মহামারীর পৃষ্ঠা উল্টে মুস্তফা কামাল আসছেন ‘উন্নয়ন অধ্যায়ে’ ফেরার বাজেট নিয়ে

মন্দা যেন পিছু ছাড়ছে না দুনিয়ার; মহামারীর দুই বছরে টিকে থাকার পরীক্ষায় উৎরে যাওয়া বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীকে এবার মধ্যবিত্ত গৃহস্থের মতই মন্দার শঙ্কা মাথায় নিয়ে নতুন অর্থবছরে সংসার সামলানোর কৌশল সাজাতে হচ্ছে; তবে উন্নত জীবনের স্বপ্নও তিনি বাদ দিচ্ছেন না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 June 2022, 07:04 PM
Updated : 9 June 2022, 02:39 PM

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে মোটামুটি পৌনে সাত লাখ কোটি টাকার যে বাজেট তিনি প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন, তার মূল লক্ষ্য থাকছে মহামারীর অভিঘাত পেরিয়ে বাংলাদেশকে আবার উন্নয়নের মহাসড়কে ফিরিয়ে নেওয়া।

সরকারি প্রণোদনা আর উদ্যোক্তাদের অদম্য চেষ্টায় ভর করে কোভিডের ক্ষত কাটিয়ে গতি ফিরতে শুরু করেছিল দেশের অর্থনীতিতে। কিন্তু নতুন বাস্তবতায় হোঁচট খেয়েছে সেই চেষ্টা।

নীতি নির্ধারকরা যখন বর্তমান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেটের প্রস্তুতি নিতে কাগজ কলম নিয়ে বসেছেন, এর মধ্যেই গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেইনে হামলা করে বসে রাশিয়া। তাতে অল্প দিনের মধ্যেই বদলে যায় বিশ্ব পরিস্থিতি, এর বাইরে থাকার উপায় বাংলাদেশের নেই।

বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীকে বারবারই টানাটানি আর সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় সামাল দেওয়ার হিসাব নিকাশ করতে হয়। ইউক্রেইন যুদ্ধের ধাক্কা যেন দেশের অর্থনীতিকে কক্ষচ্যুত করতে না পারে, এবার সে কথাও ভাবতে হচ্ছে আ হ ম মুস্তফা কামালকে।

পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জনের ছক নতুন করে সাজাতে এবার ভিন্ন কিছু তাকে রাখতে হচ্ছে বাজেট পরিকল্পনায়।

কামাল যখন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট দিতে আসছেন, ঊর্ধ্বমুখী পণ্য বাজার আর মূল্যস্ফীতি আরেকটি বিশ্ব মন্দার শঙ্কা জাগিয়ে তুলছে। হু হু করে বাড়ছে জ্বালানি ও খাদ্যসহ সব পণ্যের দাম। চড়ছে ডলারের মূল্য। আন্তর্জাতিক এ সংকটের ‘ভিকটিমে’ পরিণত হওয়া বাংলাদেশও হিমশিম খাচ্ছে সীমিত সামর্থ্য দিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে।

এই সংকট সামলে উত্তরণের পথে যেতে কী কৌশল থাকছে আ হ ম মুস্তফা কামালের বাজেট প্রস্তাবে? তার কিছুটা আভাস ইতোমধ্যে মিলেছে বাজেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরাতে।

বাড়তে থাকা আমদানি ব্যয়, রির্জাভে চাপ তৈরি করা ডলার সংকট, টাকার মান কমে যাওয়ার নিয়মিত খবর, দেশে বিদেশের মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী রেখাচিত্র অর্থমন্ত্রীকে তার চতুর্থ বাজেট নিয়ে পরিকল্পনায় খুব বেশি স্বস্তির জায়গা দেয়নি।

তবে ‘জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর’ বাজেটের পর ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তনের’ পথরেখা আঁকতে গিয়ে বরাবরের মতই তাকে বাজেট সাজাতে হয়েছে বড় ঘাটতি রেখে।

নতুন অর্থবছরে তার ব্যয়ের খাতায় থাকছে মোট ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার ফর্দ, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৫ শতাংশের বেশি।

আর চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এ আকার আনুমানিক ৮৪ হাজার কোটি টাকা বা সোয়া ১৪ শতাংশের মত বেশি।

দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পর্যায়ে পৌঁছানো মূল্যস্ফীতির দুর্ভোগ থেকে জনগণকে কিছুটা হলেও রেহাই দিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি হত দরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার দিকে নজর রাখার কথা ভাবতে হচ্ছে অর্থমন্ত্রীকে। সেজন্য ব্যয়ের খাতায় ভর্তুকির বোঝা বাড়বে। 

আবার অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়িয়ে কাজের সুযোগ তৈরির চেষ্টাও অর্থমন্ত্রী নিতে চান। মহামারীর ক্ষতি কাটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যকে স্বাভাবিক রাখতে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর বাস্তবায়ন সম্পন্ন করা, কর কমিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য আর বিনিয়োগকে চাঙা করার চেষ্টার মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং খাদ্য, কৃষি ও শিল্পোপাদন বাড়ানোর মত পদক্ষেপও দেখা যেতে পারে তার বাজেট প্রস্তাবে।

অগ্রাধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ানো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব উপযোগী শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নসহ মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিয়ে সক্ষমতা অর্জনের পথে হাঁটতে চান অর্থমন্ত্রী।

কিন্তু দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় সামনের দিনগুলোতে রপ্তানি কমে যেতে পারে। সে কারণে সেখানে উচ্চাশার লাগাম টেনে রাখতে হচ্ছে কামালকে। আবার ডলার বাঁচিয়ে অর্থনীতির চাপ কমাতে আমদানি ব্যয়ের রাশ টেনে ধরার ভাবনাতেও জোর দিচ্ছে হচ্ছে।

এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের পরামর্শ, দেশকে আমদানি নির্ভরতা থেকে বের করে আনতে পারলে অর্থনীতির উপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে বের হওয়া যাবে। আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে বাংলাদেশ।

বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে থাকলেও আগামী বাজেটে সীমিত সামর্থ্য ব্যবহারের কৌশল কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন।

আর বিশ্ব ব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা এবং বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করে কর্মসংস্থানবান্ধব বাজেট প্রত্যাশা করছেন।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ছক

বাংলাদেশের বাজেট উপস্থাপনের দুই দিন আগে মঙ্গলবার বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বিশ্ব ব্যাংক ২ দশমিক ৯ শতাংশে নেমে আসার পূর্বাভাস দিয়েছে। বৈশ্বিক সংকটের এ সময়েও অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলনে আগের মত উচ্চাভিলাষী থাকছেন।

বাজেটে এ হার সাড়ে ৭ শতাংশ প্রস্তাব করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে যা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। যদিও বিশ্ব ব্যাংক ২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশ হওয়ার আভাস দিয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হিসেবেই ধরা হচ্ছে।  

নতুন বাজেটে প্রবৃদ্ধির এ লক্ষ্য অর্জিত হলে দেশের মোট জিডিপির আকার ৫০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়িয়ে যাবে। নতুন অর্থবছর শেষে জিডিপির আকার দাঁড়াবে ৫১২ বিলিয়ন ডলার।

জিডিপির প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে বিনিয়োগ বাড়াতে করপোরেট করে ছাড় দেওয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা আসতে পারে বাজেটে।

কৃষি ও শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রস্তাব থাকতে পারে। খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহ দিতে কৃষিতে এবার প্রণোদনা হিসেবে রেকর্ড ১৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার খসড়া করা হয়েছে। লক্ষ্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ, বীজ, কৃষি পুনর্বাসন ও সারে ভর্তুকি দিয়ে উৎপাদন বাড়ানো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনও দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের তাগিদ দিয়েছেন।

তিনি বলেন, “ডলারের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি করা পণ্যের দামও বাড়িয়ে দিতে হবে। দেশে যেসব পণ্য তৈরি হয় সেসব যাতে আমদানি না হয় সেজন্য বড় ধরনের কর বসিয়ে দিতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি উদ্যোক্তাদের দিতে হবে বড় ছাড়।”

“তাহলে দেশ আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসবে। আর দেশে হবে বঙ্গবন্ধুর দেখানো ‘স্বয়ম্ভর’ দেশ।”

প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হতে পারে জিডিপির সাড়ে ৩১ শতাংশের মত। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ২৪ দশমিক ৯০ এবং সরকারি খাতে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।

এছাড়া নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানতে এবং উৎপাদন ব্যয় কমাতে বিদ্যুতে ভর্তুকি রাখা হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর নিম্ন আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় ভর্তুকি বরাদ্দ থাকছে আরও ৬ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা।

এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি সামাল দেওয়ার ছক থাকছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাবে। আগামী অর্থবছরের জন্য সার্বিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য নিয়ে এগোতে চান তিনি।

চলতি অর্থবছরে এ লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে এসে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যসহ প্রায় সব ধরনের আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তা ৫ দশমিক ৮ শতাংশে সংশোধন করা হয়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “বর্তমানে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে চাহিদা আর যোগানের ভারসাম্যহীনতা।”

যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের ঊর্ধ্বগতিকেই মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনিসহ অন্য অর্থনীতিবিদরা। আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতি ও বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে।

চাহিদা সংকটে ডলারের দাম বাড়ছেই; টাকার অব্যমূল্যায়ন ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

এমন প্রেক্ষাপটে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়, সে বিষয়ে স্পষ্ট একটা দিক-নির্দেশনা বাজেটে চাইছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

তিনি বলেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি কীভাবে আরও বিস্তৃত করা যায়, নতুন করে যারা মূল্যবৃদ্ধির চাপে পড়েছে তাদেরকে কীভাবে এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করা যায়, বাজেটে তার নির্দেশনা থাকা উচিত।

আর বিআইডিএসের মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন মূল্যস্ফীতির প্রভাবকে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে সাধারণকে সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাজেটে অগ্রাধিকার নির্ধারণের তাগিদ দিয়েছেন।

মূল্যস্ফীতির বিষয়টি এখন ‘গরিব ও ধনী শ্রেণিতে বিভক্ত না করে’ সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “কাদেরকে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে বেশি সহায়তা দেওয়া যায়, সেই অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে।’’

সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের জন্য একটি সামাজিক কাঠামো নির্ধারণ করে সবাইকে এর আওতায় আনা প্রয়োজন বলে বিনায়ক সেন মনে করেন।

তিনি বলেন, “কোনো শ্রেণিকে কীভাবে সহায়তা দেওয়া যায় ভাবতে হবে। কারও খাদ্য প্রয়োজন আর কারও নীতি সহায়তা।”

টিসিবির মাধ্যমে বছরজুড়ে ফ্যামিলি কার্ডের আওতায় এক কোটি পরিবারকে স্বল্প মূল্যে পণ্য সরবরাহের বিষয়টি মূল্যস্ফীতির হাত থেকে নিম্ন আয়ের মানুষকে রক্ষা করবে বলে বাজেটে বলতে চাইবেন অর্থমন্ত্রী।

অন্যান্য খাতেও ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপের প্রস্তাব থাকবে।

ব্যাংক ঋণ বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি মোকাবেলা?

সরকারের আয় ব্যয়ের বিশাল হিসাব নিকাশ মেলাতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী ও তার দলকে বেশ কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। দেশের কর ও জিডিপির অনুপাতে এতদিনেও আশানুরূপ উন্নতি না হওয়ায় বরাবরের মত বড় ঘাটতির বোঝাই টানতে হচ্ছে।

তবে প্রস্তাবিত বাজেটে চলতি অর্থবছরের কোভিডকালীন বাজেটের চেয়ে ঘাটতি (৬ দশমিক ২ শতাংশ) কমিয়ে জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ হিসাব করা হচ্ছে।

অর্থ বিভাগ হিসাব করে দেখেছে, আগামী অর্থবছরে বাজেটে সরকার ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার মত রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারবে। এতে বাজেট ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার আশেপাশে থাকতে পারে। শতকরা হিসাবে তা মোট বাজেটের ৩৬ শতাংশের কিছুটা বেশি। চলমান বাজেটে টাকার অঙ্কে তা ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা।

এই বিপুল ঘাটতির এক-তৃতীয়াংশের বেশি আসবে ঋণ থেকে। এর মধ্যে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই বেশি ঋণ নেওয়ার ছক আঁকছে সরকার। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বাজেট আরও বেশি ঋণনির্ভর হতে যাচ্ছে।

বিদেশি ঋণ নেওয়া বা না নেওয়ার বর্তমান আলোচনার মধ্যে বাজেটে নতুন অর্থবছরে বিদেশি নিট ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।

আর অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক থেকে এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব থাকতে পারে। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে তা আগামী অর্থবছরে ৩৩ শতাংশের মত বাড়বে।

ব্যাংকের বাইরে ঋণের লক্ষ্য ধরা হতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৫ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র থেকেই নেওয়া হতে পারে।

