ছায়া ঘনাচ্ছে, মুস্তফা কামালের বাজেটে আলোর দিশা কই

রাশিয়ার ট্যাংক যেদিন সীমান্ত অতিক্রম করল, সেদিন কেবল ইউক্রেইনই সঙ্কটে পড়ল না, বিশ্ব পরিস্থিতিই বদলে যেতে থাকল। তার ছায়া এড়িয়ে বাংলাদেশ চলছিল বলেই মনে হচ্ছিল, কিন্তু কয়েক মাস পর গল্পটি এখন ভিন্ন। বাংলাদেশ এখন এমন একটি জটিল অর্থবছরে পা রাখছে, যেখানে রয়েছে ঘোর অনিশ্চয়তা, পণ্যের মূল্য আর মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা।

রিয়াজুল বাশার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2022, 09:07 PM
Updated : 10 June 2022, 03:38 AM

অর্থনীতির এই কঠিন পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য মাত্র একটি উদাহরণই যথেষ্ট; বিশ্ববাজারে জ্বালানি, সার আর ভোজ্য তেলের চড়া দামের কারণে সরকারকে এ বছর বাড়তি আটশ কোটি ডলার গুণতে হচ্ছে।

কোভিড মহামারীর পর যুদ্ধের এই কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে উন্নয়নের হারানো গতিতে ফেরার চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

মহামারীর ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প তুলে ধরলেও যুদ্ধের দুনিয়ায় আগামীর শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার কথা খোলাখুলিই বলেছেন তিনি। তার ভাষায়, “আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস ও সারের মূল্যের সাম্প্রতিক যে গতিপ্রকৃতি, তাতে ভর্তুকি খাতে ব্যয় আরও ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে, যা আগামী অর্থবছরের বাজেট ব্যবস্থাপনায় একটি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।”

তারপরও নিজের চতুর্থ বাজেটে ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’কে স্লোগান তুলেছেন মুস্তফা কামাল; কিন্তু এই প্রত্যাবর্তনের পথরেখাটি আবছায়াই ঠেকছে অর্থনীতিবিদদের কাছে।

পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরের ভাষ্যে, “সামনে অনেক অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা আছে। এগুলোর কারণে এই বাজেটে ডেফিনিটিভ উত্তর বলে কিছু নাই। অবস্থা বুঝে মধ্যবছরে হয়ত ব্যবস্থাও নিতে হবে সরকারকে।”

পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে কর দিয়ে দায়মুক্তিতে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবকে বাজেটের চমক হিসেবে দেখা হলেও নৈতিকতার মানদণ্ডে তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

 

আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (৫ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা) চেয়ে ১৪ দশমিক ২৪ শতাংশ বেশি ব্যয়ের ফর্দ তৈরি করেছেন অর্থমন্ত্রী। টাকার ওই অঙ্ক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ২৩ শতাংশের সমান।

সঙ্কটের মধ্যেও ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন মুস্তফা কামাল। ভাবনা হয়ে দেখা দেওয়া মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার আশাও করছেন তিনি।

কিন্তু যুদ্ধের বাজারে দ্রব্যমূল্য যখন পাগলা ঘোড়ার মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এমনকি বাজেট প্রস্তাবের দিনও সয়াবিন তেলের দাম যখন লিটারে ৭ টাকা বেড়েছে, সেখানে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার আশা থাকলেও দিশা কি বাজেটে আছে?

অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেনের কাছ থেকে উত্তর আসে- ‘না’। তার কথায়- “এখন মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের উপরে। গত বছর ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। সেই হিসেবে এই বাজেটের মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, সেটা বাস্তবসম্মত নয়।”

আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যেটুকু পদক্ষেপও আছে, সেটাও ‘ভুল’ ঠেকছে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হানের কাছে।

