ডলার সংকট: জ্বালানি তেল আমদানির এলসি নিয়ে ‘জটিলতা’, ব্যাংক বলছে ‘থেমে নেই’

ডলার সংকটের চলমান প্রেক্ষাপটে জ্বালানি তেল আমদানিতে ঋণপত্র খোলা ও আগের মূল্য পরিশোধে ‘ধীরগতিতে’ তৈরি হওয়া জটিলতার পেছনে ব্যাংকের ‘দায় দেখছে’ বিপিসি; তবে ‘সাধ্যমত’ সবকিছু চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো।

রিয়াজুল বাশারও শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2022, 07:28 PM
Updated : 18 July 2022, 03:45 AM

দেশে জ্বালানি তেল আমদানির দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কোম্পানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) গায়েও সম্প্রতি আঁচ লেগেছে ব্যাংকিং খাতে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের অস্থিরতা বিশেষ করে চড়তে থাকা ডলারের উত্তাপ।

আমদানি ছাড়াও তেল পরিশোধন ও সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর তদারকি সংস্থাটি বলছে, ব্যাংকগুলো আগের মত তেল আমদানির এলসি খুলছে না।

বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকগুলো ডলার সমস্যার কারণে (এলসি খুলতে) বিলম্ব করছে। অনেক সময় পার্টলি পেমেন্ট করছে। যেটা হয়ত একদিনে হতে পারে সেটা হয়ত পাঁচদিনে/সাতদিনে হচ্ছে।”

এ অবস্থা দীর্ঘায়িত হলে ‘সরবরাহকারীদের আস্থা নষ্ট হয়ে জ্বালানি নিরাপত্তায় বিঘ্ন’ সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা তার।

তবে তেল আমদানিতে বিপিসির এলসি (ঋণপত্র) খোলা ও আগের এলসির দায় পরিশোধের কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রধান দুই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সোনালী ও অগ্রণীর প্রধানরা এ কার্যক্রমের ‘দুয়ার বন্ধ’ করার মত কোনো ঘটনা দেখছেন না। আগের মতই তেলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির সঙ্গে আলোচনারভিত্তিতে নিয়মিত কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে দাবি তাদের।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী, রূপালী ও জনতা ব্যাংক ছাড়াও বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, ওয়ান ও ইস্টার্ন ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে থাকে বিপিসি। এরমধ্যে বেশির ভাগ কার্যক্রম হয়ে থাকে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে।

বাংলাদেশ মূলত অপরিশোধিত তেল কেনে সৌদি আরবের সৌদি অ্যারামকো এবং আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি থেকে।

আর পরিশোধিত তেল সরবরাহ করে কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারতের আটটি কোম্পানি। এর মধ্যে চীনের কোম্পানি দুটি।

বিপিসির হয়ে এসব কোম্পানির সঙ্গে এলসি খোলা ও লেনদেনের কাজ করে নির্দিষ্ট ওইসব ব্যাংক। সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, জুলাইয়ে ১০টি এলসি খোলা হয়েছে। আরও পাঁচটির আবেদন বিভিন্ন ব্যাংকে জমা আছে।

জ্বালানি তেল আমদানির বেশির ভাগ এলসি করে দেয় সরকারি ব্যাংকগুলো। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে খুব কমই এলসি হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন বিপিসির কর্মকর্তারা।

এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি করতে তাদের সমস্যা হচ্ছে। তবে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংক বেশি গড়িমসি করছে।

আগামী বুধবার থেকে অগাস্টে আমদানির জন্য ১৬টি এলসি খোলার আবেদন শুরু হবে বলে জানান বিপিসির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।

এমন জটিলতার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জ্বালানি আমাদের অগ্রাধিকার বিষয়। ব্যাংকগুলোর চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখেই ডলার সরবরাহ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকেও বলা হচ্ছে ডলার সোর্সিং করতে। রিজার্ভের মজুদের বিষয়টিও দেখতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে।”

“বাংলাদেশের কোনো আমদানি দায় বকেয়া নেই। পরিশোধের দিক দিয়ে এই সুনাম বাংলাদেশের রয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

বেশ কয়েক মাস থেকে প্রতিদিন ডলার সংগ্রহে হিমশিম খাওয়া ব্যাংকিং খাত এখন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সতর্ক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ডলার সাশ্রয়ে কড়াকড়ি আরোপের পথেই চলছে।

ব্যাংকার ও আমদানিকারকরা বলছেন, রিজার্ভ থেকে দেদারসে ডলার বিক্রি করেও চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না; টাকার বিপরীতে দেশের প্রধান এ বৈদেশিক মুদ্রার দাম বেড়েই চলেছে। এর প্রভাব পড়ছে সব খাতেই, যেটির বাইরে নয় জ্বালানি খাতও।

জ্বালানি বিভাগের শঙ্কা

কোভিড মহামারী থেকে পুনরুদ্ধারের সময় চড়া হয়ে পড়া জ্বালানির বাজারে রাশিয়া ও ইউক্রেইন যুদ্ধ নতুন করে প্রভাব ফেলেছে। ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে চাপে পড়েছে বিপিসিও।

ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনেও। প্রায় শতভাগ জ্বালানি তেল আমদানি করা বাংলাদেশের পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৪ শতাংশ তেল নির্ভর।

অপরদিকে সরকারও দাম বেড়ে যাওয়ায় এলএনজি কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।

এসব কারণে এলসি জটিলতায় তেল আমদানি বিঘ্নিত হলে বিদ্যুৎসহ অন্যান্য খাতে বিরুপ প্রভাবের আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

এমন প্রেক্ষাপটে ‘জ্বালানি তেল আমদানির অর্থাৎ এলসি খোলার জটিলতা ও প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের বিষয়টি’ সমাধানে সহায়তা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

