ইভিএমের অনুশীলন ভোটে সাড়া ছিল না

পদ্ধতি জানাতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) অনুশীলন ভোটের আয়োজন নির্বাচন কমিশন করলেও তাতে নগরবাসীর তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Jan 2020, 04:51 PM
Updated : 30 Jan 2020, 04:51 PM

বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সব কেন্দ্রে ভোটিং মেশিন নিয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তারা অপেক্ষা করলেও ভোটারের উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা।

দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত ২৫টি কেন্দ্রে ঘুরে পাওয়া গেছে এমন চিত্র; তবে ভোট যারা দিয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতা সুখকরই পাওয়া গেছে।

একটি কেন্দ্রে ‘মক ভোটিং’ দেখতে গিয়ে মানুষের উপস্থিতি নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে তিনি বলেন, “আমি একজন নতুন ভোটার। আমি কখনও ইভিএমে ভোট দিইনি। আমি কর্মকর্তাদের সাথে নতুন ভোটারের মতো কথা বলেছি। একটা ইউনিটে তারা ১২টায় এসেছেন।

“৩ ঘণ্টায় মাত্র ১ জনকে তারা শেখাতে পেরেছেন, ১ জনের মাত্র ভোট নিয়েছেন। এটার উপরে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।”

কমলাপুর ও কাকরাইলে দুটি কেন্দ্র ঘুরে এভিএমে ‘মক ভোট’ দিতে ভোটারদের চোখে পড়েনি। নির্বাচন কর্মকর্তারা বলছেন, হয়তো অনেকে মগ ভোট দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীন কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজ একটি কেন্দ্র।

দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ১৬৪০ ভোটারের এ কেন্দ্রে মাত্র দুইজন মক ভোট দিয়েছেন বলে প্রিজাইডিং অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্কুলে সরস্বতী পূজা চলছে, আমরা দুপুর ১২টায় এসে পূজার মাইকে মক ভোট নেওয়ার বিষয়ে ঘোষণা করি। এরপর এক পরিবারের চারজন এসেছিলেন, তাদের মধ্যে দুইজন ভোট দিয়েছেন।"

কেন্দ্রে মক ভোট দেওয়ার বিষয়ে ভোটার কোনো অনাগ্রহ আছে কিনা, প্রশ্ন করা হলে প্রিজাইডিং অফিসার বলেন, “কাকরাইলে এ কেন্দ্রটি একটি কমার্শিয়াল এলাকার মধ্যে পড়েছে, ভোটাদের অধিকাংশ শিক্ষিত, যে কারণে তারা বইপত্র পড়েই ইভিএমে ভোট দেওয়ার বিষয়ে জেনে গেছেন। হয়ত সে কারণে কেন্দ্রে আসছেন না।"

সিটি ভোটের আগে ভোটারদের জানা-বোঝার জন্য ঢাকার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে বৃহস্পতিবার ইভিএমের মাধ্যমে মক ভোটের আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। মিরপুরের মণিপুর হাই স্কুলে ইভিএমে ভোটদান পদ্ধতি দেখছেন কয়েকজন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

পরে এই কেন্দ্রে বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করেও আর কোনো ভোটারদের দেখা মেলেনি।

এর আগে কমলাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুর সাড়ে ১২টায় গিয়ে দেখা যায়, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনরত কর্মকর্তারা ইভিএমের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি গোছগাছ করছেন। তবে কোনো ভোটারদের সেখানে পাওয়া যায়নি।

এই কেন্দ্রের নির্বাচনী এক কর্মকর্তা জানান, তারা কেবল ১২টায় এসেছেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা সেখানে থেকে ভোটারদের জন্য অপেক্ষা করবেন। তখন হয়ত ভোটারা মক ভোট দিতে আসবেন।

সরকারী তিতুমীর কলেজের চারটি কেন্দ্রে চোখে পড়ার মতো ভোটার উপস্থিতি ছিল না।

এ কেন্দ্রের পোলিং অফিসার শওগাতুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "শুরুর দিকে মোটামুটি লোকজন আসত, আস্তে আস্তে সাড়া কমছে। কিভাবে ভোট দিতে হয় তা আমরা তাদেরকে শেখাচ্ছি। তারা বুঝতে পারছে। এ পদ্ধতিতে ভোট দিতে তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে।"

তিতুমীর কলেজে অনুশীলনমূলক ভোট দিতে আসা ভোটার সুভা দাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ভোটের ট্রায়াল দিতে আসলাম। বুঝতে পারছি কিভাবে ভোট দিতে হবে। পদ্ধতিটা সহজই মনে হচ্ছে।"

