‘দেয়ালে পিঠ ঠেকলেই আমরা উঠে দাঁড়াই’

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2013, 01:08 PM
Updated : 15 Jan 2013, 01:08 PM

নানা সমালোচনার মধ্যেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলে আসছেন, চার বছরে গণতান্ত্রিক শাসনে দেশের অর্থনীতি মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। এর সপক্ষে বিভিন্ন সূচকও প্রমাণ হিসেবে টানেন তিনি। তবে তার হতাশা, এই নিয়ে দেশে প্রচার নেই।বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদক আবদুর রহিম হারমাছিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই সব বিষয়ে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী, বলেছেন দেশের মানুষের সম্ভাবনার ওপর তার আস্থার কথা।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম:  বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থানকে আপনি কীভাবে দেখেন এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের ভোক্তার সঙ্গে এর তুলনা কীভাবে করবেন?

আবুল মাল আবদুল মুহিত: একটি শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। কারণ এটা উৎপাদন বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে। অবশ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভূমিকার সমালোচনাও করা যায়। ধরুন, আমরা যখন গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া শুরু করি, তখন অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারকে আমরা প্রাথমিকভাবে বেছে নিয়েছিলাম এবং তখন কেউ কেউ তাতে আপত্তি করেন। তারা বলেন যে এতে ‘তেলা মাথায় তেল’ ঢাকা হবে। দরিদ্রদের কল্যাণের লক্ষ্যে আমাদের শিক্ষা বা স্বাস্থ্য সেবার মতো কর্মসূচি থাকলেও এই সমালোচনা আংশিকভাবে সত্য।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় আমাদের এই ধরনের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল না, বরং ৭০ শতাংশ মানুষ ছিল দরিদ্র। ১৯৮৩ সালে জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ অর্থাৎ এক কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত হয়। আর এখন সেখানে জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ অর্থাৎ পাঁচ কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। মধ্যবিত্তের বিকাশ অভ্যন্তরীণ বাজার বিকাশের পথ থৈরি করেছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এই বিকাশ আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছে। ভারত ও চীনে একই ঘটনা ঘটেছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনার মতে আমাদের কী কী গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে, যা আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নেবে?

আবুল মাল আবদুল মুহিত:  সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপাদান হচ্ছে, আমাদের জনশক্তির বিপুল সংখ্যক তরুণ। আমি মনে করি, আগামী আরো ১৫ থেকে ২০ বছর আমরা এ সুবিধা পাব। বাংলাদেশের একটি বড় গুণ হচ্ছে, প্রয়োজনে যখন ‘দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে যায়’ তখন আমরা উঠে দাঁড়াই।

একটি দৃষ্টান্ত হলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য। জন্ম নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করে আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছি। আমরা ভারতের চেয়েও এগিয়ে গেছি। মূলধারার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নারীর সম্পৃক্ততা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি নিশ্চিত করেছি। অথচ যখন এই পরিবর্তনের সূচনা হয় প্রায় ২০ বছর আগে, তখন তাত্ত্বিক হিসাবে আমাদের দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতির কোনো উপাদানই ছিল না। আমরা এমন একটা জাতি যারা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি।

আমাদের একটি প্রধান শক্তি হচ্ছে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি, যার ওপর এখনো প্রায় ৭৩ শতাংশ মানুষ নির্ভরশীল। আমাদের গ্রামগুলো এত ঘন যে সেখানে খুব সহজেই নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া যায়। গ্রাম ও শহরে পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনে সফলতার মধ্য দিয়ে আমরা তা দেখিয়েছি। আরেকটি বিষয় সব জায়গায় আলোচনায় আসে - তা হলো আমাদের সহনশীলতা ও ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা। আমার মতে এটা আসলে আমাদের দেশের গরিবের সম্পদ।

রেমিটেন্সের ক্ষেত্রেও আমরা ভালো করছি। গত বছর আমাদের প্রবাসীরা ১৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স দেশে পাঠিয়েছেন। আমাদের জনশক্তি রপ্তানি বিশ্ব চাহিদার কারণে যে বাড়তেই থাকবে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আপনি কোথায় রাখবেন? একটি অগ্রসরমান অর্থনীতি হিসেবে আমরা কি এক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করছি?

