বাংলাদেশি পণ্যে জিএসপি স্থগিত করল যুক্তরাষ্ট্র

কারখানার কর্ম পরিবেশের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের পণ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2013, 08:38 PM
Updated : 27 June 2013, 11:03 PM

গত কয়েক মাসের শুনানির পর বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত ২টার দিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল ফ্রোম্যান এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।

ফ্রোম্যান বলেন, “প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা স্থগিত করা হলো।”

প্রেসিডেন্ট ওবামার আদেশে বলা হয়, ‘আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের পাওয়া জিএসপি সুবিধা এখন স্থগিত করাই শ্রেয়… কারণ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকারগুলো বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ বাংলাদেশ নেয়নি।”

পোশাক কারখানায় বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় শত শত শ্রমিকের মুত্যুর পর কারখানার পরিবেশ উন্নত করা, শ্রমিকের বেতন বাড়ানোসহ সরকারের নানা উদ্যোগের মধ্যেই ওবামার এই ঘোষণা এলো।

জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেসের (জিএসপি) আওতায় বাংলাদেশ পাঁচ হাজার ধরনের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি করতে পারত, যদিও এর মধ্যে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক নেই।

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা গতবছর জিএসপির আওতায় তিন কোটি ৪৭ লাখ ডলারের তামাক, ক্রীড়া সরঞ্জাম, চিনামাটির তৈজসপত্র ও প্লাস্টিক সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করেছেন, যাতে তারা শুল্ক ছাড় পেয়েছেন ২০ লাখ ডলারের মতো। আর ৪৯০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে শুল্ক বাবদে দিয়েছেন ৭৩ কোটি ডলার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি বাতিলের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের ২০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক খাত সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা হয়তো নেই, কিন্তু এই সিদ্ধন্তে প্রভাবিত হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নও যদি একই ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। 

ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি দামের পোশাক কেনে, যা বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৬০ শতাংশ। ইউরোপের বাজারে শুল্কমুক্তি সুবিধা হারালে বিপুল অংকের ডলার বাংলাদেশকে গুণতে হবে কর বাবদে। 

গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংগঠন ‘আমেরিকান অর্গানাইজেশন অব লেবার-কংগ্রেস ফর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এএফএল-সিআইও) বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বাতিলের আবেদন করে। তাদের অভিযোগ ছিল, পোশাক ও চিংড়ি খাত এবং রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) শ্রম অধিকার সংরক্ষিত হচ্ছে না এবং অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়।

এর ঠিক পরের মাসেই আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে ১১০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়, যাতে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব এবং শ্রমিক অধিকারের বিষয়গুলো নতুন করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসে।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গত জানুয়ারিতে জিএসপি সুবিধার বিষয়টি পর্যালোচনার উদ্যোগ নেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কমিটিতে এ বিষয়ে শুনানির মধ্যেই গত ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩০ জনের মৃত্যু হয়, যাদের অধিকাংশই পোশাক শ্রমিক। এ ঘটনায় নতুন করে সংশয়ের মুখে পড়ে বাংলাদেশের জিএসপি-ভাগ্য। ঘটনার পরদিন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বলেছিলেন, এ ঘটনা জিএসপির ভাগ্যনির্ধারণীতে প্রভাব ফেলবে।

তাজরীন ফ্যাশনস ও রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে ১২ শ’র বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি মাইকেল ফ্রোম্যান বলেন, “জিএসপি সুবিধা স্থগিতের এই সিদ্ধান্তের পাশাপাশি আমাদের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নতুন করে কাজ শুরু করা, যাতে শ্রমিক অধিকারের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে তারা যথাযথ পদক্ষেপ নেয়।  

“বাংলাদেশ তাদের পণ্যে আবার শুল্কমুক্ত সুবিধা ফিরে পাক- তা আমরা চাই। কিন্তু সেজন্য আমরা কর্মক্ষেত্রের নিরাপদ ও যথাযথ পরিবেশও দেখতে চাই।”

তবে বাংলাদেশি পণ্য আমদানি বন্ধের কোনো পরিকল্পনা এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নেই বলেও জানান ফ্রোমান। 

যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক সংগঠন এএফএল-সিআইওর সভাপতি রিচার্ড ট্রুমকা বলেন, “যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্তি সুবিধা পাচ্ছে, তাদের সবার জন্যই এ সিদ্ধান্ত একটি স্পষ্ট সংকেত। যারা কর্মক্ষেত্রের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে না এবং শ্রমিকদের ইউনিয়ন করার মতো ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তারা যে কোনো সময় যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সুবিধা হারাতে পারে। 

একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে, ২০১১-১২ অর্থবছরের বাংলাদেশ মোট রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়েছে মোট রপ্তানির ২১ শতাংশ (৫০০ কোটি ডলার)।

২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার পর এর আগেও দুবার এ সুবিধা বাতিলের আবেদন ওঠে। অবশ্য শুনানি শেষে রায়ে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বহাল থাকে।