যুদ্ধের বাজারে চড়ছে ডলার, চড়তে পারে আরও

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের ডামাডোলে ডলারের দাম চড়ছেই; আসছে সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার আরও দরপতন ঘটতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সাজিদুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2022, 05:05 PM
Updated : 28 April 2022, 05:08 PM

ডলারের দামে লাগাম টানতে সরকারের নানা পদক্ষেপের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের উপর রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে এই প্রতিবেদন বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়।

প্রতিবেদনটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম দেখেছে। আর প্রতিবেদনটি নিয়ে সংসদীয় কমিটিতেও আলোচনা হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মুহম্মদ ফারুক খান এমন একটি প্রতিবেদনটি পাওয়ার কথা জানালেও তা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় তিনি বলেন, “আমরা বিষয়টি নিয়ে অবহিত হয়েছি। এটা কূটনৈতিক সমস্যা নয়, মূলত অর্থনৈতিক সমস্যা। অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি দেখছে।”

ফাইল ছবি

ডলারের দাম বেশ বেড়ে যাওয়ায় আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা সম্প্রতি জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম।

তবে অর্থনীতি গবেষক সেলিম রায়হান মনে করেন, চলমান অস্থিরতার মধ্যে পরিস্থিতির উপর নিবিড় চোখ রেখে তাৎক্ষণিকভাবে করণীয় ঠিক করা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রভাব আমরা দেখতেই পাচ্ছি, বিশ্ব ব্যাংকও এ নিয়ে কথা বলেছে।

“আমাদের দরকার এই অ্যাসেমেন্টটা সময় সময় করা। একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর করতে পারলে করণীয় ঠিক করতে পারব।”

বেশ কিছু দিন ধরে বাড়তে থাকা ডলারের চাহিদা সাম্প্রতিক সময়ে আরও তীব্র হয়েছে; এতে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে টাকার বিপরীতে দামও গিয়ে ঠেকেছে সর্বোচ্চে।

আন্তঃব্যাংক লেনদেনে টাকার বিপরীতে ডলারের দর যেমন বেড়েই চলেছে, খোলাবাজারেও তা থেমে নেই। ব্যাংক কিংবা মুদ্রাবাজার থেকে নগদ ডলার কিনতে এখন গুনতে হচ্ছে ৯২ টাকার মতো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। গত বছরের এই দিনে যা ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা।

ধারাবাহিকভাবে ডলারের দাম বেড়ে চলার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। সরাসরি প্রভাব পড়ছে আমদানিতে, বাড়ছে পণ্যের ব্যয়। বিদেশ যেতে যাদের নগদ ডলারের প্রয়োজন তাদেরও গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।

আর টাকার অবমূল্যায়নে রপ্তানি আয়ে লাভবান হওয়ার প্রচলিত ধারণার বিপরীতে রপ্তানিকারকরা বলছেন, তারাও ‘ক্ষতির’ মুখে পড়ছেন। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বাণিজ্য ঘাটতি ৫৬১ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা গত বছর একই সময়ে ছিল ৬৮৭ কোটি ডলার। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের উপর চাপ বেড়ে ডলারের বিপরীতে টাকার আরও দরপতন ঘটাতে পারে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লীপাত্র। ফাইল ছবি

যুদ্ধের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতিসহ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থ লেনদেনও জটিলতায় পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বৈশ্বিক আন্তঃব্যাংক লেনদেনের ব্যবস্থা সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, রাশিয়ার ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার ঋণে রূপপুর প্রকল্পেও তার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

“রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা এই লেনদেনে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।”

চলমান প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন এবং ঋণ পরিশোধের বিকল্প পদ্ধতি নিয়ে ঢাকা-মস্কো আলোচনার কথাও বলেন তিনি।

সংসদীয় কমিটিতে দেওয়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রাশিয়ার ঋণ চুক্তির অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক হয়ে আসে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা ওই ঋণের অর্থ লেনদেনে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

