এনবিআর চেয়ারম্যানদের চোখে অর্থমন্ত্রী মুহিত

বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে প্রথম লক্ষ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, ১০ বছরে সেই বাজেটের অঙ্ক বাড়িয়ে ফেলেন ৩৬৫ শতাংশে।

জাফর আহমেদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 April 2022, 10:33 AM
Updated : 30 April 2022, 10:34 AM

বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিজেকে ‘উচ্চাভিলাষী’ বলতেন মুহিত; তার টাকার অঙ্ক নিয়ে সমালোচনা হলেও বড় বাজেট দিয়ে অর্থনীতির চাঞ্চল্য বাড়ানোর লক্ষ্য ছিল তার।

তার বিশাল বাজেটের সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেও চলতে হত, কেননা বাজেটের অর্থ সংস্থানে রাজস্ব আদায়ের কাজটি এই সংস্থাটিকেই করতে হত।

ফলে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে কাছে থেকে দেখেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দুই চেয়ারম্যান মো. নাসির উদ্দীন আহমেদ ও গোলাম হোসেন।

রাজস্ব আদায় বাড়ানোসহ বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির মূল ভিত তৈরি করার ক্ষেত্রে মুহিতের অবদান স্মরণ করছেন তারা।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে সর্বাধিক ১২ বার জাতীয় বাজেট উপস্থাপনকারী মুহিত ৮৮ বছর বয়সে শুক্রবার মারা যান। সমান সংখ্যক বাজেটএম সাইফুর রহমানও দিয়েছিলেন।

সরকারি চাকরির পর উন্নয়ন সংস্থায় দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন মুহিত, অবসর নেওয়ার পর এই শতকের শুরুতে যোগ দেন আওয়ামী লীগে, নামেন সরাসরি রাজনীতিতে।

সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৯ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। অবশ্য এর আগেও সামরিক সরকার আমলে একবার অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি।

রাজনৈতিক দলের অর্থমন্ত্রী হয়ে টানা এক দশক দায়িত্ব পালনের পর ২০১৯ সালে নিজেই অবসর নেন রাজনীতি থেকে। 

২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে ৬১ হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিলেন তিনি, নিজের শেষ বাজেটে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেই টাকার অঙ্ক নিয়ে যান প্রায় ২ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকায়।

বাজেটের আকারের সঙ্গে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর দিকটিতেও যে মুহিত গুরুত্ব দিতেন, তা তুলে ধরলেন নাসির উদ্দীন, অর্থমন্ত্রী মুহিত যাকে প্রথম পেয়েছিলেন এনবিআর চেয়ারম্যান পদে।

নাসির উদ্দীন আহমেদ। ফাইল ছবি

নাসির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একসময়ের সরকারি চাকরীজীবী হিসেবে কাজ করেও তিনি দেশের উন্নয়ন, রাজস্ব আহরণ বাড়ানোসহ সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা এক কথায় অনবদ্য।

“তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে প্রায় ৪ বছর ধেরে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তার মতো এত একনিষ্ঠ, কর্মঠ, সত্যনিষ্ঠ এবং তার দায়িত্ব পালনে প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তিনি গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করতেন।”

নাসির বলেন, “উনার মধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে গ্লোবাল ভিশন ছিল। বাংলাদেশে যে জিডিপি গ্রোথ, দেশের উন্নয়ন, রপ্তানি বাণিজ্যসহ অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে যে অসাধারণ উন্নতি, এটা তার কারণে সম্ভব হয়েছে।

“তিনি বুঝেছিলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে রাজস্ব আয় বাড়ানো। তিনি প্রথম থেকেই পরিকল্পনা নেন কীভাবে রাজস্ব আয় বাড়ানো যাবে। এই পরিকল্পনার বিশালতা ছিল, যাতে অনেক দিন ধরেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়। তার ওই দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার মূলমন্ত্র ছিল কীভাবে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া যাবে, সেই তাড়না।”

মুহিতের দূরদর্শী চিন্তাই বাংলাদেশের আজকের অর্থনীতির মূল ভিত্তি বলে মনে করেন সাবেক এই এনবিআর চেয়ারম্যান।

“আমি মনে করি, বাংলাদেশ আজকে অর্থনৈতিকভাবে যতদূর এগিয়েছে, এটার মূল আর্কিটেক্ট জনাব মুহিত।”

অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুহিতের কাজের ধরন নিয়ে নাসির বলেন, “এমনও হয়েছে তিনি কাজ করতে করতে রাত ১২টা বেজে গেছে, ওই সময়েই কোনো এক প্রয়োজনে আমাকে ফোন করলেন। আমি অবাক হয়ে যেতাম।

“তিনি সবসময় অনানুষ্ঠানিক এবং কাজের মধ্যেই থাকতেন। তারমধ্যেই তাকে আমরা অসাধারণ ব্যক্তিত্বে পেয়েছি। সদালাপী ও সদাহাসির এই মানুষকে আমার সর্বোচ্চ মানবিক গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে।”

“আমাদের বাজেট কোন পর্যায়ে ছিল, তিনি এসে সেই বাজেট কোথায় নিয়ে গেলেন এই বিষয়টি চিন্তা করলেই ওনাকে বোঝা যাবে,” বলেন তিনি।

মুহিতের মেয়াদে দ্বিতীয় এনবিআর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ গোলাম হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি তার মতো এমন দেশপ্রেমিক, নিঃস্বার্থ এবং সৎ মানুষ আমার জীবনে কমই দেখেছি।

“রাজস্ব বোর্ড হচ্ছে দেশের প্রধান রাজস্ব আয়ের প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও সামলানো কঠিন কাজ। এই প্রতিষ্ঠানেও তিনি কোনো দিন কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন নাই।”

গোলাম হোসেন। ফাইল ছবি

গোলাম হোসেন বলেন, “এনবিআরের সঙ্গে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী বিশেষ করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক বিষয় জড়িত। তাই এখানে বড় ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেক কঠিন কাজ।

“কিন্তু উনাকে (মুহিত) যদি বোঝানো যেত যে (রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য) এটা করা দরকার। উনি সেটা খুব দ্রুত বুঝতেন এবং খুব দ্রুত সাহসী সিদ্ধান্ত নিতেন।”

রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে ‘টক্কর’ লাগলে মুহিতের সমর্থন পাওয়ার কথা বলেন গোলাম হোসেন।

তিনি বলেন, “এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে গেলে অনেক সময় অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। নানান পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সেখানে যদি মিনিস্টারের সাপোর্ট না থাকে তাহলে কাজ করা কঠিন হয়।”

একটা ঘটনা তুলে ধরে গোলাম হোসেন বলেন, “ওই সেক্টরের নামটা নাই বললাম। ওই সময়ে একটা সেক্টরে ব্যাপকভাবে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া হত। আমরা আইডেন্টিফাই করলাম যে, এখানে ২৫ শতাংশ ট্যাক্সও দেয় না। আমাদের কমিশনার পর্যন্ত ফ্যাক্টরি পর্যায় তদন্ত গিয়ে কাজ করে প্রমাণ করতে পেরেছিলাম খাতটি ব্যাপকভাবে কর ফাঁকি দিচ্ছে।

“এরপর আমরা যখন কাজ করতে গেলাম, তখন এমন চাপ সৃষ্টি হল যে, আমার মতো একজন এনবিআরের চেয়ারম্যান ওই চাপের কাছে কিছুই না। এই সিন্ডিকেট বের করার পেছনে যদি উনি (মন্ত্রী) না থাকতেন, তাহলে এনবিআরের পক্ষে এটা বের করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।”

রাজস্ব আহরণ বাড়াতে করের নতুন নতুন খাত বের করতে মুহিতের অবদান স্মরণ করেনগোলাম হোসেন।

“আমার আমলে পরিবেশ এবং শারীরিক ক্ষতির কারণে তামাকের উপর দুইটা নতুন ট্যাক্স আরোপ করা হয়। এর একটা হচ্ছে ১ শতাংশ এনভায়রনম্যান্ট ট্যাক্স। আরেকটা হচ্ছে ধূমপানের কারণে নানা রোগের চিকিৎসায় খরচ হবে এমন। ২০১৪ সালে খাতটির ওপর দুটি সারচার্জ আরোপ করেছিলাম। উনার ব্যাকিং ছাড়া এটা করা সম্ভব ছিল না।”

“রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে উনার কোনো দিন কম্প্রোমাইজ ছিল না এবং রাজস্ব আদায়ের সাথে জড়িত কারও সাথে কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না,” বলেন তিনি।