কুয়াকাটার পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যারা কোনো না কোনোভাবে জড়িত, তাদের কাছে পদ্মা সেতুর হিসাবটা সহজ। কেবল কুয়াকাটা নয়, সুন্দরবনকেন্দ্রিক ট্যুর অপারেটররাও বলছেন, পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমে পর্যটকদের ভিড় বহুগুণে বাড়বে।
ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা নিজেদের মত করে প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেও সামগ্রিক প্রস্তুতির অনেক কিছুই বাকি। পর্যটকদের মানসম্মত সেবা দেওয়ার মত পর্যাপ্ত অবকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি। পর্যটন বোর্ডের পরিচালক আবু তাহের মুহাম্মদ জাবেরও তা মানছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এখন আমাদের প্রস্তুতি না থাকলেও কিন্তু পর্যটকেরা যাচ্ছেন। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পর্যটকরা ব্যাপকভাবে বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে যাবেন। এসব জায়গায় সরকার বিনিয়োগ করবে নিশ্চয়, কিন্তু বেসরকারি বিনিয়োগটাকে আমরা বেশি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করব। এটাই আমাদের এখনকার মত প্রস্তুতি।”
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমের ২১ জেলাকে রাজধানী ঢাকা থেকে সড়কপথে আলাদা করে রেখেছিল পদ্মা নদী। সেই নদীর ওপর নির্মিত স্বপ্নের সেতুটি ওইসব জেলায় ভ্রমণ সময় চার থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত কমিয়ে দিচ্ছে।
ফলে ছুটির দিনে যাদের দৌড় ছিল বড়জোড় মাওয়া ঘাটের ইলিশ পর্যন্ত, তারা এখন ছুটির দিনটা কুয়াকাটার সৈকত কিংবা আরও দূরে সুন্দরবনে কাটানোর পরিকল্পনা করতেই পারেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, “মাঝে-মধ্যে রাতে বন্ধুদের সঙ্গে মাওয়া যাই। তবে এবার হয়ত কুয়াকাটা কিংবা অন্য কোথাও যেতে পারব।”
তবে বাড়তি পর্যটকের ভার কুয়াকাটা কিংবা সুন্দরবন কতটা নিতে পারবে, সে চিন্তাও আছে পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীদের।
বেঙ্গল ট্যুরসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ হোসেন তিন দশকের বেশি সময় ধরে পর্যটকদের সুন্দরবন দেখাচ্ছেন। তার সেবাগ্রহীতাদের অধিকাংশই বিদেশি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পদ্মা সেতু নিশ্চয় আমাদের অনেক আশা জাগাচ্ছে। আমরা বিদেশি পর্যটকদের সুন্দরবনে নিয়ে যাওয়ার সময় ফেরিঘাট এড়াতে চাই। তাই উড়োজাহাজেই যাওয়া হয় বেশিরভাগ সময়।
“আবার অনেক পর্যটক আছেন, পদ্মা বা গঙ্গা তাদের কাছে অনেক তাৎপর্য রাখে। তাদের অনেকেই সুন্দরবন থেকে ফেরার সময় ফেরিতে পার হতে চান। এদেশের ঘাটের কর্মচাঞ্চল্যও তাদের জন্য দেখার মত বিষয়। এটা তারা দারুণ উপভোগ করেন।”
মাসুদ হোসেন বলেন, “পদ্মা সেতু চালু হয়ে গেলে আগের ভোগান্তিগুলো থাকবে না, এটা ঠিক। সুন্দরবনেও দেশীয় পর্যটকদের ভিড় অনেকগুণ বাড়বে। তবে সুন্দরবনের মত নাজুক বায়োডাইভারসিটির এলাকা এই বাড়তি চাপ নিতে পারবে কি না, সেটাও কিন্তু ভাববার বিষয়।”
“কিন্তু এসব জায়গায় এখনো পর্যটকদের জন্য তেমন কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। পর্যটকদের জাহাজে তোলার সুনির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। মোংলা সুন্দরবনের এত কাছে, অথচ সেখানে কোনো ব্যবস্থা নেই। ৫০ জন পর্যটক রাতে থাকার মত জায়গা নেই মোংলায়, ৪০ জন একসঙ্গে খেতে পারেন এমন রেস্তোঁরাও পাবেন না। বাথরুমে যেতে লাইনে দাঁড়াতে হয়। লোকজন বাড়লে কী হবে আমরা জানি না।”
