আচরণ বিধিতে ‘আর ছাড় নয়’

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচারের প্রথম পাঁচ দিনে আচরণ বিধি লংঘনের জন্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া না হলেও এরপর আর কাউকে ‘ছাড় দেওয়া হবে না’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Jan 2020, 04:30 AM
Updated : 16 Jan 2020, 07:47 AM

ঢাকা দক্ষিণের রিটানিং কর্মকর্তা আবদুল বাতেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আচরণ বিধি লংঘনে ব্যবস্থা নিতেই হবে। কোনোভাবে পাঁচ দিন পার হয়েছে। আমরা আর সময় দিতে চাই না।”

ভোটের দুই সপ্তাহ বাকি রেখে এখন মহানগরের অলি-গলিতে চলছে প্রচার। পোস্টার, ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে চারপাশ, মাইকে বাজছে গান, ভোট চেয়ে প্রার্থনা। দ্বারে দ্বারে হবু মেয়র-কাউন্সিলররা।

প্রচারে মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা বেশ তৎপর রয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে হরহামেশা অভিযোগও করছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা।

এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে এমপিদের প্রচারে অংশ নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিএনপি। এ নিয়ে সংসদেও উত্তাপ ছড়িয়েছে।

নিয়ম না থাকলেও রঙিন পোস্টার দেখা যাচ্ছে অনেক এলাকায়। সেই পোস্টার তুলতে হচ্ছে সিটি করপোরেশন কর্মীদের। কাউন্সিলর পদের প্রার্থীদের পোস্টারেও থাকছে দলীয় প্রধানের ছবি। রাস্তাঘাট বন্ধ করে সভা-মিছিল হচ্ছে হামেশাই।

মেয়র পদে ১৩ জন এবং ১২৩টি সাধারণ ওয়ার্ড এবং ৪৩টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী মিলিয়ে সাড়ে সাতশর বেশি প্রার্থী রয়েছে দুই সিটির নির্বাচনে।

ঢাকা দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন বুধবার নির্বাহী হাকিম, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে করেন। আচরণ বিধি লংঘন হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, সেই নির্দেশনা তিনি সেখানে দেন।

এখন পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সন্তোষ প্রকাশ করলেও প্রচারে বিধি লংঘনের চেষ্টায় অসন্তোষ রয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তা বাতেনের।

জানতে চাইলে ইসির এ যুগ্মসচিব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাঁচ দিনে আমরা (দক্ষিণে) ১৫ জনকে সতর্ক করেছি। কিন্তু একজনকেও আচরণ বিধি লংঘনে কোনো জরিমানা করা হয়নি। এখন নির্বাহী হাকিমদের এ নিয়ে তৎপরতা বাড়াতে বলেছি। যেখানেই বিধি লংঘন হবে সেখানেই ব্যবস্থা নিতে বলেছি।”

নির্বাচনী এলাকায় আচরণবিধি প্রতিপালন হচ্ছে কি না, তা তদারকির দায়িত্ব নির্বাহী হাকিমদের। তাদের সহায়তা করছে পুলিশও।

কিছুটা অসন্তোষের সুরে রিটার্নিং কর্মকর্তা বাতেন বলেন, “দেওয়ালে পোস্টার লাগানো রয়েছে, সিটি করপোরেশনের লোকজন নিয়ে তা সরাতে হয়েছে। কোথাও কাউন্সিলর প্রার্থীর পোস্টারে দলীয় প্রধানের ছবি, এটা তুলতে হয়েছে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে প্রচারের কাজও হয়েছে।

“এখন থেকে যেখানে রাস্তা-ঘাট বন্ধ হবে অ্যাকশন নিতে হবে; মাইকিং নির্ধারিত সময়ের বাইরে করা যাবে না।”

ইসির সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদেরও এখন কাজে লাগানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

আব্দুল বাতেন বলেন, “কোথাও আইনি ব্যত্যয় ঘটলে তা ধরিয়ে দিয়ে জরিমানা করানো হবে। বিশেষ করে মেয়র প্রার্থীদের প্রচারের সময় অতি উৎসাহীদের ভিড়ে আচরণ বিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে। এটা দেখার কেউ তো আছে আমাদের। কাউন্সিলররাও যোগ দিয়ে পুরো রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে।”

তিনি জানান, আচরণ বিধি লংঘন হচ্ছে কি না তা দেখার পাশাপাশি সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভোটের তারিখ পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে কেউ যেন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি না করে সেদিকেও নজর রাখা হয়েছে।

সরকারি সুবিধাভোগী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রচারে অংশ নেওয়ার অভিযোগ পেলে প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনের নজরে আনবেন বলে জানান তিনি।

রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, “নির্বাহী হাকিম, পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের বলেছি, আমাদের যা সহায়তা দরকার আমরা করব। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে জানাব। সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে, ভোটের পরিবেশ ভালো রাখব।”

উত্তরে একজনকে জরিমানা

নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল কাসেম বলেন, “এখন পর্যন্ত প্রার্থীদের প্রচারণা সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে হচ্ছে। কোনো অভিযোগ পেলে খোঁজ নিচ্ছি। প্রচার শুরুর পর মঙ্গলবার একজনকে জরিমানা করা হয়েছে।”

