কোভিড মহামারীর সংক্রমণ কমলে অর্থনীতিতে দ্রুত চাহিদা তৈরির সময়কালে ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানি ও তেলসহ আন্তর্জাতিক পণ্য বাজার চড়তে থাকে; যাতে বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি ভোগান্তি তৈরি করছে বাংলাদেশের জনজীবনেও।
অর্থনীতির এ সংকটের মধ্যে চাহিদার তুলনায় ডলার সরবরাহ কমে গেলে দেশের মুদ্রাবাজারে প্রধান এ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়েও অস্থিরতা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান দ্রুত কমছে। এ নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারক ও অর্থনীতিবিদরা দুশ্চিন্তার কথাই বলছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং ডলারের চলমান সংকট সামাল দিতে কৌশল নির্ধারণে সরকারকে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ‘সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ’ নিয়ে এপ্রিলের মাসওয়ারি এ প্রতিবেদন গত ২৬ জুন প্রকাশ করা হয়।
এতে ২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়ায় অর্থনীতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও বিশ্লেষণ করা হয়।
এতে বলা হয়, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া বেড়ে যাওয়া মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির জন্য সহায়ক হলেও তা সামনের দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতি ও ‘ব্যাংক ঋণের সুদহার’’ বাড়ানোর প্রবণতাকে উসকে দিতে পারে। এর প্রভাবে ইতোমধ্যে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার অনেক বেড়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ঘোষিত ‘সংকোচনমুখী’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে অর্থের জোগান আরও কমানো এবং রেপো (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদহার আরও এক দফা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন পদক্ষেপের ঘোষণা দিলেও সরকারকে রাজস্ব নীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ‘সমাধান খোঁজার’ পরামর্শ দিয়েছেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘আমদানি পর্যায়ে শুল্ক সমন্বয়ের মাধ্যমে, অর্থের প্রবাহ ঠিক রাখতে ঋণের বিশেষ স্কিম গঠন করা যেতে পারে। এদিকেই বেশি নজর দেওয়া দরকার।’’
অপরদিকে প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশের বিষয়ে আগেই পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। গত ১৭ মে একনেক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণে নির্দেশনা দেন।
প্রধানমন্ত্রী এখনই জরুরি নয় এমন প্রকল্প কিছুটা ধীর গতিতে বাস্তবায়নের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বৈশ্বিক এ মন্দার সময়ে’ বেছে বেছে প্রকল্প নিতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির উপর চাপ কমাতে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান তিনি।
দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পের ব্যয় বুঝে শুনে করা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘বাংলাদেশ ব্যাংক যে আশঙ্কা করে সরকারি প্রকল্পের ব্যয়ে সংযত হওয়ার কথা বলছে, তার কিছু উদ্যোগ সরকার ইতোমধ্যেই নিয়েছে।
“বেশ কিছু প্রকল্পের বেলায় দেখা গিয়েছে। এখন বিকল্প হিসেবে বৈদেশিক উৎস থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে তা ব্যবহারে আরও যত্নবান হওয়া উচিত সরকারের।’’
ব্যাংক থেকে সরকার নিয়েছে কত?
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নেয় ৩৪ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা; যা জাতীয় বাজেটে নেওয়া লক্ষ্যমাত্রার ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
তবে গত ২৬ জুন পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ পর্যবেক্ষণটি দেওয়ার পরও আরও সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়েছে সরকার।
সরকারের ব্যাংক ঋণ বেড়ে যাওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ‘‘মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে যাওয়া সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার দিক দিয়ে কাঙিক্ষত নয়। আর এটি সুদহারকে বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে উসকে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার অনেক বেড়েছে।’’
বিদায়ী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে সরকারের লক্ষ্য ব্যাংক থেকে ৮৭ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া। আর ব্যাংক বর্হিভূত খাত থেকে নেওয়ার লক্ষ্য ছিল ৩৭ হাজার কোটি টাকা; এর মধ্যে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি ৩২ হাজার কোটি টাকা।
গত এপ্রিল পর্যন্ত সরকার নিট সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়েছে ১৭ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। এটি লক্ষ্য মাত্রার ৫৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
এ হিসাবে এপ্রিল শেষে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস মোট ঋণ নিয়েছে ৫৫ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৪৪ দশমিক ৯ শতাংশ। গত অর্থবছরের এসময়ে (জুলাই-এপ্রিল) মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা, যা ওই অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ ছিল।
করোনাভাইরাস পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে অর্থনীতিতে ঋণ চাহিদা বাড়ার ফলে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধিও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে মূলত সরকারি ঋণ বাড়তে থাকে। অর্থবছরের শেষের দিকে তা আরও বেড়ে যায়। এপ্রিল শেষে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং মে মাসে যা ছিল ২৭ দশমিক ২০ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এ দুই মিলে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ।
সরকারের এ ব্যাংক ঋণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আগের চেয়ে গতি বাড়বে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এতে অর্থবছর শেষে জিডিপিতে কাঙিক্ষত উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। তবে সামষ্টিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে তা নেতিবাচক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘বৈশ্বিক কারণ ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বেড়ে যাওয়া এবং স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের উপরে রয়েছে।
‘‘ব্যাংকের সুদহার তো এখন বাস্তবিকভাবে মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় ঋণাত্বক হয়ে গিয়েছে অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির চেয়ে সুদহার কম। মানুষের সঞ্চয়ের প্রবণতা কমে যাচ্ছে। সেখানেও তো বিবেচনার বিষয় আছে। সঞ্চয় না পেলে ব্যাংকগুলো ঋণ দিবে কিভাবে?’’