আবুল মাল আবদুল মুহিত: বর্তমানে মোবাইল ফোনের অবাধ ব্যবহার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নিদর্শন। এর আগে সবুজ বিপ্লব হয়েছিল সাধারণ কৃষকের যুগোপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে। ২০০৬ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতা ছাড়ে, তখন দেশে কৃষি উৎপাদন ছিল দুই কোটি ৮০ লাখ টনের মতো। সেই উৎপাদন আজ দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৬০ থেকে ৭০ লাখ টনে। উন্নত বীজ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের ব্যবহার এবং সঠিক সেচের ব্যবহারের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে।

শুধু আধুনিক প্রযুক্তিই নয়, দক্ষতার উন্নয়নও এখানে প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে নৌকায় ইঞ্জিনের ব্যবহার সফল না হলেও আশির দশকে তা খুবই সফল হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও কমানো গেছে প্রযুক্তির প্রসারের কারণে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: কর ব্যবস্থার মধ্যে ব্যবসায় যৌথায়নের (কর্পোরেট) বর্তমান অবস্থাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? আরো ‘সাদা টাকা’ জনকল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য কখন আমরা কর্পোরেট খাত ও রাজস্ব কর্তৃপক্ষের মধ্যে স্বচ্ছ ও সুস্থ লেনদেন দেখতে পাব?

আবুল মাল আবদুল মুহিত: স্বাধীনতা উত্তর জাতীয়করণের পর কোনো শক্তিশালী কর্পোরেট গ্রুপ আমাদের না থাকায় এখানকার কর্পোরেট সংস্কৃতি এখনো বিকশিত হয়নি। কোনো ব্যক্তির উদ্যোগে একটি ব্যবসার প্রসার ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপও দিতে হয়। আমাদের সমাজ এমন একটি সমাজ, যেখানে তা গ্রহণ করা সময়সাপেক্ষ। আমরা আগে তো ব্যবসা বা শিল্পোন্নয়ন করিনি, যা ভারতে টাটা ও বিড়লারা করেছে। এখন কিছু গ্রুপ কর্পোরেট চরিত্র নিয়ে বিকশিত হওয়ার চেষ্টা করছে।

আমাদের কর্পোরেট কর ব্যবস্থাও ভালো নয়। কর আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা তাদের ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো’ মনে করি। এই ব্যবস্থা সংস্কারে আমি নিজেও তেমন কিছু করতে পারিনি। আমি আশা করি, কর্পোরেট কর ব্যবস্থা সংস্কারের একটা রূপরেখা আমি দিয়ে যেতে পারব।

কর্পোরেট কর হার হল ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে তা কমে ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ হয়। উচ্চ কর হার রাখার বদলে আমাদের করের আওতা বাড়াতে হবে।

কালো টাকার ব্যাপারে আমি বলতে চাই যে এখানে তিনটি বিষয় আছে। কর কাঠামো, দুর্নীতি ও করমুক্ত রেমিটেন্সই মূলত কালোবাজারের বৃহৎ পরিসরের জন্য দায়ী বলে আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে। আমাদের অর্থনীতির ৪২ থেকে ৬২ শতাংশই কালো টাকার।

পরিস্থিতি উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার পরও আমরা আরো কিছু পদক্ষেপের কথা ভাবছি। তবে মনে রাখতে হবে যে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতেও কালো টাকা আছে। এখন কালো টাকাকে সাদা করার একটি ভাল ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অপ্রদর্শিত আয়কে অতিরিক্ত জরিমানা ১০ শতাংশ দিয়ে সাদা করা যায়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনার মতে বাংলাদেশে ব্যবসার শক্তিশালী দিকগুলো  কী কী?

