গ্রামে অর্থ জমা রাখার স্বাভাবিক ধারার বিপরীতে দুই বছর পর আমানত সামান্য কমলেও শহর এলাকায় বেড়েছে। এতে চলতি পঞ্জিকা বছরের মার্চ শেষে এর আগের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় দেশের ব্যাংকগুলোতে মোট আমানতের স্থিতি সার্বিকভাবে বেড়ে প্রায় ১৫ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
বছরের প্রথম প্রান্তিক জানুয়ারি-মার্চ সময়ে দেশে পরিচালিত ৬১টি তফশিলি ব্যাংকের পরিসংখ্যান নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ‘শিডিউলড ব্যাংকস স্ট্যাটিসটিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এতে দেখা যায়, বছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে গ্রামীণ এলাকায় আমানত দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা মোট আমানতের ২১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আগের তিন মাসের চেয়ে কমেছে ২৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা বা শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
গত ডিসেম্বর শেষে পল্লী এলাকায় আমানত ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। আর ২০২১ সালের মার্চ প্রান্তিক শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
গ্রামীণ জনপদে প্রতি প্রান্তিকেই আমানত বেড়ে আসার প্রবণতাই ছিল ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে। দুই বছর পর আগের তিন মাসের চেয়ে এবার তা সামান্য হলেও কমে গেল।
তথ্য বলছে, আগের তিন মাসের চেয়ে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে আমানত বেড়েছিল ২ দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং জুলাই-সেপ্টম্বরে ৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর গত বছরের জানুয়ারি-মার্চে এর আগের প্রান্তিকের চেয়ে বেড়েছিল শূন্য দশমিক ৯৩ শতাংশ।
কারণ কী?
গ্রামীণ এলাকায় আমানত কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের সঞ্চয় কমে যাওয়া ও ভেঙে ফেলাকে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন।
“কিন্তু মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় সেই অর্থ ফের যে কোনো মাধ্যম হয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলেই চলে গিয়ে সার্বিক আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধি হওয়ার কথা। কমে যাওয়ার অর্থ হল প্রবাসী আয় কমে গিয়েছে।”
“আমানত ভেঙে জীবন নির্বাহ করছেন মফস্বলে বসবাসকারীরা,’’ যোগ করেন তিনি।
বিভিন্ন জরিপের তথ্য এবং অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারসহ সংশ্লিষ্টদের মতে দেশে আসা রেমিটেন্সের সিংহভাগই যায় প্রবাসীদের গ্রামে বসবাসকারী স্বজনদের খরচ মেটাতে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনার সঙ্গে রেমিটেন্স পাঠাতে কাগজপত্রের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার পরও গত মে মাসে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচকই ছিল। আগের বছরের চেয়ে কমেছে ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। এর আগের মাস এপ্রিলেও ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি ছিল ।
আর মে পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে রেমিটেন্স এসেছে ১ হাজার ৯১৯ কোটি ডলার; আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে যা ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ কম। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট রেমিটেন্স এসেছিল দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার।
মোট আমানত বেড়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে ১২ কোটি ৭৩ লাখ ৫২ হাজারের বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ১৪ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। আগের তিন মাসের চেয়ে তা ২ হাজার ৪২২ কোটি টাকা বেশি; শতকরা হিসেবে বেড়েছে শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ।
চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে শহর এলাকার ব্যাংক হিসাবে আগের প্রান্তিকের চেয়ে আড়াই হাজার কোটি টাকা বেড়ে আমানত দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৮৯ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এ কারণেই গ্রামে সামান্য কমলেও আমানত বাড়ার ধারা বজায় রয়েছে বলে ব্যাংকাররা বলছেন।
গ্রামে ঋণও বাড়েনি ‘বেশি’
আমানতের পরিমাণ সামান্য এদিক সেদিক হলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ বিতরণের তথ্যে দেখা যায়, গ্রামে প্রথম প্রান্তিকে আগের প্রান্তিকের চেয়ে ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা। এ সময়ে শহরে ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা।
গ্রামে আগের প্রান্তিকের চেয়ে ঋণ বাড়ার হার ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এর প্রান্তিক অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে এ হার ছিল ৭ দশমিক ২৪ শতাংশ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আগের তিন মাসের চেয়ে বেড়েছিল ১ দশমিক ৯ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৯৬ শতাংশ ছিল গ্রামের। এক বছর পর ২০২২ সালের মার্চ প্রান্তিকে তা উন্নীত হয়েছে ১১.২৬ শতাংশ।
এ বিষয়ে জাহিদ হাসান বলেন, “করোনা টিকা দেওয়ার পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক তৎপরতা কিন্তু বেড়েছে। ওই সময়টিতে আমদানি বেড়েছে।
“এর কারণ হচ্ছে আগের দুই বছরে উৎসবকেন্দ্রিক বাণিজ্য হয়নি। এবার হয়েছে, উদ্যোক্তারা বিশেষ করে এসএমএই প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ চাহিদা বেড়েছে।”
ঋণের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে ঋণের স্থিতি ছিল ১২ লাখ ৩৬ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রামের ঋণ ১ লাখ ৩৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা এবং শহরে মোট ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা।
এ হিসাবে বিতরণ করা মোট ঋণের ৮৮ দশমিক ৭৪ শতাংশই শহরে এবং ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ গ্রামে বিতরণ করা হয়েছে। ২০২১ সালের মার্চে শহরে যা ছিল ৮৯ শতাংশ এবং গ্রামে ১১ শতাংশ।