আগ্রহী তরুণদের বেশিরভাগই ভেবেচিন্তে এলাকার বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে চেয়েছেন। আর অনাগ্রহীদের কেউ কেউ অতীতের কাউন্সিলরদের কর্মকাণ্ডে এতটাই হতাশ যে, তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ারই প্রয়োজন অনুভব করছেন না।
ভোট নিয়ে আগ্রহ-অনাগ্রহের কেন্দ্রে ইভিএমকে রাখার কথা জানিয়েছেন মালিবাগের শান্তিবাগ এলাকার তরুণ তামিম আহমেদ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার ভোট দেওয়ার ইচ্ছা নেই। যেতেও পারি, নাও যেতে পারি। তবে যাওয়ার একটা কারণ আছে- ইভিএমে ভোটটা দেব, আগে কখনও দিইনি। একদিক দিয়ে মনে হচ্ছে ভোট দেব না, আবার মনে হচ্ছে ইভিএমে দিই।”
নিজের আগ্রহ না থাকলেও বাবা-মার কাছ থেকে ভোট দেওয়ার বিষয়ে উৎসাহ পাওয়ার কথা জানান তামিম।
১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে নির্বাচনে সম্পূর্ণ ভোটগ্রহণ হবে ইভিএমে।
এবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩০ লাখ ৯ হাজার এবং দক্ষিণ সিটিতে ২৪ লাখ ৫২ হাজার ভোটার রয়েছেন।
দুই সিটিতে সাড়ে ১২ লাখ নতুন ভোটার যারা ২০১৫ সালের পর প্রথম ভোট দেবেন মেয়র ও কাউন্সিলর পদে। এরমধ্যে সম্প্রসারিত ৩৬টি ওয়ার্ডের ভোটারও রয়েছে। উত্তর সিটিতে ৬ লাখ ৬৫ হাজারের মতো এবং দক্ষিণে ৫ লাখ ৮২ হাজারেরও বেশি নতুন ভোটার রয়েছে। |
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আরেক তরুণ ভোটার রাফসান শরীফ ইমনও বলেন ইভিএম নিয়ে আগ্রহের কথা।
“যদিও আমি গত সংসদ নির্বাচনে প্রথম ভোটার ছিলাম কিন্তু ইভিএমে এবারই প্রথম ভোট দিচ্ছি, তাই আগ্রহটা আগের চেয়ে এখন বেশি।”
ভোটের পরিবেশ সম্পর্কে ইমন বলেন, “নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অনুকূল পরিবেশ থাকলে এবং কোনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি না হলে অবশ্যই ভোট দিতে যাব। ভোট আমার অধিকার, সেজন্য ভোট দিতে যাব, তবে প্রতিনিধি নির্বাচনটাও গুরুত্বপূর্ণ।”
ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসের প্রচারে সঙ্গী হচ্ছেন অনেক তরুণ।
জলাবদ্ধতা, যানজট, দূষণ প্রতিরোধে প্রতিশ্রুতি দিলেও সিটি করপোরেশন সেভাবে ভূমিকা রাখে না বলেই মনে করেন কাকরাইলের বাসিন্দা তনয় পোদ্দার।
তিনি বলেন, “ফ্লাইওভার নির্মাণের পর রাস্তাঘাট কিছুটা উন্নত হলেও এখনও বৃষ্টিতে আমাদের গলিতে পানি জমে যায়। যানজট তো লেগেই থাকে। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে কাউন্সিলরকে বলা হলে তিনি বলেন, ‘দেখছি ব্যাপারটা’।
”আশা করব, যারা এবার নতুন নির্বাচিত হয়ে আসবেন তারা কিছুটা হলেও কাজ করে দেখাবেন। ভোটের ফলাফল কি হবে জানি না। তবে চাইব, যিনিই আসুক, আমাদের কথা শুনুক, কাজ করে দেখাক।”
ইসি কর্মকর্তারা জানান, ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত অবিভক্ত ঢাকা সিটির নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ২৮ লাখ। দেড় যুগ পর এখন দ্বিগুণ ভোটার দুই সিটিতে। যাদের বয়স ১৯ থেকে ৩৬ বছরের মধ্যে এমন ভোটার রয়েছেন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এরমধ্যে ১৯ থেকে ২৩ বছর বয়সী ভোটার রয়েছেন ১০ লাখের বেশি; আর ২৪ থেকে ৩৬ বছর বয়সী ভোটার ১২ লাখের বেশি। |
দক্ষিণের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা তামান্না তাসনিয়া মৌ ভোটার হয়েছেন উত্তর সিটির ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে। শান্তিনগর থেকে তাকে ভোট দিতে আসতে হবে মেরুল বাড্ডায়।
সর্বশেষ কাউন্সিলর তাদের মেরুলের বাড়ির দীঘি ভরাট করায় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে বলে ক্ষুব্ধ তিনি। তারপরও এবার ভোট দিতে যাবেন তিনি ইভিএম দেখার আগ্রহ থেকে।
তাসনিয়া বলেন, “এখন প্রযুক্তির যুগ। ডিজিটাল পদ্ধতিতেই তো সবকিছু হওয়া উচিৎ। ইভিএমে ভোট নিয়ে অনেকে আতঙ্কে ভুগছে, আসলে ব্যাপারটা একটু জেনে নিলেই হয়। এটাতে কোনো সমস্যা দেখছি না।”
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তরুণ ভোটার আফিফা আক্তার ভোট নিয়ে মোটেও আগ্রহী নন। বিষয়টিকে ‘ঝামেলা’ মনে করেন তিনি।
“যদিও প্রথম ভোটার তাও কোনো আগ্রহ নেই। আমি প্রার্থীর কাছে যা প্রত্যাশা করি তা বাস্তবায়ন হয় না, তাহলে ভোট দিয়ে লাভ কী?”