কোথাও আচরণ বিধি লংঘন হচ্ছে কি না তা নির্বাহী হাকিমরাই দেখছেন বলে জানান ইসির এ যুগ্মসচিব।

জানতে চাইলে ৪৯, ৫০ ও ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী হাকিম মো. জামাল হোসেন বলেন, “আমরা এ পর্যন্ত তিনবার রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় বৈঠক করেছি। সমন্বিতভাবে কাজ করছি। তিনটি ওয়ার্ডে দায়িত্ব আমার। এ পর্যন্ত একজনকে সতর্ক করেছি। কাউকে জরিমানা করা হয়নি।”

১, ১৭ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা নির্বাহী হাকিম বি এম রুহুল আমিন রিমন বলেন, “স্বাভাবিক রয়েছে ভোটের পরিবেশ। আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয় এখনও চোখে পড়েনি।”

 

এমপিরা প্রচারে আসবে না: আশা ইসি সচিবের

প্রার্থীদের প্রচারে কোনো ধরনের বাধা যেন না হয় সে বিষয়ে নজর রাখতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর জানিয়েছেন।

প্রচারের শুরুতে হাতাহাতি-হামলার অভিযোগের প্রেক্ষিতে সচিব বলেছেন, নির্বাচন কমিশন কড়া নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে। কমিশনের নির্দেশে ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

“সব প্রার্থী যাতে নির্বিঘ্নে প্রচার কাজ করতে পারে। প্রচারে যাতে বাধা না দেয়। এরপরও যদি আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ আসে, আইন অনুযায়ী যে ব্যবস্থা নেওয়ার, তা নেওয়া হবে। সামনে আইন শৃঙ্খলা বৈঠক হবে, সেখানেও এ বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে।”

ভোটের প্রচারে ক্ষমতাসীন দলের এমপিরা আর থাকবেন না বলে আশা রাখেন নির্বাচন কমিশন সচিব।

তিনি বলেন, “কমিশন স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, এমপি কিংবা মন্ত্রীরা নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারবে না। এরপরও যদি কেউ না জানার কারণে করে থাকে…। আশা করি, আর এ ধরনের কোনো বিষয় আসবে না। হয়ত অনেকে না জানার কারণে করে ফেলে।”

প্রার্থীদের আরচণবিধি পড়ে তা অনুসরণের তাগিদ দেন সচিব।

ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ সাদেক খান ও বাহাউদ্দিন নাছিম দুই সিটিতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারে অংশ নেন।

এ নিয়ে সমালোচনার মুখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী-এমপিদের ভোটের প্রচার থেকে বিরত থাকার বিষয়টি দেখার কথা বলেছেন।

নৌকা-ধানের শীষের প্রচার

বুধবার রাজধানীর ফার্মগেইট, ছাপড়া মসজিদ, লুকাস মোড়, তেজগাঁও রেলগেইট, নাবিস্কো, কুনিপাড়া, বেগুনবাড়ি এলাকায় গণসংযোগ করেন উত্তরে নৌকার মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম। এ প্রার্থীর জন্য ভোট চাইতে দ্বারে দ্বারে যান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।

পরিকল্পিত সুন্দর ঢাকা শহর গড়তে গণসংযোগের সময় নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন আনিসুল হকের মৃত্যুর পর উত্তরের মেয়রের দায়িত্ব পালন করা আতিক।

দক্ষিণে নৌকার মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপসও রাজধানীর কদমতলী-শ্যামপুরসহ নানা এলাকায় নির্বাচনী পথসভা করেন। ভোট চাওয়ার পাশাপাশি আচরণবিধি প্রতিপালনে সচেতন থাকার কথা তিনি বলেন।

তাপস বলেন, “প্রচারে গিয়ে জনগণের জন্য কোনো ভোগান্তি যেন না হয়। কোনো ধরনের কাজে যাতে আচরণ বিধি লঙ্ঘন না হয় সেজন্য আমাদের মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করছে। সেদিকে আমরা খুব সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি রাখছি। যেখানে আমরা জানতে পারছি, সেখানে সাথে সাথে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।”

এদিন ধানমণ্ডির বিভিন্ন এলাকায় প্রচার চালান দক্ষিণে ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন। নিজের পক্ষে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি নানা অভিযোগ ও শঙ্কার কথা তুলে ধরেন তিনি।

নির্বাচনী প্রচারে সব প্রার্থী সমান সুযোগ পাচ্ছে না অভিযোগ করে ইশরাক বলেন, “অনেক জায়গায় ধানের শীষের পোস্টার লাগাতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। যেখানে লাগানো হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে তা ছিড়ে ফেলছে সরকারি দলের লোকজন। আমরা নির্বাচন কমিশনকে এগুলো নিয়ে অনেক অভিযোগ দিয়েছি, কিন্তু তারা কর্ণপাতই করছে না।

“এভাবে কি নির্বাচন সুষ্ঠু হবে?”

বুধবার ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন উত্তরে ধানের শীষের মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। পশ্চিম পদরদিয়া, পূর্ব পদরদিয়া হয়ে সাঁতারকুল, ইসলামবাগ ও মগাইরে অলি-গলি ঘুরে নিজের পাশাপাশ দল সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর জন্যেও ভোট চান তিনি।