গত ৫ জুলাই পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, জ্বালানি তেল আমদানির জন্য বিপিসিকে প্রতি মাসে ১৬ থেকে ১৭টি আমদানির এলসি খুলতে হয়।

“সম্প্রতিকালে অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে ব্যাংকগুলো বিপিসির চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে প্রায়শই অপারগতা প্রকাশ করছে। এলসি খুললেও মূল্য পরিশোধে বিলম্বসহ একাধিক কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করছে।”

চিঠিতে বলা হয়েছে, “ফলে জ্বালানি তেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের অবনতিসহ জ্বালানি তেল আমদানি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

“বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রয়োজনীয় পরিমাণ ডলারের সংস্থানসহ চাহিদা অনুযায়ী এলসি খোলা সম্ভব না হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে মর্মে বিপিসি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।”

ছবি: রয়টার্স

সবাইকে ‘আপডেট’ রাখতে চাইছে বিপিসি

এলসি খোলার বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান আজাদ বলেন, “আগের মত রেগুলার না, সমস্যাটা রয়েছে। এটা একেবারে যে স্থায়ী কোনও সমস্যা সেরকম না। এলসি আলটিমেটলি খোলা হচ্ছে বা এলসি পেমেন্ট হচ্ছে। কিন্তু বিলম্বে হচ্ছে আরকি।

“আমাদের জন্য সমস্যা এই কারণে যে, সাপ্লায়াররা অনেক সময় এই বিলম্বটাকে গ্রহণ করতে চায় না। তারা আগে রেগুলারলি পেয়েছে- এটা জেনেই তারা অভ্যস্ত।”

এলসির সমস্যার কারণে সরবরাহে কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সমস্যা একেবারে স্মুথ হয়ে গেছে এটা বলার উপায় নাই।

“এখন পর্যন্ত সেই সমস্যা (তেল আমদানির সরবরাহ) হয়নি। কিন্তু এই জাতীয় ধীরগতি হতে থাকলে সরবরাহকারীদের আস্থা নষ্ট হবে। সেক্ষেত্রে তারা যদি তেল সরবরাহ দিতে না চায় তাহলে আমাদের করার কিছু থাকবে না।”

সরবরাহ চেইনে সমস্যার শঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “আলটিমেটলি আমরা আশঙ্কা করছি যে, সাপ্লাই চেইনে সমস্যাটা হতে পারে। যে কারণে আমরা সবসময় সরকার এবং অন্যান্য সংস্থার নজরে রেখে ব্যাংকগুলোকে আপডেট করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

আস্থার বা সম্পর্কের কারণে এখন পর্যন্ত সরবরাহকারীরা ভালো ব্যবহার করছে বলেও মন্তব্য করেন বিপিসি চেয়ারম্যান।

বিপিসির হিসাবে, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩০ লাখ ৬৩ হাজার টন বিভিন্ন ধরনের পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয়েছে। এসময় অপরিশোধিত তেল এসেছে ৮ লাখ ৭০ হাজার টন।

সেবাদাতা প্রধান ২ ব্যাংক কী বলছে

এলসি বিষয়ক জটিলতা নিয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আতাউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তো বিপিসির এলসি খুলছি। কই তেমন কোনো সমস্যা তো দেখছি না। গত পরশু (বৃহস্পতিবার) আমরা তো বিপিসির ৬০ মিলিয়নের এলসি খুলেছি।”

তার মতে, শুধু কয়েকটি ব্যাংক না, সব ব্যাংক মিলে ভাগে ভাগে বিপিসির এলসি খোলা হলে ‘কারো উপর বেশি চাপ পড়বে না’।

এলসি খোলা ও দায় পরিশোধ নিয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অগ্রণী ব্যাংক কখনই বিপিসির এলসি খোলার দুয়ার বন্ধ করেনি। আমরা সব সময় বিপিসির সঙ্গে আলোচনা করেই তেল রপ্তানিকারকদের দায় পরিশোধ করছি। ডলার সংকটের অবস্থার আলোকে যখন যেভাবে বিপিসি বলছে সেভাবেই পরিশোধ করা হচ্ছে।

“রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক হিসেবে আমরা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো অগ্রাধিকার দেই। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও ডলার কিনতে সার্পোট পেয়ে আসছি। বিপিসির জন্য কিছু ডলার কিনতেও হয় অগ্রণী ব্যাংককে। তার ব্যবস্তা করতে হয় অন্য ব্যাংক থেকে।“

উভয়ই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিপিসিকে এলসির বিপরীতে শূন্য মার্জিন (কোনো কমিশন চার্জ) ছাড়াই এলসি সেবা দিত সরকারি ব্যাংকগুলো। এ নিয়ে দ্বন্দ্বও পুরনোও।

আবার জ্বালানি তেলের এলসির দায়ও বড় অঙ্কের হওয়ায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমেও পণ্য আমদানি শুরু করে বিপিসি। সাম্প্রাতিক সময়ে ডলার সংকট শুরু হলে সোনালীসহ দুটি ব্যাংক এলসি খোলায় ‘গড়িমসি’ শুরু করে বলে বিপিসির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়।

এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে ডলার কেনার খরচ বাড়ার বিষয়টি সামনে এলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে বাড়তি দামে ডলার কেনার খরচ দিতে রাজি হয় বিপিসি। এরপরও চাহিদা অনুযায়ী তেলের এলসি খোলা না হওয়ার কথা বলা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে পরিশোধ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন; শতকরা হারে বেড়েছে ১০৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

এসময়ে এলসি খোলার পরিমাণও বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের, আগের অর্থবছরের একই সমসয়ে যা ছিল ৩ দমশিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছে ১১১ শতাংশ।

আরও পড়ুন