তিনি বলেন, “বলা হচ্ছে যে, মূল্যস্ফীতিকে ঠিক করার জন্য সাপ্লাই বাড়ানো হবে এবং ডিমান্ডের গ্রোথ কমানো হবে। এখানে আমার মনে হচ্ছে যে, মূল্যস্ফীতির ব্যাপারে একটা ভুল ধারণা, কারণ বর্তমান মূল্যস্ফীতি হচ্ছে কস্টফুল, নট ডিমান্ডফুল। চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এই মূল্যস্ফীতি হয়নি। মানুষের চাহিদা কমানোটাই যদি টার্গেট করা হয়, তাহলে তো মূল্যস্ফীতি নিয়ে এটা একটা রং পলিসি হবে।”

মহামারীর কারণে যেসব মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে, তারা কীভাবে আগের জায়গায় ফিরতে পারবে, তারও পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন বলে তার মন্তব্য।

বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী নিজেই।

১) মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা

২) গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের মূল্যবৃদ্ধিজনিত বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান

৩) বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের উচ্চ-অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পসমূহ নির্ধারিত সময়ে শেষ করা

৪) শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন

৫) অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ এবং ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করা

 ৬) টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, “এ সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের অত্যন্ত কৌশলী হতে হবে। কোনো একটি সমস্যা সঠিকভাবে সমাধান করা না গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে।”

তবে কৌশলগুলো যে কী, বাজেটে সেটাই খুঁজে পাওয়া ভার।

বিশাল ভর্তুকির সমন্বয়ে নতুন অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ২৩ শতাংশের সমান যে ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে, তার অর্থের জোগান আনতে পারবেন মুস্তফা কামাল?

এই বিশাল ব্যয় মেটানোর জন্য মূলত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঘাড়েই চেপেছেন তিনি। রাজস্ব আহরণে এনবিআর বিদায়ী অর্থবছরের লক্ষ্যের চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও তিনি আশা করছেন, নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের প্রায় ৬৪ শতাংশ তিনি রাজস্ব খাত থেকে পাবেন।

তার প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ১১.৩১ শতাংশ বেশি।

এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন কামাল। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ১২ শতাংশের মতো। এই অঙ্ক মোট বাজেটের ৫৪ দশমিক ৫৬ শতাংশের মতো।

গতবারের মতো এবারও সবচেয়ে বেশি কর আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে, ১ লাখ ৪১ হাজার ১৯২ কোটি টাকা। এই অঙ্কও বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশের মতো। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে ভ্যাট থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা।

আয়কর ও মুনাফার উপর কর থেকে ১ লাখ ২১ হাজার ২০ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। বিদায়ী সংশোধিত বাজেটে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।

নতুন বাজেটে আমদানি শুল্ক থেকে ৪৩ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা, সম্পূরক শুল্ক থেকে ৫৮ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা, রপ্তানি শুল্ক থেকে ৬৩ কোটি টাকা, আবগারি শুল্ক থেকে ৪ হাজার ১২৭ কোটি টাকা এবং অন্যান্য কর ও শুল্ক থেকে ১ হাজার ৮০ কোটি টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী।

এনবিআর থেকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব করতে হলে আগের বছরের তুলনায় যে প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন হবে তা বাংলাদেশে এর আগে কখনোই হয়নি এবং আগামী অর্থবছরেও হবে না বলে মনে করছেন আহসান এইচ মনসুর।

তিনি বলেন, “বাজেট বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে রাজস্ব আহরণ।”

তার মতে, এনবিআর চলতি অর্থবছরে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগুচ্ছে সেখানেও ৪০ হাজার কোটি টাকা কম মানে ২ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা আদায় হবে। তাহলে প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্য ৩ লাখ ৭০ হাজার পূরন করতে গেলে ৮০ হাজার কোটি অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৩০ শতাংশের মতো।

“৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এনবিআর কোনোদিনও অর্জন করতে পারে নাই।”

করের হার না বাড়িয়ে আওতা বাড়ানোর কথা অর্থমন্ত্রী বললেও কীভাবে তা হবে, তার কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই বাজেটে।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “রিটার্ন দাখিল করার ধমকাধমকি ছাড়া রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। কিছু ক্ষেত্রে কর হার কমিয়েছেন, আবার কিছু ক্ষেত্রে বাড়িয়েছেন। সেখানে হয়ত একটা কাটাকাটি হবে। কিন্তু প্রবৃদ্ধির যে বিরাট লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, তা অর্জন করার মতো পথ নির্দেশনা নেই।”