সরকারের বর্তমান ঋণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বিদেশ থেকে আরও বেশি ঋণ নেওয়ার পরামর্শই দিয়েছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

বর্তমানের উচ্চমূল্যের বাজারে আয়করে কিছুটা ছাড় দেওয়ার দাবি ছিল। তবে রাজস্ব আয়ের বড় লক্ষ্য পূরণের চাপে থাকা অর্থমন্ত্রী এখানে কোনো রেহাই দিচ্ছেন না, বরং করপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে নতুন কিছু নিয়ম প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন।

তবে বিনিয়োগ চাঙ্গা রাখতে টানা তৃতীয় বছরের মত করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন তিনি।

পাশাপাশি অপ্রদর্শিত আয়কে সরকারের খাতায় আনতে বিদ্যমান সুযোগগুলোর পাশাপাশি নতুন একটি দরজা অর্থমন্ত্রী খুলে দিতে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলে বিদেশে পাচার করা অর্থ বা বিদেশে জমানো সম্পদও বাংলাদেশের সরকারের কাছে বৈধতা পেয়ে যাবে, ওই অর্থের উৎস কেউ জানতে চাইবে না। 

প্রত্যাশা থাকবে সামাজিক সুরক্ষায়

মূল্যস্ফীতির কারণে টিকে থাকার লড়াইয়ে আরও নাজুক হয়ে পড়া প্রান্তিক অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ রাখতে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বর্তমান উদ্যোগগুলো চালু রাখার পাশাপাশি গৃহহীণদের জন্য আবাসস্থলের আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব থাকতে পারে মুস্তফা কামালের বাজেটে।

নিম্ন আয়ের মানুষকে কম দামে খাদ্য বিতরণ বাড়ানোর জন্যও আসতে পারে বাড়তি বরাদ্দের ঘোষণা।

মূল্যস্ফীতির অভিঘাত থেকে প্রান্তিক মানুষকে বাঁচানোর এসব পদক্ষেপকে আরও বিস্তৃত পরিসরে দেখতে অর্থনীতিবিদসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকে দাবি তোলা হচ্ছে।

সেজন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ থাকলেও নতুন বাজেটের খসড়ায় এ খাতে জিডিপির হিসাবে বরাদ্দ উল্টো কমছে।

টাকার অঙ্কে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে সামাজিক সুরক্ষার খাতগুলোতে মোট ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়, যা চলমান বাজেটে এ খাতের বরাদ্দের তুলনায় ৫ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকা বেশি।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সামাজিক কল্যাণ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব থাকছে।

তবে অনেক সমালোচনার পরও সরকার এবারও সামাজিক সুরক্ষা খাতের আওতায় সরকারি কর্মচারীদের অবসর ও পারিবারিক ভাতা এ খাতের মধ্যে রেখেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হতে পারে এ খাতে।

সামাজিক সুরক্ষার আওতায় রাখা হয়েছে কর্মসৃজন কর্মসূচি। এ খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব করা হচ্ছে মোট ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। আর খাদ্য নিরাপত্তার জন্য প্রস্তাব থাকতে পারে ১৯ হাজার কোটি টাকা।

সরকারি ভাতা ও সুবিধাভোগী আরও বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “সরকারের ৫০০ টাকা পাওয়া একজন গত বছর ওই অর্থ দিয়ে যে পরিমাণ খাদ্য পণ্য কিনতে পারতেন এ বছর কোনওভাবেই তা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অর্থাৎ ওই দরিদ্র্য মানুষ আরও খাদ্য নিরপত্তাহীনতায় পড়ে গেলেন।”

নতুন বাজেটে সব ভাতা বাড়ানোর কথা বলেন অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেনও। তিনি বলেন, “আগে যে ৫০০ টাকা ছিল এখন কিন্তু ৫০০ টাকা প্রকৃত আয়ে নেই। এটি বাড়াতে হবে।”

বাজেট নিয়ে এবারও আগাম খুব বেশি কথা বলেননি অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। এনবিআর আগাম কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারও ব্যয় সংকোচনের কিছু নির্দেশনা দিলেও বাজেটে সরকারি ব্যয় ও ভর্তুকি বাড়িয়ে সম্প্রসারণমূলক করার ইঙ্গিতই মিলেছে এখন পর্যন্ত।

[প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন রিয়াজুল বাশার, জাফর আহমেদ, ফয়সাল আতিক ও ফারহান ফেরদৌস]