শুক্রবার বাজেট পরবর্তী পর্যালোচনায় সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তার প্রতিষ্ঠানের মতামত তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “ব্যয় নিয়ে আমাদের চিন্তা না, চিন্তা অর্থের উৎস নিয়ে।”
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেছেন, তাতে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের ফর্দ দেওয়া হয়েছে। আর এই ব্যয় মেটাতে দুই লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা রাজস্ব বাবদ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন তিনি।
বাজেট পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, “এখন যে ব্যয় ধরা হচ্ছে তা বাংলাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না। সেই অর্থে একে তথাকথিত উচ্চাভিলাষী বাজেট আমরা বলি না।
“আমাদের দেশে জিডিপির ১৭ শতাংশ হল রাষ্ট্রীয় ব্যয়। আমাদের সঙ্গে তুলনীয় অনেক দেশ আছে, যারা জিডিপির ২২ শতাংশের উপরে ব্যয় করে। বাংলাদেশও এখানে আরও বাড়াতে হবে। কিন্তু এটার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ কোথা থেকে আসবে তাও বের করতে হবে।”
বাজেট প্রস্তাবে মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আয়ের পরিকল্পনা দেখিয়েছেন মুহিত। এই অর্থের ৬০ শতাংশই আসবে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর থেকে।
তবে এই লক্ষ্য অনুযায়ী বাজেটের অর্থায়ন সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান সিপিডির গবেষকরা।
মুহিতের বাজেট প্রস্তাবে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি রয়েছে ৮৬ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ৫ শতাংশ।
এই ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ হিসাবে ৫৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনার পাশাপাশি বিদেশি সহায়তা হিসাবে ৩০ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা পাওয়ার আশার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী।
এ বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, “ব্যয় মেটাতে রাজস্ব উদ্বৃত্ত বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে না। ফলে সম্প্রসারণশীল বাজেট দিতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপড় নির্ভরতা বাড়ছে।”
আবার প্রতিশ্রুত বিদেশি সহায়তাও ব্যবহার করা যাচ্ছে না মন্তব্য করে ‘এই কাঠামো ভেঙে বের হওয়ার’ ওপর জোর দেন সিপিডির ফেলো।
“অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর নির্ভর করে যে বাজেট কাঠামো দেওয়া হচ্ছে, তা মন্দাকালীন সময়ে চললেও এটা অব্যাহত থাকতে পারে না। অর্থায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন না এলে সম্প্রসারণশীল মডেল অব্যাহত রাখা কঠিন হবে।”
প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী প্রায় চার বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা ব্যবহারের যে লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছেন তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দেবপ্রিয় বলছেন, “বাজেট ঘাটতি মেটাতে হলে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিদেশি সহায়তা ব্যবহারের প্রয়োজন হবে। আর এটা না করতে পারলে ব্যাংক ঋণের নির্ভরতা বাড়বে।”
আর এর আগে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি সহায়তা ব্যবহারের অভিজ্ঞতা না থাকায় পাঁচ বিলিয়ন ডলার ব্যবহারের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারকে আগামী ‘তিন বছর’ ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরশীল থাকবে বলেও দেবপ্রিয়র ধারণা।
মুহিত যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তার আকার জিডিপির ১৭ দশমিক ২ শতাংশ এবং রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার আকার জিডিপির ১২ দশমিক ১ শতাংশ।
এই ব্যয় ‘বেশি’ না হলেও রাজস্ব আদায় জিডিপির ১৮ শতাংশে উন্নীত করতে হবে বলে মনে করছেন দেবপ্রিয়।
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে সড়ক অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পল্লী উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠান।
দেবপ্রিয় মনে করছেন, উন্নয়নের জন্য ভৌত অবকাঠামোতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন হলেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো খাতে আরও বরাদ্দ দরকার।