 

লেনদেন ভারসাম্য কমাতে বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সহনশীল রাখতে এবং চাহিদা কমিয়ে মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে বিভিন্ন পণ্যে আমদানিতে নানা ধরনের শুল্ক বসানো হয়েছে। এতে আমদানি কমলেও এনবিআরের রাজস্বে আঘাত আসতে পারে।

২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে ১ লাখ ১২ হাজার ৪৫৮ এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার মতো ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

তাতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে শঙ্কা জানিয়েছে এফবিসিসিআই। সংগঠনের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, “বেশি টাকা সরকার যদি ব্যাংক থেকে নিয়ে যায়, তাহলে প্রাইভেট সেক্টরে ঘাটতি থেকে যাবে।

আবার বিনিয়োগ কমিয়ে এবং বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

২০২১-২০২২ সালের সংশোধিত বাজেটে জিডিপির বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে হচ্ছে ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।

বিনায়ক সেনের কাছে বিনিয়োগ কমিয়ে প্রবৃদ্ধির হার বাড়ানোর বিষয়টি ‘বাস্তবসম্মত’ মনে হচ্ছে না। আহসান মনসুরও সন্দিহান সাড়ে সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন নিয়ে, যদিও এটা অর্জিত হওয়া-না হওয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না তিনি।

দেশে ডলারের যে সঙ্কট চলছে, তা নিয়ে সব মহলে উদ্বেগ থাকলেও তা নিয়ে বাজেটে দৃশ্যমান কিছু না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেছেন জাহিদ হোসেন।

“সরকারের চলতি ব্যয় এবং সরকারের যেসব ব্যয়ের প্রয়োজন নেই বা অপচয় হয়, এমন ব্যয় কমিয়ে আমদানি এবং ডলারের চাপ দুটোই কমাতে পারতেন। কিন্তু বাজেটে সরকারি এসব ব্যয় কমানোর খুব একটি লক্ষণ আমরা দেখি নাই।”

সঙ্কটে পড়া মানুষদের রক্ষায় সামাজিক সহায়তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ ৬ হাজার কোটি টাকা বাড়লেও মোট বাজেট ও জিডিপির তুলনায় এর হার গুরুত্ব কমেছে। আবার তার বাস্তবায়নেও চ্যালেঞ্জ দেখছেন জাহিদ হোসেন।

তার ভাষায়, “এই বরাদ্দ কিন্তু অনেক বড় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার। গত বছরের তুলনায় মাত্র ৫ শতাংশ বাড়লেও আকারটা কিন্তু বিরাট। এই বরাদ্দ সুফল পেতে হলে এটা যাতে সুবিধাভোগীদের কাছে দুর্নীতিমুক্ত উপায়ে এবং সময় মতো পৌঁছানো একটা চ্যালেঞ্জ। অতীতে ছিল এই চ্যালেঞ্জ, বর্তমানেও আছে।”

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। ছবি: পিআইডি

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্যপণ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিয়ে এলেও জিডিপির অনুপাতে এই খাতে বরাদ্দ কমেছে। তবে কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানির উপর শুল্ক কমিয়ে এবং সারে ভর্তুকি বাড়িয়ে মুস্তফা কামাল বরাদ্দ কমানো পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, “সারের ওপর ভর্তুকি সবচেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে। বিশ্বে একটি খাদ্যের অভাব হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন আশঙ্কার সময়ে কৃষির ওপর ভর্তুকি নিশ্চয় দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াবে।”

পোশাক খাতের মতো অন্যান্য রপ্তানি পণ্যেও একই কর্পোরেট কর হার করার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি। শিল্পের কাঁচামালের উপর উৎসে কর উল্লেখযোগ্য হারে কমানোও তার প্রশংসা পেয়েছে। করপোরেট কর হার আবারও আড়াই শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্তেও চমক দেখছেন তিনি।

