কেন্দ্রে যাওয়ার পরিবেশটা যেন পাই, চাওয়া নারী ভোটারদের

নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে ভোট দিয়ে নিরাপদে ফিরে আসার নিশ্চয়তা চাইছেন ঢাকার নারী ভোটাররা।

কাজী নাফিয়া রহমান নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Jan 2020, 05:13 PM
Updated : 29 Jan 2020, 05:13 PM

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগে বিভিন্ন এলাকার নারীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এই চাওয়ার কথা জানা যায়।

তাদের কথায় স্পষ্ট, দুই সিটিতে অর্ধেক ভোটার নারী আর সহিংসতা হলে তাদের ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।

অর্ধেক নারী ভোটার স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে ফল নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিয়ামক হবে বলে দাবি করেছেন নারী আন্দোলনের কর্মীরা।

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ৫৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৬৭ জনের মধ্যে ২৬ লাখ ২০ হাজার ৪৫৯ জন নারী।

শেষ সময়ের সরগরম প্রচারের মধ্যে দুই-একটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যা ভাবিয়ে তুলছে নারী ভোটারদের। তাদের অনেকে বলছেন, অতীতের অভিজ্ঞতার কারণে উদ্বেগ কাটছে না তাদের।

নিরাপদ পরিবেশ, আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতার সঙ্গে নির্বাচন কর্মকর্তাদের সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ প্রত্যাশা করছেন নারীরা।

এবার সম্পূর্ণ ভোট ইভিএমে হবে বলে যন্ত্রে ভোট দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী নারী ভোটারদের অনেক।

উদ্বেগের কেন্দ্রে পরিবেশ-ইভিএম

এবারই প্রথম ভোট দেবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিয়া রহমান, তার ভোটকেন্দ্র ঢাকা উত্তরে মিরপুরের একটি বিদ্যালয়।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোটকেন্দ্রের নিরাপদ পরিবেশ চাই। যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক কালচারটাই উদ্বেগের। সেক্ষেত্রে কোনো বিশৃঙ্খরা যেন না হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেদিকে যেন গুরুত্ব দেয়।”

ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে কোনো হয়রানিতে যেন পড়তে না হয়, সেদিকে ইসিকে দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান সামিয়া।

ভোটকেন্দ্রে ইভিএম প্রদর্শনীতে গিয়ে পদ্ধতি বুঝে আসছেন অনেক নারী।

ইভিএমে ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়া না জানলেও এনিয়ে আগ্রহী এই নারী বলেন, “আশা করব, নির্বাচনের দিন ইভিএমে ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়ায় কোনো জটিলতা থাকবে না। সব ভোটার তো শিক্ষিত না। তারা যেন সহজে বুঝতে পারে, পোলিং কর্মকর্তারাও যেন সহায়তা করেন।”

পুরান ঢাকা অর্থাৎ ঢাকা দক্ষিণের ভোটার একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী সায়মা হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে  বলেন, গত সংসদ নির্বাচনে তার ইভিএমের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না।

“বেশিরভাগ মানুষই বিষয়টা বুঝে নাই। কেন্দ্রের লোকজন ইচ্ছামতো নিজেদের মার্কা সিলেক্ট করে দিচ্ছিল। জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে।”

‘ভোট দিয়ে লাভ কী’ এমন অভিজ্ঞতা মানুষকে আগামীতে নির্বাচনবিমুখ করবে বলে মন্তব্য করেন সায়মা।

ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে সবাইকে বোঝালে আর নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন- এমন আস্থা পেলে ভোট দিতে যাবেন বলে জানান তিনি।

ঢাকা উত্তরে মিরপুরের কালশীর ভোটার গৃহকর্মী সুরমা বেগমের উদ্বেগ বেশ আইনশঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে, সেই সঙ্গে ইভিএমও নতুন তার কাছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আগেরবার (একাদশ সংসদ নির্বাচনে) অনেক গণ্ডগোল ছিল কেন্দ্রের সামনে।

“এবার নাকি আবার মেশিনে ভোট হইব? মেশিন কেমনে চালায় তা তো আমরা জানি না। আমাদের না শিখাইলে ভোট দিমু কেমনে? আমরা যাতে ভোটটা দিতে পারি, কেউ যাতে আমার ভোট না দেয়।”

“ভোট হইয়া গেছে’ এমন শঙ্কা তার মনে এখনও বাজে।

“তয় কেন্দ্রে যামু। অনেকে ভোট চাইছে। দেহি, কেন্দ্রে গিয়া ভোট কীভাবে দিতে হয়। পরিবেশ সুস্থ থাকলে যামু।”

