পাচার হওয়া টাকা মানুষের হক, ফেরানোর চেষ্টা করছি: অর্থমন্ত্রী

বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগের সমালোচনা হলেও তা গায়ে মাখছেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 June 2022, 10:39 AM
Updated : 11 June 2022, 04:31 AM

তার জবাব, “যারা নিয়ে গেছেন অপরাধ না জেনে, বুঝতেই পারেননি, না বুঝেই নিয়ে গেছেন। সেজন্য তো হোয়াইট করার জন্য… সেগুলোকে আমাদের অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে আনার জন্যে এ কাজটি করা হবে।”

অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, বিদেশে পাচার হওয়া টাকা দেশের ‘মানুষের হক’, আর এই ‘হক’ তিনি ফিরিয়ে আনতে চান। যারা দেশ থেকে টাকা বিদেশে নিয়ে সম্পদ গড়েছেন, তারা বাজেটে প্রস্তাবিত সুযোগ নিয়ে সেই টাকা ফিরিয়ে আনবেন বলেই তার বিশ্বাস।

জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করার পরদিন শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। সেখানেই তার এ ব্যাখ্যা আসে।

এ বাজেটের বিশাল ব্যয় মেটানোর জন্য অর্থ সংগ্রহে অর্থমন্ত্রী নতুন একটি পথ খুঁজে বের করেছেন। বিদেশ থাকা সম্পদের ‘দায়মুক্তির’ দিয়ে তিনি তা দেশে আনার ঘোষণা দিয়েছেন।

এর ফলে ১৫ থেকে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি দেশে সরকারের খাতায় বৈধ আয়ের তালিকায় যুক্ত করা যাবে, সেই অর্থ দেশেও আনা যাবে। ওই আয়ের উৎসব জানতে চাওয়া হবে না।

এ ধরনের সুযোগ দেওয়ার সমালোচনা হচ্ছে নানা মহল থেকে। অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান  একে দেখছেন টাকা পাচারের ‘এক ধরনের স্বীকৃতি’ হিসেবে। আর সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, এ প্রস্তাব নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, অর্থনৈতিকভাবে যৌক্তিক নয় এবং রাজনৈতিকভাবেও জনগণের কাছে উপস্থাপনযোগ্য নয়।

শুক্রবার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনেও এ বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। উত্তরে মুস্তফা কামাল বলেন, টাকা যদি পাচার হয়ে থাকে, সরকার তা ফেরত আনার চেষ্টা করছে।

“যেটা পাচার হয়ে গেছে সেটা এদেশের মানুষের হক। যদি বাধা দিই তবে আসবে না। যদি না আসে আমাদের লাভটা কী? আমরা চাই, অন্য দেশ যা করে, আমরা তাই করতে যাচ্ছি। ১৭টা দেশ অ্যামনেস্টি দিয়ে টাকা ফেরত আনছে।”  

এরকম ব্যবস্থা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, মালয়েশিয়া, নরওয়েতেও আছে বলে দাবি করেন অর্থমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “টাকার একটা ধর্ম আছে বা বৈশিষ্ট্য আছে। যেখানে রিটার্ন বেশি সেখানে চলে যায়। টাকা যারা পাচার করে সুটকেসে করে পাচার করে না। এখন ডিজিটাল যুগ। বিভিন্ন ভাবে পাচার করে।

“কখনো কখনো বিভিন্ন কারণে টাকা চলে যায়। আমি টাকা পাচার হয় না কখনও বলি না। প্রমাণ ছাড়া বললে মামলায় আসে না। এই মুহূর্তে দেশের ভিতর যারা এসব কাজ করে, তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কোর্টে মামলা আছে।“

মুস্তফা কামাল বলেন, “সরকার তার কাজ করে। আপনারা জানেন, আমাদের প্রতিবন্ধ্বকতা আছে। আপনারা মিডিয়াতে রিপোর্ট করলেই সবসময় ব্যবস্থা নিতে পারি না। আমাদের মাধ্যম যারা আছে, তাদের আমরা ব্যবহার করি। তাদের মাধ্যমে বিচারগুলো করি।”

পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার প্রসঙ্গে অবধারিতভাবে পি কে হালদারের কথাও সংবাদ সম্মেলনে এসেছে।

হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠার পর বিদেশি পালিয়েছিলেন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদার। গত ১৪ মে তিনি ভারতে গ্রেপ্তার হন। সেখানেও তার অবৈধ সম্পদের খোঁজ মেলার খবর আসছে গণমাধ্যমে।

তার নাম উচ্চারণ না করে শুক্রবার সকালে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “কিছু দিন আগেও বহুল আলোচিত একটি কেইস সম্পর্কে আপনারা ভালো জানেন। সেই ঘটনা নিয়ে যদি তখন আলোচনা না হয়ে এখন আলোচনা হত, তাহলে দেখা যেত যে তার কোনো অপরাধই হয়নি।

“তিনি বাইরে যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মত নিয়ে গেছেন, সেটা তিনি ডিক্লেয়ার করে ৭, ১০ বা ১৫ শতাংশ দিয়ে এটাকে বৈধ করে দেশে আসতে পারতেন। এই ধরণের সুযোগ আমাদের নীতি এবং নৈতিকতার সঙ্গে খাপ খায় না।

পি কে হালদারের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিকালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা। 

উত্তরে মুস্তফা কামাল বলেন, “পৃথিবীর এখন একীভূত হচ্ছে- মন্দ কাজ থেকে সারা পৃথিবীর মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। কোনো দেশ কোনো অগ্রাধিকার দিলে সে দেশের মানুষ সে খারাপ কাজটি করার জন্যে উৎসাহিত হয়।

“আমরা লক্ষ্য করছি- একজন হালদার এখন ভালো অবস্থানে নেই। যে টাকা পয়সা নিয়ে গেছেন ইনডিয়ান গভার্নমেন্ট স্বীকার করেছে- টাকা আমাদের ফেরত দেবে এবং হালদারকেও ব্যাক করাবে। এ দেশে ফেরত নিয়ে আসব।”

মন্ত্রী বলেন, “একই রকমভাবে কানাডিয়ান প্রাইম মিনিস্টার বলেছেন, বিভিন্ন দেশে থেকে যারা বিভিন্নভাবে বিনিয়োগ করেছে, বাড়িঘর তুলেছে, বাড়িঘর কেনা বন্ধ। আর যারা আগে কিনেছে সেগুলো টাকা উদ্ধার করে সংশ্লিষ্ট দেশে যেখান থেকে টাকা চলে গেছে সেখানে ফেরত পাঠাবার জন্যে ব্যবস্থা করেছে।”

যারা অবৈধ সম্পদ রক্ষার জন্য বা কর এড়াতে টাকা বিদেশে পাচার করেছে, তারা কেন কর দিয়ে তা দেশে ফেরাতে যাবে- তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ।

তবে অর্থমন্ত্রী মনে করছেন, যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন, কর দিয়ে সেই সম্পদ বৈধ করার ‘সুযোগ নেওয়ার এটাই সুন্দর সময়’।

“আমরা যদি বলি- সুযোগ দেব না; কেউ আসবে না, টাকা দেবে না- এসব বললে তো আমরা পারব না। তবে আমরা যেটা বলছি- বাজেটেও ঘোষণা দিয়েছি, তাদের কোনো প্রশ্ন করা হবে না। এটা সত্য।”

ডলারের মজুদ বাড়াতে সরকার গত মাসে রেমিটেন্সের ওপর নগদ প্রণোদনার পরিমাণ যখন বাড়ানোর ঘোষণা দিল, তখনও বলা হয়েছিল, ওই অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা হবে না।

এ বিষেয়ে অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য, “যারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠায়, তাতে বড় ভীতি তো সব সময় থাকে। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্সের টাকা নিয়ে বাড়ি ঘর করল, পরে মানুষ তো অবশ্যই প্রশ্ন করতে যাবে এ টাকা কোথায় পেয়েছেন?

“এসব প্রশ্ন থেকে দূরে থাকার জন্যে একমাত্র রাস্তা হচ্ছে সরকারি আইন বিধি-নিষেধ পরিপালন করা, সরকারের সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করা।

“আমি সেজন্য বিশ্বাস করি, যে উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার মত আমাদের কাজ হবে, ইনশাআল্লাহ।”