আচরণবিধি: কোটি মানুষের নগর দেখছেন মাত্র ৪৩ জন!

অর্ধ কোটির বেশি ভোটারের ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আচরণবিধি প্রতিপালনের দায়িত্ব মাত্র ৪৩ জন নির্বাহী হাকিমের কাঁধে।

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Jan 2020, 05:14 AM
Updated : 27 Jan 2020, 05:14 AM

১ ফেব্রুয়ারি ভোট সামনে রেখে রাজধানীর রাস্তায় রাস্তায় দড়িতে ঝুলছে পোস্টার। মিছিল, বাদ্য, লাউড স্পিকারে অমুক ভাই, তমুক বোনের মার্কার প্রচার। সেই সঙ্গে চলছে পথসভা-ঘরোয়া বৈঠক, পথে পথে হেঁটে প্রার্থীদের গণসংযোগ। আর এর সব কিছুর মধ্যেই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের চিত্র দৃশ্যমান।

আচরণবিধি লঙ্ঘনের খবর নিয়মিতভাবেই গণমাধ্যমে আসছে। প্রার্থীরাও পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করছেন প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যাচ্ছে রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে, নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়ে। 

ইসি বলছে, আচরণবিধি নিয়ে তারা তৎপর। তবে বাস্তবে তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না নগরবাসী বা পর্যবেক্ষকদের।   

আচরণবিধি প্রতিপালন হচ্ছে কি না তা দেখার জন্য ঢাকা উত্তরে ৫৪ ওয়ার্ডের জন্য ১৮ জন এবং দক্ষিণে ৭৫ ওয়ার্ডের জন্য ২৫ জন নির্বাহী হাকিম রয়েছেন। অর্থাৎ, প্রতি তিন ওয়ার্ডের জন্য নির্বাহী হাকিম আছেন একজন।

ভোটের আগে ৩০ জানুয়ারি মাঠে নামবেন আরও ১২৯ জন নির্বাহী হাকিম। সেক্ষেত্রে প্রতি ওয়ার্ডে থাকবেন একজন করে। তখন আচরণবিধি প্রতিপালনে আরও কড়াকড়ি থাকবে বলে ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীরের ভাষ্য।

পর্যবেক্ষকদের চোখে

নির্বাচনের আগে ভোটের পরিবেশ নিয়ে রূপনগর শিক্ষা স্বাস্থ্য সহায়তা ফাউন্ডেশন-রিহাফের চেয়ারম্যান এ এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “মৌলিক যে বিষয়গুলো দেখছি, বিধিনিষেধ উপেক্ষা করছেন প্রার্থী। শোডাউনের ব্যাপারে যে বিধি আছে, সেটা তারা মানছেন না। আর্থিক বিধি মানছেন না।..পোস্টার ছেঁড়ার বিষয়টিও পেয়েছি।”

তিনি জানান, ক্যাম্প প্রতি খরচ, কর্মী প্রতি খরচ, মাইক ব্যবহার নিয়ে যে নিয়ম আছে সেগুলো অনেকেই মানছে না। সকাল ১০টা থেকে মাইক ব্যবহারের ঘটনা ঘটছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী বা তার লোকজন প্রভাব বেশি খাটাচ্ছে।

ভোটের সংঘাত গোপীবাগে; ঢাকা দক্ষিণে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী ইশরাক হোসেনের সমর্থকদের সঙ্গে রোববার দুপুরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থকদের সংঘর্ষ বাঁধে।

ভোটের পরিবেশ কেমন দেখছেন জানতে চাইলে হিউম্যান রাইটস ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এইচডিডির রাজীব শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি যে এলাকায় থাকি, সেই হাজারীবাগে প্রচারে বাধা দেখছি। সরকার দল সমর্থিত প্রার্থীদের তাদের প্রচার বেশি দেখা যাচ্ছে। আর বিরোধী দলীয়দের প্রচার কম হচ্ছে।”

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ-জানিপপ এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, এ নির্বাচনে এখন পর্যন্ত যা দেখছি তাতে কোনো পক্ষই অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দেয়নি।

“যথেষ্ট উৎসাহ আছে ভোটারদের মধ্যে। সো ফার সো গুড। ‘অংশগ্রহণমূলক’ ভোটে কিছু ব্যতিক্রম-বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে মোটা দাগে ক্যাম্পেইন সুন্দরভাবেই চলছে।”