আবুল মাল আবদুল মুহিত: বাংলাদেশে ব্যবসার সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোগ। উদ্যোক্তারা সফল হওয়ার সুযোগের সন্ধান করে এবং প্রস্তুতকারীরা নতুন নতুন বাজার বের করে। মানের বিচারে একটু দুর্বলতা থাকলেও আমরা দেখেছি, যখন প্রয়োজন হয় তখন বাংলাদেশিরা মান উন্নয়ন করতে পারে।

আমাদের শ্রমিকরা তাদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে। সেই তুলনায় তারা তত লোভী নয়, বরং জীবনযাত্রার সামান্য উন্নতি হলেই তারা সন্তুষ্ট হয়। সাধারণ মানুষের প্রযুক্তি ও দক্ষতা অর্জনের সক্ষমতার জন্য আমাদের উৎসাহিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ব্যবসার ক্ষেত্রে পরিচালনা ও অর্থায়নের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

আবুল মাল আবদুল মুহিত: হ্যাঁ। পলিসির ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার সমস্যার মতো পরিচালনায়ও আমাদের কিছু সমস্যা আছে। নিচের স্তরে মানুষকে হয়রানি করা হয় এবং ছোট-খাটো  দুর্নীতি আছে। আমি মনে করি প্রযুক্তির ব্যবহারে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। বিশেষত ডিজিটালাইজেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে দুর্নীতি দূর করা সম্ভব।

অনলাইন লেনদেনের ক্ষেত্রে আমাদের সংস্কার প্রয়োজন। আমরা টেন্ডার অনলাইনে চালু করেছি এবং অনলাইনে কর দেয়াটাও আমাদের  নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের ব্যাংকদের অর্থায়ন প্রক্রিয়া খারাপ নয়। বেসরকারি খাতে সব নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের চর্চা আছে। অবশ্য দুর্নীতির জন্য অর্থায়নের পরিবেশও খারাপ  হয়ে পড়তে পারে যেমনটি হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে সরকারি খাতে প্রকল্প অর্থায়নে তেমন একটা সম্ভাব্যতা যাচাই হয় না। আমি পরিকল্পনা কমিশনকে বলেছি, বড় প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে সম্ভাব্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক করার একটি ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো তেমন আগ্রহী না থাকায় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে অর্থায়নের ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যায় পড়তে হয়। তাই এ সমস্যা সমাধানের পথ হচ্ছে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। এখন আইপিও ও রাইটস শেয়ারের মাধ্যমে মানুষ পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেছে। শেয়ারের দরে ওঠানামা থাকলেও আইপিও বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারি নিয়ে সম্প্রতি অনেক অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশে আমরা সন্দেহজনক লেনদেন থেকে কীভাবে মুক্তি পাব এবং বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা কীভাবে বাড়াতে পারে?

আবুল মাল আবদুল মুহিত: দুই ধরনের দুর্নীতি আছে। রাজনীতিকদের সম্পৃক্ততায় বড় ধরনের দুর্নীতি এবং ঘুষ আকারে ছোট পর্যায়ের দুর্নীতি। আমি আপনাদের বলতে পারি যে, উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনেরও ভাবমূর্তিও উন্নত হয়েছে। মনে করা হয় যে এটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে।

পদ্মা সেতু বিষয়ে আমি কখনো দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত ও মামলা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করিনি। অবশ্য ছোট পর্যায়ের দুর্নীতি যা অনেক সময় স্বল্প বেতনের কারণে বা সংস্কৃতির কারণে হয়ে থাকে তা নির্মূলে সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের আলোকে আমাদের বিচার ব্যবস্থায়ও সংস্কার আনার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি। সুপ্রিম কোর্টে আমরা যেভাবে দুটো ভাগ (ডিভিশন) করেছি, তাতে কাঠামোগত সমস্যা আছে। ন্যায় বিচারের স্বার্থে এ দুটো আলাদা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