ইভিএম পদ্ধতিতে আস্থার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

মহাখালীর টিএন্ডটি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে ২টি ও আরেকটিতে ৬টি ভোট পড়েছে। অন্য একটি কেন্দ্রে কোন ভোটই পড়েনি।

কেন্দ্রে সুনসান নীরবতা চলার কথা জানান পোলিং অফিসার সরওয়াত সুলতানা। "ভোটার আসেনি তেমন। দুই একজন আসছিল," বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।

টিএন্ডটি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ভোট দিতে আসা শিক্ষার্থী রুবাবা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "দিন দিন প্রযুক্তির উন্নয়ন হচ্ছে। ভোটের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার করাটা ঠিকই আছে।

“ভোট দেওয়া শিখলাম, এ পদ্ধতিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। মানুষ ভুল করলেও ডিভাইস ভুল করবে না। আগের মতো ভোট জালিয়াতি হবে না আশা করছি। তারপরও যদি জালিয়াতি হয় তাহলে তো আর পদ্ধতির দোষ না, দোষ মানুষের।"

মহাখালী মডেল হাইস্কুলে গিয়ে চোখে পড়েনি কোনো ভোটার।

ভোটারের জন্য অপেক্ষা করার কথা জানিয়ে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মাজহারুল ইসলাম হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "দুপুর থেকে বসে আছি; এখনও কোনো ভোটার আসেনি। ভোটারের কোনো আগ্রহ দেখছি না।"

মহাখালী আব্দুল হামিদ দর্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইটি কেন্দ্রের একটিতে চারটি ও আরেকটিতে কোন ভোটই পড়েনি।

সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "ভোটার কম। যারা আসছে তারা বয়স্ক ব্যক্তি, যাদের বিভিন্ন সময়ে ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে৷ এখনও পর্যন্ত কোনো তরুণ ভোটার আসেনি।"

অনুশীলনে ভোটার উপস্থিতি কম ছিল বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। এ স্কুলের তিনটি কেন্দ্রের একটিতে একজন ও অন্য দুটিতে তিন ও পাঁচজন ভোটার এসেছেন ভোটের মহড়ায়।

এর আগে মঙ্গলবার ভোটারদের জানা-বোঝার জন্য ঢাকার বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ইভিএম প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল নির্বাচন কমিশন।

বৃহস্পতিবার বেলা ১২টা থেকে বেলা ২টা পর‌্যন্ত সবুজবাগের দুটি কেন্দ্রের কোনো বুথে কোনো ভোটার মহড়ায় অংশ নিতে আসেননি।

ওই এলাকার কমলাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে দুইটি (১১৩ ও ১১৪) ভোটকেন্দ্র। ১১৩ নম্বর ভোটকেন্দ্রের ৭টি ইভিএম বুথে পুরুষ ভোটাররা আর ১১৪’র  ৮টি ইভিএম-এ নারী ভোটাররা ভোট দিবেন।

১১৩ নম্বর কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ হাজার ২৮৬ জন। আর ১১৪ তে মোট ভোটার ২৭৬৯ জন।

ঘণ্টা দুই অপেক্ষা করে দেখা গেছে, প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসাররা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে।

১১৩ নম্বর ভোটকেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার রাজিব কুমার সাহা বিডিনিউজটোয়েন্টিফার ডটকমকে বলেন, “বেলা ১২টা থেকে মক ভোটিং শুরু হওয়ার কথা থাকলেও আমরা সাড়ে ১১টা থেকে সব সেট করে বসে আছি। এখন দুইটা বাজতে চললো কোনো ভোটার ভোটার আসেননি।

তিনি বলেন, “প্রার্থী, প্রার্থীর কর্মী যারা মক ভোটিং দেখতে এসেছিলেন তাদের বলেছিলাম ভোটারদের পাঠাতে। কিন্তু এখন পর‌্যন্ত কেউ আসেননি। এই কেন্দ্রের সবাই নারী ভোটার।”

তবে সাড়ে বেলা ৩টার দিকে ১১৪ নম্বর ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ৩ হাজার ২৮৬ ভোটারের মধ্যে ৯জন ভোটার মহড়ায় অংশ নিয়েছেন।

এই প্রথম ইভিএম-এ ভোট দিতে যাচ্ছেন সবুজবাগের মায়াকানন এলাকার তরুণ ভোটার মাসুদ আকাশ। মক ভোটিংয়ে অংশ নেওয়ার পর তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ইভিএম-এ ভোট কেমন লেগেছে।