বুধবার গুলশান পার্কে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ বাঁধলে ভাংচুর হয় চেয়ার।

ঢাকা উত্তরের মোহাম্মদপুরের ভোটার হাসনা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোটকেন্দ্র হতে হবে সন্ত্রাসমুক্ত। অধিকাংশ সময়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপত্তা বাহিনী থাকতে হবে, তাদের ভূমিকা অনেক বড়।”

নির্বাচন কর্মকর্তাদের সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, “অনেক বয়স্ক মানুষ, আর নতুন ভোটার যাবে ভোট দিতে। অনেক বিষয় নাও জানতে পারে। কিছু জানতে চাইলে তারা যেন ভদ্র আচরণ করে।”

ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলেই ভোট দিতে যাবেন বলে জানান গৃহিনী ঝর্ণা রানী দাস।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রের সামনে ঝামেলা করে। ভোটাররা যেন ভোট না দিয়ে ভয়ে চলে যায়, সেজন্য তারা ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। এমন পরিবেশ যেন না হয়।”

নারীরাই ‘নিয়ামক’

মোট ভোটারের অর্ধেক নারী হওয়ায় জয়-পরাজয়ে তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নারীরা যেহেতু মোট ভোটারের অর্ধেক, তাই তাদের সংখ্যা বাড়লে তারা জয়-পরাজয়ের জন্য বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে।”

এই নারী ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পরিবেশ নিরাপদ রাখার উপর জোর দেন তিনি।

“ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ হলেই নারীরা ভোটকেন্দ্রে যাবেন। ঠিকমতো ভোটটা যেন দিতে পারে, সেই নিশ্চয়তা থাকতে হবে।”

নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নারীরা

সেগুন বাগিচার ভোটার মালেকা বানু বলেন, “বিশৃঙ্খলা বা ভীতিকর পরিবেশ থাকলে তো নারীরা ভোটকেন্দ্রে যাবে না।”

নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনুও বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ থাকলে ভোটকেন্দ্রে নারীদের উপস্থিতি বাড়বে।

“নারীদের অংশগ্রহণ বাড়লে ভোটও বেশি পড়বে। কিন্তু যদি কেন্দ্রে বা পথে হট্টগোল হয়, পরিবেশ খারাপ থাকে, তাহলে নারীরা ভোটকেন্দ্রে যাবে না,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা বিবি আছিয়া ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মনির হোসেন বলেন, নারী ভোটাররা ভোট দিলে সেটা অবশ্যই জয়-পরাজয়ের ক্ষেত্রে ‘বড় ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করবে।

আশ্বস্ত করছে ইসি

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ তার অভিজ্ঞতায় বলেন, নানা কারণেই নারীদের ভোট দেওয়ার প্রবণতা কম থাকে।

ভোট দেওয়ার এই চিত্র ২০১৯ সালে ঢাকা উত্তরে মেয়র পদে উপনির্বাচনের।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দূরে কেন্দ্র হওয়ায় নারীদের অনীহা থাকে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি দল বয়কট করার পর কিন্তু অনেক ভোটারই ভোটকেন্দ্রে যায়নি আর।

“পরিবেশ ভালো থাকতে হবে, ছোট-খাটো গোলযোগ হয়ত থাকে, কিন্তু বড় ধরনের ঝামেলা যেন না হয়। এখন যে পরিস্থিতি আছে, তা শেষ পর্যন্ত থাকতে হবে। তাহলে নারীরা ভোটকেন্দ্রে যেতে আগ্রহী হবে।”

বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা নির্বিঘ্ন পরিবেশ ও নিজের ভোট নিজে দেওয়ার নিশ্চয়তা ইতোমধ্যে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “ভোটাররা যেন নির্ভয়ে কেন্দ্রে আসতে পারে, সেই পরিবেশ থাকবে।”

ইভিএম নিয়ে ইতোমধ্যে প্রদর্শনী চলছে কেন্দ্রগুলোতে, যেখানে গিয়ে যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি জানা যাচ্ছে। ৩০ জানুয়ারি মক ভোটের আয়োজনও করেছে ইসি।

মঙ্গলবার ইভিএম প্রদর্শনীতে এসে সিইসি বলেন, “ইভিএমের মাধ্যমেই ভোটার নিজের ভোট দিতে পারবে। এ জন্যই ইভিএমে ভোট। ইভিএমের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে। “