নজরুল ইসলাম মনে করেন, যতটা দরকার ততটা অবকাঠামো গড়ে তোলা বেসরকারি ট্যুর অপারেটরগুলোর পক্ষে ‘অসম্ভব’। সুতরাং সরকারকে এগিয়ে আসতেই হবে।
ঢাকা থেকে পটুয়াখালীর সমুদ্রকন্যা কুয়াকাটায় যেতে এখন সময় লাগে গড়ে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু হলে এই ২৬২ কিলোমিটার যাত্রার সময় ৫ থেকে ৬ ঘণ্টায় নেমে আসবে। তাতে কুয়াকাটায় পর্যটক বাড়বে- এই হিসাব ধরেই সেখানে বড় বড় হোটেল ও রিসোর্ট তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ বলছেন, বর্তমানে কুয়াকাটার সব হোটেল-রিসোর্ট মিলে ১৫ হাজার মানুষের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সেগুলোর সবগুলোই মোটামুটি ব্যবসা করে আসছে।
“পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকার মানুষ কয়েক ঘণ্টা দূরত্বের কুয়াকাটায় আরও বেশি করে আসবে। এজন্য এখানে কয়েকটি দেশীয় ও বহুজাতিক সংস্থা হোটেল-রিসোর্টের কাজ অনেক আগেই শুরু করেছে। কিছু দিনের মধ্যে সেগুলোও চালু হয়ে যাবে।”
মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাট দিনের বেলা নদী পার হতে আসা মানুষের ভিড়-ব্যস্ততা আর হৈ চৈ এ ঠাসা থাকলেও রাতে পরিণত হয় নাগরিক ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার কেন্দ্র হিসেবে।
পদ্মার ঝিরঝিরে আঁশটে বাতাস, রঙিন আলোয় সেজে ওঠা ঘাটপাড়ের রেস্তোরাঁয় বাজতে থাকা মারফতি গান, সঙ্গে ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ- সব মিলে পরিবেশ হয়ে ওঠে অন্য রকম।
ঢাকা থেকে মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়িতে করে মানুষ আসে, আড্ডা-গল্প চলে ভোর পর্যন্ত। মানুষের বিনোদনের সঙ্গী হয়ে সারারাতই জেগে থাকে ঘাট। ব্যবসায়ীরাও ব্যস্ত থাকেন বিকিকিনিতে। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই আবার চেহারা পাল্টে যায় ঘাটের।
পদ্মা সেতু চালু হলে ফেরি বা লঞ্চে নদী পার হয়ে ওপারে যাওয়ার যাত্রী আর আগের মত থাকবে না। ঘাটের হৈ চৈ, হাঁকডাক আর ফেরি-লঞ্চের তাড়ায় থাকা মানুষের ব্যস্ততার চিত্রও বদলাবে।
তবে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস, ঘাটের পালা শেষ হলেও নদীর ধারে বেড়াতে আর ইলিশ খেতে আসা মানুষের আনাগোনায় পর্যটন জমবে পদ্মা সেতুর পথে। এখন তারা সেই আশাতেই বুক বাঁধছেন।
শিমুলিয়া ঘাটে একদম পদ্মার তীরেই বিক্রমপুর পদ্মা রেস্তোরাঁ। সম্প্রতি রেস্তোরাঁর পরিসর আরও খানিকটা বাড়িয়েছেন মালিক। অনেকটা টং ধাঁচের রেস্তোরাঁটির নিচে গাছ লাগিয়ে সেখানেও চেয়ার ফেলে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক আরিফ খান বলছেন, “আশপাশ থেকে সব হোটেল উডায়া সামনে নিছে। তবে আমাগোটা মালিকানা জায়গা। এ কারণে এখনও চালাইতাছি। সবাই কয়, সেতু হইয়া গেলে কাস্টমার থাকব না। সত্য-মিথ্যা জানি না। তয় প্রতি রাতে আমাগো যে কাস্টমার হয় সবাই এহানে ঘুরতে আহে। ঢাকা থিকা প্রাইভেট, হুন্ডা, মাইক্রো নিয়া প্রতিরাতেই বহু মানুষ আহে। বিষুদবার আর শুক্রবার রাইতে তো পুরা পার্কিং ভইরা যায়।“
শিমুলিয়া ঘাটে ঢোকার মুখে সারি ধরে ১৫-১৬টি রেস্তোরাঁ। আগে যারা এখানে টং দোকান করতেন তাদের অনেকেই এখন এখানে সাজানো গোছানো দোকান খুলে বসেছেন।
তবে মোসলেম বলছেন, সন্ধ্যার পর থেকে তাদের দোকানগুলোর মূল ক্রেতা হচ্ছেন ঢাকা থেকে যাওয়া পর্যটকেরা। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে এই এলাকায় পর্যটকদের আনাগোনা আরও বাড়বে বলে তারা আশায় আছেন।
