পাচার অর্থ ফেরালে দায়মুক্তি থাকছে, স্থাবর-অস্থাবরে বাদ

বিদেশে পাচার করা অর্থে গড়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বৈধ করার সুযোগ সমালোচনার মুখে বাদ দেওয়া হলেও নির্ধারিত হারে কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে নগদ টাকা দেশে আনার সুযোগ ঠিকই থাকছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 June 2022, 06:19 PM
Updated : 29 June 2022, 06:19 PM

এ বিষয়টিসহ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু ক্ষেত্রে সংশোধনী এনে অর্থবিল ২০২২ বুধবার জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে।

এর ফলে সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশ থেকে আনা অর্থ দেশে সরকারের খাতায় বৈধ আয়ের তালিকায় যুক্ত করা যাবে। ওই আয়ের উৎসও জানতে চাওয়া হবে না।

অর্থমন্ত্রী কামাল গত ৯ জুন তার বাজেট প্রস্তাবে বিদেশে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রেও একই ধরনের সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ এবং অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর দিয়ে তা বৈধ করার সুযোগ দিতে বলেছিলেন। তবে অর্থবিল পাসের সময় তা বাদ দেওয়া হয়েছে।

নতুন একটি ধারাও যুক্ত করা হয়েছে সংশোধনে। কোনো বাংলাদেশির বিদেশে থাকা এমন সম্পদের খোঁজ যদি পাওয়া যায়, যে সম্পদের হিসাব আয়কর রিটার্নে দেখানো হয়নি, তাহলে জরিমানা করা যাবে ওই সম্পদের মালিককে।

উপ কর কমিশনার তদন্ত করে এমন সম্পদের খোঁজ পেলে সেই সম্পদের বাজারমূল্যের সমপরিমাণ জরিমানা করতে পারবেন। আর এই জরিমানা আদায়ের জন্য ওই ব্যক্তির নিজের অথবা তার প্রতিনিধির যে কোনো সম্পদ জব্দ করতে পারবেন উপ কর কমিশনার।

বিদেশে থাকা সম্পদ আয়কর রিটার্নে দেখানো না হলে উপ কর কমিশনার সম্পদের খোঁজে দেশের বাইরে তদন্তও করতে পারবেন।

এর পাশাপাশি কম হারে করপোরেট কর সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সংশোধন আনা হয়েছে পাস হওয়া অর্থবিলে।

প্রস্তাবিত বাজেটে বলা ছিল, যেসব কোম্পানি বছরে ১২ লাখ টাকার বেশি ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করবে, তারা কম হারে করপোরেট কর পরিশোধের সুবিধা পাবে। সংশোধনে তা ৩৬ লাখ টাকা করা হয়েছে।

এ ধরনের ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ১০ শাতাংশের বেশি লেনদেন হলে, তাদের কর্পোরেট কর সাড়ে ২২ শতাংশের বদলে কমে হবে ২০ শতাংশ। আর পরিশোধিত মূলধনের ১০ শাতাংশের কম লেনদেন হলে, তাদের কর্পোরেট কর ২৫ শতাংশের বদলে কমে হবে সাড়ে ২২ শতাংশ।

ওই শর্ত পূরণ হলে পুঁজিবাজারে অনিবন্ধিত কোম্পানির ক্ষেত্রে কর্পোরেট কর বিদ্যমান ৩০ শতাংশ থেকে কমে সাড়ে ২৭ শতাংশ হবে। এবং ব্যক্তি কোম্পানি ক্ষেত্রে এই কর ২৫ শতাংশ কমে সাড়ে ২২ শতাংশ করা হয়েছে।

বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর যে বাধ্যবাধকতা ছিল, তাও শিথিল করা হয়েছে। অর্থবিলে কেবল ব্যক্তি-শ্রেণির করদাতাদের জন্য রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

বুধবার জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সংশোধনী আনেন। পরে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়।

এর আগে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বিএনপির সংসদ সদস্যদের দেওয়া কিছু সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়। সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ১৭টি প্রস্তাব গ্রহণ করেন অর্থমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “অর্থনীতির এলাকায় স্বাভাবিক সময় বিরাজ করলে আমরা মাননীয় সদস্যদের প্রস্তাবনাসমূহের অনেক কিছু বিবেচনা করতে পারতাম। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মাননীয় সদস্যগণ কর্তৃক আনীত বাকি সংশোধনী প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করতে পারছি না বলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”

গত ৯ জুন জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় আলোচিত বিষয় হল বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কর দিয়ে বিনাপ্রশ্নে বৈধ করার সুযোগ।

অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান একে দেখছেন টাকা পাচারের ‘এক ধরনের স্বীকৃতি’ হিসেবে। আর সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, এ প্রস্তাব নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, অর্থনৈতিকভাবে যৌক্তিক নয় এবং রাজনৈতিকভাবেও জনগণের কাছে উপস্থাপনযোগ্য নয়।

বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন আইনি ভাষা দিয়ে।

তিনি বলেছিলেন, “বাজেটে টাকা পাচারের কথা বলা হয়নি। যেটা বলা হয়েছে বিদেশে অর্জিত আয়ের কথা। টাকা পাচারের বিষয়ে আইন আছে। ডিপার্টমেন্ট আছে। ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিট। এছাড়া অনেক সময় মিডিয়াতে বলা হয় সুইস ব্যাংকে টাকা রাখা আছে। সেটার ৯৫ শতাংশই বাংলাদেশের মানুষ বিদেশের মধ্যেই আয় করে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গিয়ে সুইস ব্যাংকে রাখছে এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।”

আর অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন মারফতি ভাষায়। তিনি বলেছিলেন, “প্রথমত টাকার একটা ধর্ম আছে। টাকা যেখানে বেশি সুখ বিলাস ও রিটার্ন বেশি পায়, সেখানে চলে যায়। টাকা যারা পাচার করে, সুটকেসে ভরে পাচার করে না। এখন ডিজিটাল যুগ। বিভিন্ন টুলস ও ইউনিফর্মসে টাকা পাচার হয়।”

মুস্তফা কামালের ভাষায়, “যেটা পাচার হয়ে গেছে সেটা এদেশের মানুষের হক। যদি বাধা দিই তবে আসবে না। যদি না আসে আমাদের লাভটা কী? আমরা চাই, অন্য দেশ যা করে, আমরা তাই করতে যাচ্ছি। ১৭টা দেশ অ্যামনেস্টি দিয়ে টাকা ফেরত আনছে।”