‘অর্থনীতিকে যিনি বড় করে দেখার চিন্তা করতে পারতেন’

অর্থনীতিকে বড় করে দেখার চিন্তা করতে পারতেন তিনি, ছিলেন অনেকেরই ‘মুরুব্বি’, তার হাতে না পড়লে দেশের অর্থনীতি ‘আরও বিপথে’ চলে যেতে পারত।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2022, 07:09 PM
Updated : 1 May 2022, 03:54 AM

সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নিয়ে এমনটাই বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

তবে খেলাপিদের বারবার ‘সুবিধা দেওয়া’ এবং পুঁজিবাজারকে উদারনৈতিকভাবে ‘চালাতে না পারার’ ফলে কিছু মানুষের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাজেট প্রদানকারী সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিতের মৃত্যুর পর তার মন্ত্রীত্বের সময়ের কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এসব কথা বলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গভর্নর।

অধ্যাপক ফরাসউদ্দিন বলেন, “উনি আমাদের অনেক বড় মুরুব্বি ছিলেন। সিভিল সার্ভিসের লোক ছিলেন। ওনার হাতে না পড়লে বাংলাদেশের অর্থনীতি হয়ত বিপথে চলে যেতে পারত।

“তিনি মোটামুটি বাজেট বড় করে দেশের সম্পদ আহরণ করে প্রবৃদ্ধিটা বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন।”

শুক্রবার রাতে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৮৮ বছর বয়সী মুহিত। ২০২১ সালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।

দীর্ঘ কর্মজীবনে কখনও সরকারি কর্মকর্তা, কখনও কূটনীতিক, কখনও আবার অর্থনীতির শিক্ষক, লেখক বা গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র আবুল মাল আবদুল মুহিত।

সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শেষ করে ১৯৫৬ সালে মুহিত যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। প্রায় তের বছর পূর্বপাকিস্তান এবং কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের চাকরি করে ১৯৬৯ সালে তিনি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে ইকনোমিক মিনিস্টারের দায়িত্ব পান।

একাত্তরের জুন মাসে তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক-রাজনৈতিক মহলে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখেন।

দেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে পরিকল্পনা সচিবের দায়িত্ব পান মুহিত। ১৯৭৭ সালে তাকে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব করা হয়।

২৫ বছরের সরকারি চাকরিজীবনে বিভিন্ন ভূমিকায় দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যান মুহিত। এরপর ‘অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে’ কাজ শুরু করেন ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও আইএফএডি-তে।

১৯৮২-৮৩ সালে তখনকার এইচ এম এরশাদ সরকারের সময়ে প্রথমবারের মত অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে আসেন মুহিত। সেই দায়িত্ব ছাড়ার পর দীর্ঘদিন বিশ্ব ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। মাঝে ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে উড্রো উইলসন স্কুলে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন।

মুহিত দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন এই শতকের শুরুতে। ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর হন অর্থমন্ত্রী। টানা ১০ বছর সেই দায়িত্ব পালনের পর ২০১৮ সালে নিজেই অবসরে যান।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে সংসদে রেকর্ড ১২ বার বাজেট দিয়েছেন মুহিত। এর শেষ দশটি বাজেট এসেছে ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের দুই মেয়াদের টানা দশ বছরে। 

বাজেটের আকার বাড়তে থাকায় অর্থনীতিতে গতি আসছে বলে প্রশংসাও পান মুহিত। তবে তার ‘উচ্চাভিলাষী’ বাজেট নিয়ে সমালোচনাও হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাসউদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশে আর কোনো অর্থমন্ত্রী এত বাজেট দেননি। উনি ইংরেজি পড়েও অর্থনীতির ওপর বেশ ভালো দখল অর্জন করতে পেরেছিলেন।

“ওভারঅল তার হাতে সবচেয়ে বড় যে কাজটি হয়েছে সেটা হলো, বাজেটের আকার বাড়ানো। এটা তার বিশাল কৃতিত্ব বলতে হবে। তিনি অর্থনীতিকে বড়ভাবে দেখার চিন্তা করতে পারতেন।”

আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী হওয়ার বছরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৯৯ হাজার ৯৬২ কোটি টাকার।

জাতীয় সংসদে বৃহস্পতিবার ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ছবি: পিআইডি

দায়িত্ব নিয়ে এর পরের বার ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে বাজেট বাড়িয়ে করা হয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এরপর প্রতি অর্থবছরেই বাজেট ও রাজস্ব আহরণের গতি বাড়তে শুরু করে।

নিজের দায়িত্বের শেষ বছরে এসে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে তিনি দিয়েছিলেন ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট।

২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে।

সাবেক গভর্নর বলেন, “যেহেতু বিশ্বব্যাংকে চাকরি করেছেন, এক্সটার্নাল রিসোর্স বিভাগে চাকরি করেছেন, সেজন্য দেশের ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির পরিমণ্ডলটা তার (মুহিতের) খুব ভালোভাবে জানা ছিল।”

অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুহিতের দায়িত্ব পালনের সময় খেলাপি ঋণ বাড়তে শুরু করে সেইসঙ্গে দেশের আর্থিক খাতের বেশ কিছু কেলেঙ্কারির ঘটনাও ফাঁস হয়।