উন্নয়ন প্রকল্প নির্ধারণ ও ‘সঠিক সময়ে প্রকল্প শেষ না করতে পারারও’ সমালোচনা করেন তিনি।
দেবপ্রিয় বলেন, বাংলাদেশে নতুন বাজেট নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হলেও বিদায়ী বাজেটের অর্জন নিয়ে পর্যালোচনা থাকে না। বিদায়ী বছরের লক্ষ্য অর্জনের তথ্যও বাজেটে রাখার দাবি জানান তিনি।
অর্থায়ন নিয়ে মুহিতের সমালোচনা করলেও রাজস্ব আদায়ে তার বেশকিছু পদক্ষেপের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন দেবপ্রিয়।
“করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা একমত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎসে কর বাড়ানোরও পক্ষে আমরা।”
পোশাক রপ্তানির ওপড় উৎসে কর বৃদ্ধিকে যৌক্তিক মনে করলেও চিনির আমদানি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব ‘ইতিবাচক হয়নি’ বলে সিপিডি মনে করে।
আর মোবাইল ফোনের সিম বা রিমের মাধ্যমে সেবায় ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপের প্রস্তাব সবার ক্ষেত্রে আরোপ না করে ন্যূনতম একটি ব্যয়সীমা পর্যন্ত ছাড় দেওয়ার পরামর্শ দেন দেবপ্রিয়।
সিপিডির বাজেট বিশ্লেষণে বলা হয়, সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে পদ্মা সেতু ও রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ সময় ধরে চললেও অন্যগুলোর ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম।
প্রথমবারের মতো ‘শিশু বাজট’ হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে ‘একদিন প্রবীণদের জন্যও বাজেট তৈরি হবে’ বলে আশা প্রকাশ করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়ানো ‘অত্যন্ত ইতিবাচক’ মন্তব্য করে বলা হয় এই ভাতা ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করায় সিপিডি খুশি।
এবার জেলা বাজেট সম্পর্কে কিছু না থাকায় হাতাশা প্রকাশ করেন দেবপ্রিয়। তার মতে, বাংলাদেশের সামরিক ব্যয় ভারত বা পাকিস্তানের তুলনায় ‘অনেক কম’।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, কোনো দেশের মাথাপিছু আয় বছরে ১১ শ’ থেকে ৪ হাজার ডলার হলে নিম্ম মধ্য আয়, ৪ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার হলে মধ্য আয় আর ১২ হাজার থেকে উপরের আয়ের দেশকে উন্নত দেশ বলা হয়।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশ হতে হলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তখন ১২ হাজার ডলারের বেশি হতে হবে।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “কিন্তু আমারা টার্গেট অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারছি না। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চলতি অর্থবছরে ৮ ভাগ জিডিপি প্রবৃদ্ধির টার্গেট থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ১০ বছর মেয়াদী প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় ২০২০ সালে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য রয়েছে। সেভাবে যদি আমরা যেতে পরতাম তাহলে এক প্রজন্মে মাথাপিছু জাতীয় আয় ৮ গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব। ওই রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু এখন তো আমরা পিছিয়ে পরলাম। প্রবৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত করতে পারলে পারব, না হলে পারব না। এখন পথটা কঠিন হয়ে গেল।”
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের বিষয়টিও সিপিডির সংবাদ সম্মেলনে আসে।
নির্বাহী পরিচালক বলেন, “এখন আমাদের বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার। ভারতের প্রথম এক বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ২০ কোটি ডলার পদ্মা সেতুতে অনুদান গেলেও বাকি অর্থ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন খুবই শ্লথ। ভারতকে ট্রানজিটসহ যোগাযোগ সুবিধা দিতে হলে অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ দরকার।”
বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে স্বল্প সুদে দীর্ঘ মেয়াদে ২/৩ বিলিয়ন ডলার লাগলে তা ভারতের ‘দেওয়া উচিৎ’ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত কয়েক বছর ধরে অবকাঠামোগত দুর্বলতা বেসরকারি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ বছরও পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কোনো আশা তিনি দেখছেন না।