বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ কমানো নিয়ে প্রশ্ন

শিক্ষায় ব্যয় বাড়ানোর তাগিদ থাকলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ কমেছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 June 2022, 04:50 PM
Updated : 9 June 2022, 04:50 PM

কোভিড পরবর্তী বাস্তবতায় সরকারের এ ব্যয় পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে শিক্ষাবিদদের মধ্যে।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য যে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৯ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা।

এই অঙ্ক মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বাজেটের ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ।

সেই হিসাবে নতুন অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ ১ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে।

অবশ্য চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ৭ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৮৭ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান মনে করেন, শিক্ষার পেছনে সরকারের এবারের বরাদ্দ ‘বাস্তবসম্মত’ হয়নি।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোভিডকালীন সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য বাজেটে সুস্পষ্টভাবে বরাদ্দ রাখা দরকার ছিল।”

বরাদ্দ কমানোর সমালোচনা করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ উপাচার্য বলেন, “নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, মাদ্রাসা হয়েছে। শিক্ষা উপকরণের দাম বেড়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেড়েছে। 

“সবকিছুই যদি বাড়ে, তাহলে আমরা কমানোর কথা চিন্তা না করে অন্তত আগের বছরের মত রাখা যেত। অবশ্যই সেটা বাড়ানো উচিৎ ছিল।”

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের শিক্ষা খাত মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল নতুন বাজেটে আগামী অর্থবছরে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে যে বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন, তা জিডিপির ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। আগের বছর এটি ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

বৃহস্পতিবারই বাজেট ঘোষণার আগে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে শিক্ষায় সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

জিডিপির তুলনা করে তিনি বলেন, “শিক্ষায় বিনিয়োগ জিডিপির ছয় ভাগে যেতে হবে, আমরা তিন ভাগে আছি।”

নতুন অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগকে ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগকে ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। 

আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ১৬ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ১ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।

 প্রস্তাবিত বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বরাদ্দ কমানো না হলেও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ কমেছে।

এ মন্ত্রণালয়ে চলতি অর্থবছরে ২১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও, সংশোধিত বাজেটে তা ১৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকায় নেমে আসে।

জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। ছবি: পিআইডি

বরাদ্দ যেসব খাতে

নতুন অর্থবছরের বাজেটে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের অনুদান আড়াই গুণ বাড়ানো হয়েছে।

চলতি অর্থবছরে দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্য মঞ্জুরি হিসেবে এককালীন ৮ কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার প্রস্তাবিত বাজেটে এককালীন ২০ কোটি টাকা অনুদান দেওয়ার কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সে হিসেবে অনুদান বেড়েছে আড়াইগুণ।

বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১ হাজার ৪৯৫টি নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন এবং পিটিআইবিহীন ১২টি জেলায় নতুন ১২টি পিটিআই চালু করা হয়েছে বলে বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।

“মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের লক্ষ্যে ৫০ হাজার ৪১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৮ হাজার ৯২১টি ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ইন্টারনেটসহ সাউন্ড-সিস্টেম সরবরাহ করা হয়েছে।”

গত বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়া ‘রিচিং আউট-অব-স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) ফেইজ-২ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের ফলে সুবিধাবঞ্চিত, অবহেলিত, দরিদ্র ও অসহায় পরিবারের ঝরে পড়া ও স্কুলে যায়নি এমন ৮-১৪ বছর বয়সী গ্রাম পর্যায়ে ৬ লাখ ৯০ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ৪৬ হাজার ৫৪৭ শিক্ষার্থী প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছে বলে জানান মন্ত্রী।

মুস্তফা কামাল বলেন, “নিরক্ষর ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে মোটিভেশনাল ও সেনসিটাইজেশন কার্যক্রম পরিচালনার ঘোষণা আমরা চলতি বাজেটে দিয়েছিলাম। বর্তমানে ‘মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প ৬৪ জেলা’ এর দ্বিতীয় পর্যায়ে ২১ লক্ষ নিরক্ষর নারী পুরুষদের সাক্ষরতা দানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

“উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে স্বাক্ষরতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চলছে, যার অংশ হিসেবে উপজেলা পর্যায়ের ১ হাজার ৪৭৩টি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।”

২০২২-২০২৩ অর্থবছরে আইসিটি বিষয়ে ১৬ হাজার ৩০০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে বলে জানান মন্ত্রী। 

এছাড়াও মানসম্পন্ন শিখন কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে টিচার্স পোর্টালে ইতিমধ্যে ৬২ হাজারের বেশি কনটেন্ট তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে শিক্ষকরা নিজেরাই কনটেন্টের বিষয়ে মানোন্নয়ন ঘটাতে পারছেন।

প্রস্তাবিত বাজেটে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ১২ হাজার ৬০৭টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। ১০০টি উপজেলায় ১টি করে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (টিএসসি) স্থাপন প্রকল্পের আওতায় ৬ হাজার ৮০০টি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।

দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল মান্নান বাজেটের সুফল পেতে দুর্নীতি বন্ধে নজর দিতে বলেছেন।

তিনি বলেন, “শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি আছে। বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে। এই দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে আমরা বাজেট বরাদ্দ বাড়ালেও খুব বেশি সুফল আসবে বলে আমি মেনে করি না।”

বাজেটের সুষম বণ্টনে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, “উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষণায় যা-ই বরাদ্দ দেয়া হয়, সেগুলো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে খরচ করতে পারে না।

“শিক্ষার বাজেট থেকে উল্লেখযোগ্য এক অংশ যায় এলিট শ্রেণির জন্য। ক্যাডেট কলেজ বা সামরিক বাহিনীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য। সেগুলো এই বাজেট থেকেই যায়। তারাই বেশি প্রাধান্য পায়। দিনশেষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের তেমন লাভ হয় না।”