এসবের মধ্যে হলমার্ক, বেসিক ব্যাংক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি গ্রুপের কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ঘটনা অন্যতম।

এসব ঘটনার অভিঘাতে নানা সমালোচনার মধ্যেও টানা এক দশক অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো মুহিতের মধ্যে অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় দেখেন ফরাসউদ্দিন।

“অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের শেষ দিকে এসে তিনি (মুহিত) বলেছিলেন, খেলাপিদের ব্যাপারে আরও কঠোর নীতি অবলম্বন করা উচিত ছিল। ব্যাংকিং সিস্টেম আরও শক্ত হাতে পরিচালনা করা উচিত ছিল।

আ হ ম মুস্তফা কামালের শুরু, আর আবুল মাল আবদুল মুহিতের সারা। বৃহস্পতিবার ঢাকার সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব ভবনে বিরল এক মুহূর্তে সাবেক ও বর্তমান অর্থমন্ত্রী। ছবি: আব্দুল্লাহ আল মমীন

“অর্থাৎ তিনি নিজের কাজের মূল্যায়ন করেছেন। সব সময় তো আর সব নীতি কারেক্ট করা যায় না।”

অর্থনীতিকে বড় করার তাড়নায় ২০০৯ সালে মুহিতের নেতৃত্বে শেয়ারবাজার বড় করার উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। অর্থপ্রবাহ বেড়ে বাজার ফুলেফেঁপে ২০১০ সালে শুরু হয় মহাধস।

সেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে অর্থমন্ত্রী থাকার শেষ দিন পর্যন্ত খাটতে হয়েছে মুহিতকে। সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হয়েছেন প্রতিনিয়ত।

তবে স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনাকে আলাদা করা বা ডিমিউচুয়ালাইজেশনকে ১২ বছর অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মুহিতের সফলতা হিসেবেই দেখা হয়।

ফরাসউদ্দিন বলেন, “শেয়ারবাজার সম্পর্কে উনি দুএকবার খুব আপত্তিজনক কথা বলেছেন। এটা সম্পর্কে উনার ধারনা কতখানি স্বচ্ছ ছিল আমি নিশ্চিত নই। শেয়ারবাজার জিনিসটা খুব জটিল।

“শেয়ার বাজার, মূলধন বাজার এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থা- এগুলো সম্পর্কে যারা অর্থনীতি পড়েছেন তারা এসবের সমস্যার গভীরে যেতে পারেন।”

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম বড় লক্ষ্য দারিদ্র্য নিরসন। এ জন্য সরকার যে বাজেট বরাদ্দ করতে চেয়েছিল তার তহবিল ব্যবস্থাপনা মুহিত ভালোভাবেই করেছেন বলে মনে করেন ফরাসউদ্দিন।

তিনি বলেন, “উনি যেই বিষয়টি করার চিন্তা করেছিলেন, কিন্তু করতে পারেননি, সেটা হচ্ছে- শিল্প উন্নয়ন ও রপ্তানিখাতে বহুমুখিতা অর্জন। এটা আজও  পর্যন্ত করা সম্ভব হয়নি।

“যেমন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা নীতি বাংলাদেশের দু’একজন অর্থমন্ত্রী ছাড়া বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে পারেননি। কল্যাণ রাষ্ট্রের নীতি বাস্তবায়ন করা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা যেন কেন্দ্রীভূত না হয় সেটা পরিহার করা- এসব কিন্তু করা সম্ভব হয়নি।”

আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ২০০৯ সালে প্রথম বাজেট দেওয়ার পরদিন সংবাদ সম্মেলনে আবুল মাল আবদুল মুহিত। ছবি: নাসিরুল ইসলাম

ফরাসউদ্দিন বলেন, “খেলাপিদের বারবার সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ফলে এবং পুঁজিবাজারকে উদারনৈতিকভাবে চালাতে না পারার ফলে কিছু মানুষের হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে।”

নিজস্ব সম্পদে বাজেট ও অর্থব্যবস্থা পরিচালনা করার নীতি থেকে সরে যাওয়ায় গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বহু পরিমাণে বেড়ে গেছে বলে মনে করেন সাবেক এই গভর্নর।

তিনি জানান, এক সময় বার্ষিক দায় ছিল রপ্তানি আয়ের ৫, ৬, ৭ ও ৯ শতাংশ। এটা এখন শতকরা ২০, ২১ এবং ২২ শতাংশ হয়ে উঠেছে।

ফরাসউদ্দিন বলেন, “অর্থনীতি পড়ে যারা এগুলো ডিল করেছেন তারা এগুলোর মর্মটা ভালোভাবে বুঝতে পারেন। যারা অন্যান্য বিষয় পড়ে পরবর্তীতে অর্থনীতিবিদ হয়েছেন তারা এগুলো সম্পর্কে অতটা ভালো উপলব্ধি হয়তো সব সময় করতে পারেন না।”

অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, “তবে মোটামুটি ওনাকে বেশিরভাগ লোকই সফল অর্থমন্ত্রী বলে থাকেন।

“বিশেষ করে যারা শিল্পপতি ও ঋণখেলাপি তারা কিন্তু বেশ প্রশংসা করছেন, কোনো খারাপ বলতে শুনিনি।”