃত্যুবরণের সময়।

র্দুঘটনার দিনই তাকে ফোন করে বললাম, ফরীদি ভাই, দুর্ঘটনার কথা তো বোধ হয় শুনেছেন। আপনার মন্তব্য নিতে চাই। আসবো আজকে? আস। কখন আসবো? চারটা সাড়ে চারটার দিকে চলে আস। আমি একাই গিয়েই হাজির হয়েছিলাম তার বাসায়। নিজেই দরজা খুলে দিলেন। তিনি বেশ বিমর্ষ। তারেক-মিশুর এই আকস্মিক মৃত্যু তাকে এতটাই বিরক্ত, ক্রুদ্ধ করে তুলেছিলো যে তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সৌজন্যমূলক প্রসন্নতাকে কোনভাবেই ফিরিয়ে আনতে পারছিলেন না। তার বিরক্তি, ক্রোধ পাঠক দেখতে পাবেন মতামত বিশ্লেষণ বিভাগে প্রকাশিত ’দেশটা ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে’ শিরোনামে তার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে। প্রতিক্রিয়াটি খুব দীর্ঘ ছিলো না। কিন্তু যা বলছিলেন তা এত গোছানো এবং স্বতঃস্ফূর্ত ছিলো যে তা প্রকাশের সময় কোন রকম সম্পাদনার দরকার হয়নি। সেদিন তার মানসিক অবস্থা আড্ডা দেয়ার মতো ছিলো না বলে আমি আর অন্য কোন প্রসঙ্গ না তুলে বিদায় নিয়ে চলে আসি।

নানান জনের কাছ থেকেই শুনে আসছিলাম তিনি অতিরিক্ত মদ্যপান করেন। সেই কারণেই নাকি সুবর্ণার সঙ্গে তার ছাড়াছাড়িও হয়েছে। কয়েক বছর ধরেই তিনি ছিলেন একা। খ্যাতির শীর্ষে থাকা মানুষদের সম্পর্কে অনেক রকম কথাবার্তা, গুজব শোনা যায়। ফরীদি ভাই সম্পর্কে সে রকম গুজব আমার কানে আসেনি কখনো। অসততা, দুর্বৃত্তপনা, অবৈধ সুবিধা নিয়ে বিত্তের আয়তন বাড়ানো তো আমাদের সমাজে একটা স্বাভাবিক ঘটনা। আশ্চর্য, এগুলোর সাথে তার সংশ্লিষ্টতার কোন গুজব কখনো শুনা যায়নি। পরিচ্ছন্ন স্নিগ্ধ এবং রুচিশীল ব্যক্তিত্ব বলতে যা বুঝায় তিনি ছিলেন তাই। খ্যাতির প্রভাব ও সুবিধা দিয়েও অনেকে সরকারি বা বেসরকারি নানান প্রসাদ ও প্রাসাদ বাগিয়ে নেন-সেরকমও কখনো শুনিনি তার সম্পর্কে।

তাকে একবার বলেছিলাম চলচ্চিত্রের যে মান তার সঙ্গে তো আপনার মেলার কথা না। তিনি পরিস্কার বুঝতে পারছিলেন আমি কী বলতে চাইছি। তিনি বললেন, দেখ, অভিনয় ছাড়া তো আমি আর কিছু জানি না। অভিনব করে সিনেমা থেকে যে টাকা পাই সেটা কি আমাকে অন্য কেউ দেবে? জানি এর উত্তর নেই আমার কাছে। নিজেকেই তখন মনে মনে বলেছিলাম, হতে পারে মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রে অভিনয় করেননি কিন্তু তাই বলে তার অভিনয়ের মানতো নামিয়ে ফেলেননি কখনো। নাটকে ফরীদির অভিনয়ের স্বাতন্ত্র ও মান তো একইভাবে চলচ্চিত্রেও বজায় রেখেছিলেন। অবিস্মরণীয় এই বিরল গুণের মানুষটির জন্মদিনে আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই ।