সংরিক্ষত কাউন্সিলর: ‘ভার’ বেশি, ক্ষমতায় পিছিয়ে

ভোটের কঠিন যুদ্ধে সামলে নির্বাচিত হলেও এলাকার মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ খুব কমই পান ঢাকার দুই সিটির সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলররা; যতটুকুই কাজের সুযোগ পাওয়া যায়, সেজন্য মেয়র কিংবা সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Jan 2020, 07:09 AM
Updated : 27 Jan 2020, 07:56 AM

দীর্ঘদিনের এ চর্চার অবসান চান এবার ঢাকা সিটি ভোটের মাঠে থাকা সংরক্ষিত ওয়ার্ডের প্রার্থী। ভোটে জিতে আসতে পারলে বিষয়টি নিয়ে উচ্চকণ্ঠ হওয়ার ইচ্ছাও আছে তাদের।

আগামী ১ ফেব্রুয়ারি উত্তরের ১৮টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৭৭ জন এবং দক্ষিণের ২৫টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৮২ জন নারী প্রার্থী লড়ছেন। এর মধ্যে দক্ষিণে দুইজন ইতিমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডে (৯, ১০ ও ১১ নম্বর) আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী রাজিয়া সুলতানা ইতি মনে করেন, সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সমান কাজের সুযোগ দেওয়া উচিত।

আগেও কাউন্সিলর হওয়ায় অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, আমাদের সংরক্ষিত না বলা হোক, এটা যেন তুলে দেয়। আমরা এখন ইলেক্টেড, সিলেক্টেড না। আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত। আমরা একজন এমপির অর্ধেক পরিশ্রম করি, যেহেতু তিনটা ওয়ার্ড। আমরা অনেক জনবলও খাটাই, তিনটা ওয়ার্ড থেকে ভোট পেতে হয়।

“কিন্তু সাধারণ কাউন্সিলরদের সমান কাজের সুযোগ আমাদের নেই। কাজের সুযোগ থাকে মেয়র আর সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদেরই, সব ক্ষমতা তাদের হাতেই। ভাইরা কাজের সুযোগ দিলে আমরা করতে পারি, নইলে নয়।”

রাজিয়া বলেন, “আমরাও জনগণের জন্য কাজ করতে চাই। আমরা তো পরিশ্রম কম করি না, তাহলে কেন কাজের সুযোগ পাব না? আমরা চাই আমাদের হাতে ক্ষমতা থাক, আমরাও এলাকার জন্য কাজ করতে চাই।”

উত্তর সিটির সংরক্ষিত ওয়ার্ডে (২৯, ৩০ ও ৩২ নম্বর) বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী খন্দকার ফারহানা ইয়াসমীন আতিকা এবারই প্রথম ভোটে লড়ার সুযোগ পেয়েছেন।  

এ ওয়ার্ডে দুই লাখ ২৭৩৭ জন ভোটার রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, একজন এমপির সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাকে করতে হচ্ছে, আর সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের তিনগুণ। যতই বলা হোক চার লাখ টাকা নির্বাচনে ব্যয় করতে হবে, কিন্তু কখনই সেটা সম্ভব নয়।

“মানি, মাসল, ম্যান- এই তিনটা বিষয়ই যে নির্বাচনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, সেটা এখন আমি হারে হারে অনুভব করছি। আমার ম্যান আছে, মাসলস আছে, কিন্তু মানি নাই। এইখানে যে টাকা খরচ হয়, সেই টাকাটা আসলে আমার নাই। একেক ওয়ার্ডে যদি একশজন কর্মী কাজ করে, তিনটা ওয়ার্ডে তিনশজন। তাদের প্রতিদিন শুধু আপ্যায়ন খরচটা দিলেও তো অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে।”

নিজের তিনটি ওয়ার্ডে ২৫৯টি বুথ এবং ৬৯টি কেন্দ্র রয়েছে জানিয়ে আতিকা বলেন, “সবগুলো বুথে এজেন্ট দিতে না পারলেও সবগুলো কেন্দ্রে তো দিতেই হবে। একজন লোক সারাদিন পরিশ্রম করবে, তাকে তো একটা সম্মানী দিতে হবে। তার খাবার, যাতায়াত, নিরাপত্তা- সবকিছুই আমাকে নিশ্চিত করতে হবে। কাজেই খরচটাও অনেক বেশি।”

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের (৮, ৯ ও ১০ নম্বর) আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মিনু রহমান মনে করেন, সিটি করপোরেশনের আইনেই গলদ রয়েছে।

“নারীদের জন্য যে কাজের সুযোগগুলো আছে, সেগুলোই আমরা করি। সিটি করপোরেশন আইনেই তো আমাদের কাজের তেমন সুযোগ নাই, সাধারণ কাউন্সিলরদের আছে। তবে আমি ক্ষমতায় এলে মেয়র মহোদয়ের কাছ থেকে কাজের সুযোগ পাব বলে আশা করছি। ঢাকা উত্তরে কোনো ঠিকাদার কাজ করলে তা তদারকি করতে পারে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলররা। আনিসুল হক (উত্তরের প্রয়াত মেয়র) এটা করে গেছেন, কিন্তু দক্ষিণে এ সুযোগটা আমাদের নাই। আমাদের হাতে ক্ষমতা কম।”