এবার ভর্তুকির বরাদ্দে ‘উদারতা’ রয়েছে মন্তব্য করে জাহিদ হোসেন বলেন, “বিশেষ করে বিদ্যুৎ এবং সারে, যাতে বিদ্যুৎ এবং সারের দাম বাড়াতে না হয়। এই বরাদ্দ না দেওয়া হলে বর্তমানের মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেত এবং সাধারণ মানুষের উপর চাপ আরও বাড়ার আশঙ্কা ছিল।”

সেলিম রায়হান বলেন, “সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অনেকগুলো ভাতা রয়েছে যেগুলো বছরের পর বছর ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে রয়ে গেছে। তাদের ভাতার মধ্যে মূল্যস্ফীতি, জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি এসবের কোনো রিফ্লেকশন নেই। এগুলোকে ঠিক করতে হবে। এই মুহূর্তে ৫০০ /৭০০ টাকা তেমন কিছুই। এগুলো অনেক বাড়াতে হবে।”

বিশাল ব্যয় মেটানোর জন্য অর্থ সংগ্রহে অর্থমন্ত্রী নতুন একটি পথ খুঁজে বের করেছেন। বিদেশ থাকা সম্পদের ‘দায়মুক্তির’ বিষয়ে আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি, তিন ধরনের করহার ঘোষণার মাধ্যমে বাজেটে তা সুস্পষ্ট করেছেন।

বিদেশের স্থাবর সম্পত্তি দেশে আনা না হলে ১৫ শতাংশ ও অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং বাংলাদেশে পাঠানো নগদ অর্থের উপর ৭ শতাংশ হারে কর দেওয়া হলে এনবিআরসহ আর কেউ এসব সম্পদ বা অর্থের বিষয়ে প্রশ্ন তুলবে না বলে বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন তিনি।

সরকারের এই পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলে সেলিম রায়হান বলেন, “বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু দেশের নীতি-নির্ধারকরা এটাকে অস্বীকার করেছিল। এবারই দেখলাম- সেই টাকা ফেরত আনার জন্য এক ধরনের প্রচেষ্টা, যেটা টাকা পাচারের এক ধরনের স্বীকৃতি।”

এই সুযোগ দেওয়ার বিরোধিতা করে তিনি বলেন, “এটা সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে এবং যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছে তারা ডাবল রিঅ্যাওয়ার্ডেড হচ্ছে।”

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বিভিন্ন সময় দেওয়া হলেও তাতে তেমন সাড়া না মেলার প্রেক্ষাপটে অর্থমন্ত্রীর নতুন উদ্যোগের সফলতা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

বাজেট নিয়ে সার্বিক বিশ্লেষণে গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, “যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয়েছে, তা অপরিপূর্ণ, নীতিকৌশলের পথনির্দেশনাগুলো অসম্পূর্ণ আর বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো অপর্যাপ্ত।”

তবে বাজেট বাস্তবায়ন ও লক্ষ্য পূরণে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণে ২০২২ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত প্রস্তুতিমূলক সময়টি বাংলাদেশকে অত্যন্ত দূরদর্শীভাবে কাজে লাগাতে হবে। যাতে করে বাংলাদেশ উত্তরণ পরবর্তী পর্যায়ে টেকসইভাবে অগ্রসর হতে পারে।

“সে লক্ষ্যে গতিশীলতার সাথে উত্তরণ নিশ্চিতকরণের চলমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশ সরকার একটি মসৃণ ও টেকসই উত্তরণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন নীতিমালা, কৌশল, কর্মসূচি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।”

তবে অর্থনীতিবদ সেলিম রায়হান সার্বিভাবে বাজেট নিয়ে বলেছেন, “সামগ্রিকভাবে মোটামুটি প্রতিবছর যেমন বাজেট হয়, তেমনই হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতির কিছুটা রিফ্লেকশন আছে। কিন্তু এখন মূল্যস্ফীতির কারণে ও জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে যারা খুব কষ্টে আছে, তাদের জন্য এই বাজেটে খুব স্বস্তিদায়ক খবর নেই বললেই চলে।”

বাজেটের আরও খবর