ঢাকা উত্তরে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালের প্রচারেও রয়েছেন তরুণরা।
দক্ষিণখানের ইছাপুরার ভোটার রাকিবুল আলম আর সেলিম রহমানের ভোট নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাসই নেই। কারণ আগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড।
সেলিম বলেন, “কী হবে ভোট দিয়ে? যারা কাউন্সিলর ছিলেন, ঘুরেফিরে তারাই হয়ত আসবেন। কিন্তু কোনো উন্নয়নই হবে না। উন্নয়নের টাকাটা নিজেরা লুটেপুটে খাবে। আমাদের ভোট দেওয়ার কোনো মানে হয় না।”
উত্তরের ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের তরুণ জামাল হোসেন অবশ্য নগরের বাসিন্দা হিসেবে ভোটের অধিকারকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মনে করেন। তবে সেই অধিকার প্রয়োগের আগে অবশ্যই এলাকার উন্নয়নকেই গুরুত্ব দেবেন তিনি।
“আমাদের ভোট আমরা দেব, ফলাফল কী হয়, সেটা পরের ব্যাপার। এলাকায় কী কাজ হয়েছে, কী হয়নি, সেসব বিবেচনাতেই আমরা ভোট দেব।”
২০১৫ সালে সর্বশেষ নির্বাচনে উত্তরের ৩৬টি ওয়ার্ডে ভোটার ছিল ২৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৭৪ জন। নতুন ১৮টি ওয়ার্ড যুক্ত হয়ে এখন ৫৪টি ওয়ার্ড এ সিটিতে। নতুন ওয়ার্ডগুলোতে ভোটার আছেন পাঁচ লাখ ৭১ হাজার ৬৮৪ জন। সবমিলিয়ে ২০২০ এসে এই সিটিতে ভোটার এখন ৩০ লাখ ১০ হাজার ২৭৩ জন। অর্থাৎ, উত্তরে ছয় লাখ ৬৪ হাজার ৮৯৯ জন ভোটার বেড়েছে। অন্যদিকে ২০১৫ সালে দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে ৫৭টি ওয়ার্ডে ভোটার ছিল ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৭৫৩ জন। পরে যুক্ত হয় আরও ১৮টি ওয়ার্ড, মোট ৭৫টি ওয়ার্ড। দক্ষিণের ১৮টি ওয়ার্ডে ভোটার আছেন চার লাখ ৭৭ হাজার ৫১০ জন। সব মিলিয়ে এই সিটিতে ভোটার এখন ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪ জন, অর্থাৎ পাঁচ বছর পর এখানে ভোটার বেড়েছে পাঁচ লাখ ৮২ হাজার ৪৪১ জন। |
নির্বাচনী প্রচারে মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ঝরালেও তার ‘সিকিভাগও বাস্তবায়ন হবে না’ বলে মনে করেন ওই এলাকার ভোটার নাসরিন আক্তার।
“ভোট এলে তাদের কত কথা! আর ভোট চলে গেলে তো তাদের চেহারাটাও দেখি না। এই হল আমাদের কাউন্সিলরদের অবস্থা। আওয়ামী লীগ আর বিএনপি- সব দলেই একই অবস্থা। কাকে ভোট দেব, চিন্তা করছি।”
ভোট নিয়ে উদ্দীপ্ত থাকলেও পরিবেশ নিয়ে মনে শঙ্কা আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুরাইয়া আমিনের।
তিনি বলেন, কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নয়, ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, সুষ্ঠু পরিবেশ চান তিনি।
“এবারের নির্বাচন নিয়ে আমি অনেক বেশি এক্সাইটেড। কারণ সবাই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, আগের নির্বাচনে এমনটা ছিল। নতুন ভোটার তাই আগ্রহটা আরও বেশি।”
ভোটের নিরাপদ পরিবেশ আর ইভিএম নিয়ে একই মনোভাব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে ফরহাদ রেজার। ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কিংবা বিরোধী দলের প্রার্থী বিবেচনার বিষয় নয় বলে মনে করেন তিনি।
“এলাকার উন্নয়নে কাজ করবেন এমন উদ্যোগী, সৎ ব্যক্তিকে ভোট দিতে চাই। দল সেখানে বিবেচনার বিষয় নয়। তবে বিরোধীদলের ভালো প্রার্থী থাকলেও তাকে ভোট দিতে কয়েকবার ভাবব। কারণ এই সময়ে তারা কতটা কাজ করতে পারবেন, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে।”