জনপ্রত্যাশা মেটাতে না পারার আক্ষেপ ঝরল বর্তমান এই কাউন্সিলরের মুখ থেকে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের (৭০, ৭১ ও ৭২ নম্বর) আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সেলিনা খান এর আগে কাউন্সিলর হিসেবে পয়ঃনিষ্কাশন, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, রাস্তা পাকা করা, বিদ্যুতের খুঁটি বসানোসহ বিভিন্ন কাজ করেছেন।

তবে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন হলেও কাউন্সিলরদের কাজের পরিধি ঠিক করে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

“আমাদের পুরুষশাসিত সমাজ, আমরা চাইলেও সব কাজ করতে পারি না। আর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলরদের কাজের সুযোগও অনেক কম। সিটি করপোরেশনের কাজের সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হই, পুরুষ কাউন্সিলরদের এলাকার বিভিন্ন কার্যক্রমগুলো জানানো হয়, আমাদের জানানো হয় না। তাই কাজ করার ক্ষেত্রে আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি।

“সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের কাছ থেকে সেই সহযোগিতা আমরা পাই না, বিগত দিনে পাইনি। তবে দল থেকে এখন সাপোর্ট দিচ্ছে।”

সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডের ‘বৈষম্য’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডে (৩৯, ৪০ ও ৪৯ নম্বর) আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী লাভলী চৌধুরী।

“১৬-১৭ বছর ধরে দেখছি তাদের (সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর) হাতেই সব ক্ষমতা। কাজের সুযোগ তারাই পায়। এটা নিয়ে আর বলে কোনো লাভ নাই। আমি নির্বাচিত হই, তারপর এসব নিয়ে কথা বলব।”

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডে (২৭, ২৮ ও ৩০ নম্বর) বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী শামসুন নাহার ভূঁইয়া আগেও ১৫ বছর ধরে কাউন্সিলরের দায়িত্ব সামলেছেন।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ মহিলা দলের এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, “আসলে সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরদের জন্য কোনো নীতিমালা নাই, যে আমরা কী কাজ করব? সরকারিভাবে কিছু বলা নাই। আমরা যখন কাজ করতে যাই, তখন মেয়ররা বলেন, আপনার তো কোন নীতিমালা নাই, আপনি কী কাজ করবেন? নারীরা কী কাজ করবে, সেটা নির্ধারণ করা হোক। শুধু সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হলে তো হবে না, তাদের কাজের সুযোগ দিতে হবে।”

উত্তর সিটি করপোরেশনে ১, ১৭ ও ১৮ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হাছিনা বারী চৌধুরী নির্বাচনী প্রচারে চ্যালেঞ্জের কথা বলেন, “আমাদের দিন-রাত কাজ করতে হচ্ছে। প্রত্যেকটা মানুষের কাছে যেতে হচ্ছে। তিনটা ওয়ার্ডের সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের সাথে সমন্বয় করে কাজ করছি। আমরা একসাথে লিফলেট বিতরণ করছি, ভোট চাচ্ছি। তিনটা ওয়ার্ড হওয়ায় আমাদের চাপ অনেক বেশি, অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে।”

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৬, ১৭, ২১ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী আওয়ামী লীগ সমর্থিত নারগীস মাহতাব বলেন, “আমি তিনটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। একটি ওয়ার্ডের পুরুষ কাউন্সিলের সমান সুযোগ দিলে তো হবে না। আমাকে তিনটি ওয়ার্ডের কথা চিন্তা করে মানুষের সেবা করতে সুযোগ দিতে হবে।”

সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরদের ক্ষমতায়ন ও কাজের সুযোগ নিশ্চিতে সরকারের কাজ করা উচিত বলে মনে করেন নারী অধিকার কর্মীরা।

নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, “সংরক্ষিত ওয়ার্ডের মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন হয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক। কিন্তু কাজের সুযোগ যেমন তৈরি হয়নি, কেমনি কাজের পরিবেশও তারা পায় না। কাজের পরিবেশ না পেলে তারা কাজ করবে কীভাবে? নির্বাচিত হলেই তো হবে না, কাজ করতে হবে। সেই কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।”

এ ব্যাপারে সরকারকে নজরদারি বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, “তিরানব্বই সাল থেকে নারীরা বিভিন্ন পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে কাজ করে আসছে। কিন্তু এত বছর পরও আমরা কাঙ্ক্ষিত অবস্থায় যেতে পারিনি।

“নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আগে আমাদের নিজেদের পরিবর্তন দরকার। নিজেদের শক্তি ধরে রাখতে হবে। তাহলেই নারীদের অধিকার ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে।”