এর মধ্যেও আচরণ বিধি লঙ্ঘনের কিছু অভিযোগ পাওয়ার কথা জানিয়ে কলিমুল্লাহ জানান, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ নির্বাচনী সংস্কৃতির অংশ। কে কাকে বেকায়দায় ফেলে সুবিধা নিতে পারে সেটার একটা প্রতিযোগিতা আছে।”

সাবেক ও বর্তমান  নির্বাচন কমিশনারের চোখে

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বিডিনিউজ টোয়ন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছোটখাটো কিছু গোলমাল হচ্ছে। এটা আমি নির্বাচনের অংশ হিসেবেই গণ্য করি। তবে প্রার্থীদের ওপর আক্রমণ দুঃখজনক। নির্বাচন কমিশনের নলেজে যাওয়ার সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অপরাধীদের খুঁজে প্রয়োজনীয় শাস্তি দিতে হবে।

তবে তার বিচারে সার্বিকভাবে নির্বাচনের পরিবেশ এখন পর্যন্ত ‘ভালো’। অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে ‘শান্তভাবেই’ হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সে রকম হয়রানির অভিযোগও নেই।

আর বর্তমান নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “এ মহানগরে সীমিত সংখ্যক নির্বাহী হাকিম বিষয়টি দেখভাল করছেন। অনেককে সতর্ক করেছে, কোথাও জরিমানা করেছে। কিন্তু কোটি মানুষের নগরে অপ্রতুল লোকবল দিয়ে দৃশ্যমানভাবে কাজ করা কতটুকু সম্ভব?

তিনি বলেন, “বাস্তবতাকে অস্বীকার করা উচিত নয়। সতর্ক আর জরিমানার মধ্যে করছে কাজ তারা। আমাদের কাছে প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে- কেউ বললে তো তা সম্ভব না। অভিযোগ আসতে হবে, তদন্ত করতে হবে, তারপর কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে- এটা একটা প্রক্রিয়া।”

রফিকুল ইসলামের দাবি, কমিশনের কাছে কোনো প্রার্থী সরকারি দল সমর্থিত বা বিরোধী দল সমর্থিত হিসেবে বিবেচিত হন না।

“আমাদের কাছে সব প্রার্থীই সমান। কিন্তু স্থানীয়ভাবে ‘প্রভাব’ দেখাতে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা থাকে। তবে সব সময় বিষয়টিতে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় না। যখনই নির্বাহী হাকিমরা যান, সেখানে বিষয়টির প্রমাণ মেলে না। বাস্তবতাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের কাজ করতে হয়।”

আগামী ১ ফেব্রয়ারি ঢাকার দুই সিটির প্রায় ২৪ হাজার কেন্দ্রে ভোট হবে ইভিএমে। দুই সিটিতে এবার ১৩ মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা সাড়ে সাতশ।

স্থানীয় সরকারের এ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য মোট ২২টি সংস্থা আবেদন করেছে ইসিতে। উত্তর সিটি করপোরেশনে এসব সংস্থার ৫০৩ জন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৪৫৭ জন এবং কেন্দ্রীয়ভাবে আরও ৫৩ জনকে পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলো ভোটের পুরো প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে তাদের প্রতিবেদন ইসিতে জমা দেয়।

ফৌজদারী অপরাধ হলে আইন শৃঙ্খলাবাহিনী

দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনে বিএনপি মেয়র প্রার্থীর প্রচারে সংঘর্ষের  ঘটনা হয়েছে রোববার। এর আগে উত্তরের বিএনপি মেয়র প্রার্থীর প্রচারে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, “যদি কেউ হামলা করে থাকে অবশ্যই নজরে আনলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  রিটার্নিং কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট এলাকার সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাহী হাকিমের কাছে এ সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবে।

বিষয়টি নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা বা ইসির নজরে না আনা হলে কিংবা অভিযোগ না জানালে কী বা করার থাকবে উল্লেখ করেন তিনি।

এ নির্বাচন কমিশনার জানান, সংঘর্ষ বা হামলার বিষয়গুলো আচরণবিধির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। সেক্ষেত্রে ফৌজদারী অপরাধমূলক বিষয়।

“আদালতে বা থানায় মামলা করতে পারেন। মামলা হলে তা তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”

উত্তরের বিএনপি প্রার্থীর বিষয়টিও নির্বাহী হাকিম তাদের এখতিয়ারে নেই বলে উল্লেখ করেছিলেন। পুলিশ তদন্ত করে সেখানে ‘ঠেলা ধাক্কার’ মতো ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদন দিয়েছে।

পুরনো খবর