আমাদের আমলাতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষেও আমি। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পর আমলাতন্ত্রের বেশিরভাগই জেলা প্রশাসনের আওতায় চলে যাওয়া উচিত। এ ধরনের উদ্যোগ জবাবদিহি বাড়াবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব থেকে প্রশাসনকে মুক্তি দেবে। আওয়ামী লীগের পরবর্তী নির্বাচনী ইশতিহারে এ বিষয়টি নিয়ে আসতে আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতা এবং বিশ্ব বাজারের অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যতে টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশের উদ্যোক্তা-শিল্পমালিকদের আপনি কোন ধরনের শিল্প গড়ে তুলতে বলবেন।

আবুল মাল আবদুল মুহিত: রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতা আছে এবং অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে। আমরা যা উৎপাদন করি, তার কেবল তিন ভাগের এক ভাগ আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রয় হয়। আমাদের রপ্তানি খাত ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। এবং আমি দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, আগামী দিনগুলোতে তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়বে। জাপানের মতো দেশ প্রথমে রপ্তানিনির্ভর প্রবৃদ্ধি নিয়ে শুরু করেছিল এবং পরে অভ্যন্তরীণ বাজারের দিকে নজর দিয়েছিল। এ রকম অবস্থায় পৌঁছতে আমাদের আরো সময় লাগবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: আপনি প্রায়ই বলেন, আমাদের বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। সরকারি ও বেসরকারি যে সব খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার সেগুলো একটু বলবেন? বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে কোন কোন খাতে সরকার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে?

আবুল মাল আবদুল মুহিত: বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি বাড়ানো সম্ভব নয়। আমাদের আইসিওআর (ইনভেস্টমেন্ট ক্যাপিটাল আউটপুট রেশিও) ধরা হয় ৪ অনুপাত ১, এ প্রোপোরশনের সঙ্গে আমি একমত নই। ২৫ শতাংশের মতো বিনিয়োগ নিয়ে আমরা সাত শতাংশের কাছাকাছি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছি। অবশ্যই আমাদের বিনিয়োগ বাড়িয়ে ৩২ শতাংশ বা তার উপরে নিয়ে যাওয়া দরকার। এজন্য প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এখন যেহেতু আমাদের সম্বন্ধে বিদেশিদের ধারণা ভালো, তাই বর্তমানের এক দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের এফডিআই আগামীতে বাড়বে বলে আমি আশা করি। সড়ক ও রেলওয়েসহ অবকাঠামো খাত বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বড় খাত। মেট্রো রেল ট্রানজিট নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন- আমি মনে করি সমগ্র জাতি এটা চায় এবং এর জন্য গর্ব করা উচিত।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: ব্যবসার উন্নয়নের জন্য অর্থমন্ত্রী হিসেবে আপনি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কী অগ্রগতি আনছেন? ব্যবসার জন্য প্রণোদণা কী কী?

আবুল মাল আবদুল মুহিত: বিনিয়োগ বোর্ডের সেবাগুলো আমরা পুরোপুরি ঝামেলামুক্ত করার চেষ্টা করছি এবং বোর্ডের প্রধান ড. এস এ সামাদ সেজন্য কাজ করছেন। আমাদের মতো দেশে নির্বাচিত সরকারের একটি প্রধান সমস্যা হলো সমন্বয়ের জটিলতা, যা সিঙ্গাপুরের মতো দেশের এক নায়কসুলভ সরকারের নেই। আমরা এই সমন্বয় আনার চেষ্টা করেছি। কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে একনায়কসুলভ সরকারের যে ব্যবস্থা রয়েছে তার থেকে আমাদের কিছু শিক্ষা নিতে হবে।

ব্যবসার প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যথাযথ তদারকির জন্য আমাদের কিছু সংস্থা গড়ে তোলার দরকার। তবে শুধু সরকারিভাবে জ্বালানির সরবরাহ হওয়ায় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই বলে মনে হয়। অবশ্য টেলিকম খাতের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন ভালো কাজ করছে বলে আমি মনে করি। আমার মতে, পরিবহন খাতের জন্যও আরেকটা নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকা দরকার।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি ব্যবসার প্রসারের জন্য শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের কীসের ওপর জোর দেয়া উচিত? বিদেশে চাকরির বাজারের ভবিষ্যৎ কী?