আকাশ বললেন, খুবই সহজ। তবে আজকে যেমন খোলা জায়গায় ভোট প্র্যাকটিস হচ্ছে, ভোটের দিন যেন এমনটা না থাকে। জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারিনি। আশা করি এবার পারবো। 

এ কেন্দ্রের প্রিজিইডিং অফিসার মোতাহার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসলে মক ভোটের জন্য আরও  প্রচারণার দরকার ছিল।” 

দুপুর ৫টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজ ভোট কেন্দ্রে গিয়ে নির্বাচনী দায়িত্বে কর্মকর্তাদের থেকে জানা যায়, এই কেন্দ্রের মোট ভোটার সংখ্যা ২৩১৩ জন। সকাল থেকে অনেকেই ভোটকেন্দ্রে আসলেও এদের অনেকেই ভোটার না হওয়ায় ভোট কাস্ট হয়েছে তখন পর‌্যন্ত ৮ জনের।

এর কিছুক্ষণ পরেই সেখানে ডেমো ভোট দিতে আসেন ওই কেন্দ্রের ভোটার রেহেনা পারভীন। নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা সেখানে পঞ্চাশোর্ধ এই মহিলাকে এভিএমে ভোট প্রদানে নির্দেশনাগুলো বুঝিয়ে দেন।

রেহেনা পারভীন পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এর আগে আমি কখনো ইভিএমে ভোট দেইনি। আজকে ইভিএমে ভোট দিয়ে তুলনামূলকভাবে সহজই মনে হল। এর আগে কালি লাগাও, ব্যালট নাও, ভাঁজ করো- এর থেকে খুব সহজ মনে হলো। তবে আমাদের মুরব্বীদের জন্য কিছুটা কঠিন হবে। তবে দায়িত্বরতরা বুঝিয়ে বললে সহজ এটা আগের পদ্ধতির চেয়ে অনেক সহজ এবং দ্রুত হবে।’’

মিরপুর রূপনগর আবাসিক এলাকার কেন্দ্র রুপনগর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে কেন্দ্রে অনুশীলন ভোটে মাত্র কয়েকজন ভোটারের উপস্থিতি দেখা গেছে।

অনুশীলন ভোট দিতে আসা নূরুল করিম কাজল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এর আগে তিনি কখনো ইভিএম মেশিনে ভোট দেন নি বলে এই মেশিনে কীভাবে ভোট দিতে হবে জানার কৌতূহল থেকে তিনি অনুশীলন ভোট দিতে এসেছেন।

ভোট দেওয়ার পর কেমন লাগলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ইভিএম মেশিনে ভোট দেওয়া আমার কাছে সহজই মনে হয়েছে। কোনও কাগজপত্র ছাড়া শুধুমাত্র আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ভোট দিতে পারাই আমার কাছে সহজ মনে হয়েছে।”

জাহিদ পাটোয়ারি নামের আরেক ভোটার মক ভোট দিয়ে জানতে চাইলে বলেন, “দেখতে এসেছি কীভাবে ভোট দিতে হয়। এই প্রক্রিয়াকে আমার কাছে স্বচ্ছ মনে হয়েছে। তবে অদৃশ্য কোনও কারসাজি আছে কীনা তা বিজ্ঞজনদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে।”

ভোট কেন্দ্রে ৩০ মিনিটের বেশি অপেক্ষার পরও আর কেউ ভোট দিতে আসতে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, “সরকার বিটিভির মাধ্যমে মক ভোটের জন্য অনেক প্রচার চালাচ্ছে।”

এই প্রচার যথেষ্ট ছিল কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষকেও সচেতন হওয়া উচিত।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার সময় পুরান ঢাকার বদরুন্নেসা কলেজে ইভিএম মহড়া দেখতে গিয়ে দেখা যায়।

সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও অন্যান্যরা ইভিএম এর যন্ত্র গুটিয়ে ফেলছেন।

সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মোট ৭৫জন ভোটের মহড়া দিতে এসেছিলেন।

উপস্থিতি কম হওয়ার কার দেখিয়ে তিনি বলেন, টেলিভিশনে দেখাচ্ছে; এছাড়া জাতীয় নির্বাচনে অনেকে ভোট দিয়েছেন তাই উপস্থিতি কম।

চকবাজার থানার ওসি মওদুদ হাওলাদার বলেন, তার থানা এলাকায় ৪৭ ভোট কেন্দ্র রয়েছে। ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার মহড়ায় প্রতিটি কেন্দ্রে উপস্থিতির সংখ্যা কম ছিল।