সন্ধ্যার পর নদীর পাড় ধরে সার বেঁধে বসে চটপটি-ফুচকা, দুধ চা, ফলের রস, ডিম, মিষ্টিপান, ডাবসহ বিভিন্ন ধরনের খেলনা বিক্রির দোকান। এর মধ্যে একটি খেলনার দোকান চালান তরুণ রাজ।
তিনি বললেন, “আমরা এইহানে বসিই সন্ধ্যার পর। ঘাট চালু না বন্ধ তা নিয়া আমাগো কারবার নাই। কাস্টমার যা আইয়ে সব ঢাকার। এই যে দ্যাখেন মাঝরাইতে গুড্ডি (ঘুড়ি) কিন্যা উড়াইতাছে। হ্যারাই আমাগো লক্ষ্মী। ব্রিজ চালু হইলে কী আর মানুষ ঘুরতে আইব না? আমাগো তো মনে কয় আরও বেশি আইব।”
শিমুলিয়া ঘাটটি মুন্সীগঞ্জের মেদিনীমণ্ডল ইউনিয়নের মধ্যে পড়েছে। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশরাফ হোসেন খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘাটের লঞ্চ স্পিডবোট ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়বে। এখানে এখন ৮৭টি লঞ্চ এবং কাগজে-কলমে দেড়শর মতো স্পিডবোট চলে। এদের জীবিকা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে পর্যটন হতে পারে নতুন আশার আলো।”
সেজন্য সরকারকে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে, বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
তবে কর্তৃপক্ষকে জলদি পদক্ষেপ নিতে হবে মন্তব্য করে এই জনপ্রতিনিধি বলেন, ঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ছোট ব্যবসায়ীদের কিছু করার থাকবে না। তাদের জন্য কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে। আর আগেই পর্যটনকে মাথায় রেখে শিমুলিয়া ঘাটের রেস্তোঁরাগুলোর অবস্থান পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এখন নতুন করে সাজিয়ে-গুছিয়ে অনেক কিছু করার আছে।
পর্যটনের বিকাশে পদ্মাপাড়ে হোটেল-রিসোর্ট করার কথা বলছেন বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহাবুব আলীও। তিনি বলছেন, পদ্মা পাড়ে রিসোর্ট স্থাপনের জন্য সুবিধা দেওয়ার চিন্তা আছে। হোটেল সোনারগাঁর মত চেইনগুলোর শাখা যেন সে পর্যন্ত বর্ধিত হতে পারে, সে চিন্তাও করা হচ্ছে।
“মানুষ যেন বাসে গিয়ে পদ্মা দেখতে পারে সেই ব্যবস্থা, পদ্মা পাড়ের দৃশ্য অবলোকনের জন্য টাওয়ার করার পরিকল্পনা রয়েছে। আর পর্যটকদের জন্য জরুরি সেবাগুলোও যেন সেখানে থাকে সেটাও নিশ্চিত করা হবে।”
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) দায়িত্বে থাকা পরিচালক আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বলেন, “এখন আমরা পটুয়াখালীর রাঙাবালী উপজেলার সোনারচরকে পর্যটক আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। আমরা নতুন নতুন জায়গা এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করছি। পুরনো পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে এখন এত মানুষ যায়, যে ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যায়।”
সারা দেশের পর্যটনের উন্নয়নের জন্য একটি মহাপরিকল্পনা করা হচ্ছে, যা ডিসেম্বরে শেষ হবে বলে জানালেন আবু তাহের জাবের।
তিনি বলেন, “এটা হওয়ার সাথে সাথে আমরা একটা অ্যাকশন প্ল্যানও করব। আমরা সারা দেশের ১১ শ আকর্ষণীয় স্থানকে চিহ্নিত করেছি। এই জায়গাগুলোর মধ্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে আমরা স্ট্রাকচার ও ইনভেস্টমেন্টের প্ল্যান করব। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলের আকর্ষনীয় পর্যটন স্থানগুলো বেশি গুরুত্ব পাবে।”
সরকারের এই কর্মকর্তার বলেন, “আমাদের অনেক কিছুই আছে, কিন্তু পর্যটকদের জন্য সেগুলো তুলে ধরার মতো প্রস্তুতি আমাদের নেই। আমরা চেষ্টা করব এই মাস্টার প্ল্যানের ভিত্তিতে এই খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে।”