আবুল মাল আবদুল মুহিত: শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নেই আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিই এবং এর থেকে আমরা সুবিধাও পাচ্ছি। বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচক অনেক দেশের চেয়ে ভালো। দ্রুত শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে এবং আমি মনে করি, এখন আমরা মান উন্নয়ন করতে পারবো। প্রাথমিক পর্যায়ে উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে। তবে মাধ্যমিক পর্যায়ে মান খুবই হতাশাজনক, প্রকৃতপক্ষে একেবারে বাজে। আমরা শিগগিরই শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে পারব বলে আমি আশাবাদী।

বিদেশি চাকরির বাজার এখন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আগামী বছরগুলোতেও তা থাকবে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রতিবছর যে শ্রমিকগোষ্ঠির সৃষ্টি হয় তার এক তৃতীয়াংশ বিদেশে কাজ করছে। আমি চাই আমাদের এই জনশক্তির অর্ধেক বিদেশে কাজ করুক এবং বিশ্বায়নের যুগে এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা কর্মসংস্থান এবং বিদেশি মুদ্রা অর্জনের একটা বড় উৎস হিসেবে কাজ করছে ও করতে থাকবে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: গত পাঁচ দশক বা তার বেশি সময়ে বাংলাদেশের উন্নয়নকে আপনি কীভাবে দেখেন? আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশ নিয়ে আপনি স্বপ্ন দেখেন এবং আপনার মতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কেমন হবে?

আবুল মাল আবদুল মুহিত: স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হার বেশ ভালো ছিল। এমনকি সবচেয়ে কঠিন সময় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্তও আমরা দ্রুত উন্নয়ন সাধনে সক্ষম হই, অর্থনীতির পুনর্বাসন করি এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করি। তখনও গড় প্রবৃদ্ধির হার চার শতাংশের কাছাকাছি ছিল।

রাজনৈতিক বিরোধ সত্ত্বেও নব্বইয়ের দশক থেকেই উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। সামরিক শাসনামলের ১৬ বছর প্রবৃদ্ধি তুলনামূলক কম ছিল। তারা শিক্ষার অবক্ষয় ঘটায়, প্রশাসনকে বিনষ্ট করে, দুর্নীতিকে সর্বগ্রাসী করে এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্য উৎপাদন দুই খাতকেই অবহেলা করে।

আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বেকারত্বের হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে অগ্রগতি লাভ করেছি। ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছি শিক্ষা ক্ষেত্রে। মানব সম্পদ উন্নয়নে অগ্রগতি, সদ্যজাত শিশু মৃত্যু হার হ্রাস, রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয় বৃদ্ধি, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়াও অনেক অগ্রগতি রয়েছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে আরেকটি হচ্ছে- দারিদ্র্য কমিয়ে আনা।

২০২১ সাল নাগাদ আমি একটি ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। অর্থাৎ সরকারের সব পর্যায় ও দেশের শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার হবে। টেক্সটাইল ও পোশাক খাতের পর এই তথ্য প্রযুক্তি খাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। দেশে স্বল্প আয়তনের একটি কেন্দ্রীয় সরকার থাকবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও দায়িত্বের ব্যাপক প্রতিসংক্রম হবে জেলা পর্যায়ে অর্থাৎ স্থানীয় সরকার হবে শক্তিশালী। কার্যকর এবং দেশের বাজেটের বৃহদাংশ তারা বাস্তবায়ন করবে। ভোটের হিসাবে পার্লামেন্টে সব দলের সংখ্যানুপাতিক অংশগ্রহণের পক্ষে আমি। শাসন ব্যবস্থায় এরকম পরিবর্তন আনা গেলে দলীয় রাজনৈতিক বিভেদের দুর্ভাগ্যজনক আচরণের অবসান হবে।

(গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী ভারত সফরে যাওয়ার আগে সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়।)