“সুইফট সিস্টেমে নিষিদ্ধ কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণের অর্থ পরিশোধ করলে তা হয়ত মাঝপথে আটকে যেতে পারে। এ অর্থ পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নাও হতে পারে।”

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২সহ যেসব প্রকল্পের বিষয়ে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত রয়েছে, সেগুলো দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে পারে বলেও মন্ত্রণালয়ের শঙ্কা।

বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় বছরে ৬৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানির তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, সুইফট থেকে বের করে দেওয়ায় রাশিয়ায় গার্মেন্টস রপ্তানি হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। ফলে যে সব পোশাকের অর্ডার জাহাজীকরণের জন্য প্রস্তুত রয়েছে, তার পেমেন্ট রিকভারি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে পণ্যবাহী জাহাজের ভাড়া ও বিমা মাশুল বেড়ে যেতে পারে, বাংলাদেশের রপ্তানির পুরোটাই এফওবি (প্রিন অন বোর্ড) ভিত্তিতে হওয়ায় রপ্তানি খরচ বাড়বে। আর আমদানির বেশিরভাগই সিএন্ডএফ (কস্ট এন্ড ফ্রেইট) ভিত্তিতে হওয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ ভাড়া আমদানিকারকদের খরচ বাড়াবে। এতে আমদানি ব্যয় বাড়বে। বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়বে।

প্রতিবেদনে পররাষ্ট্র্ মন্ত্রণালয় বলেছে, গত নয় বছরের মধ্যে তেলের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠায় প্রতিদিন জ্বালানি তেল বাবদ সরকারকে ১৫ কোটি ডলার লোকসান দিতে হচ্ছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়বে। এর প্রভাবে পরিবহনে ভাড়া বাড়বে। কৃষি উৎপাদনেও খরচ বাড়বে।

বাংলাদেশ এলএনজি আনছে মূলত কাতার থেকে।

রাশিয়া থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আমদানিকারী ইউরোপীয় দেশগুলো এই পরিস্থিতিতে কাতার, ওমান, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর দিকে ঝুঁকলে বাংলাদেশের ক্ষতির দিকটি তুলে প্রতিবেদনে বলা হয়, এতে এলএনজির দাম বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।

যুদ্ধের কারণে ইউরোপজুড়ে উদ্বাস্তু সঙ্কট তৈরি হওয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা কমে যাওয়ার শঙ্কার কথাও জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে গমের বিকল্প বাজার খুঁজে বের করার উপরও জোর দিচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থ বছরে রাশিয়া থেকে ৪ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে। আরও দেড় থেকে দুই টন আমদানির দরপত্র প্রক্রিয়াধীন।

এই পরিস্থিতি কী করণীয় প্রশ্নে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “এখন দরকার আমদানির দিকে নজর দেওয়া। অপ্রয়োজনীয় বা বলতে পারি কম প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি কমাতে হবে। তাহলে ডলারের একটা স্থিতিশীলতা থাকবে।

“বাংলাদেশ ব্যাংক মাঝে মাঝে বাজারে ডলার বিক্রি করে। কিন্তু তাতে আবার রিজার্ভে চাপ পড়তে পারে। শুধু রেমিটেন্সের ওপর নির্ভর করাটাও ঠিক নয়। এজন্য আমদানির বিষয়টায় নজর রাখতে হবে।”

বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে গত ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক জরুরি ছাড়া অন্য পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে, এতে আমদানি নিয়ন্ত্রিত হলে ডলারের চাহিদা মেটানো যাবে।

ডলারের সরবরাহ বাড়াতে ‘ডলার বন্ডে’ সীমাহীন বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। প্রবাসীদের জন্য চালু থাকা এ বন্ডের সুদের হারও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এতে সুদ আকারে ডলার দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়া যেমন কমে যাবে। আবার এ বন্ডে বিনিয়োগ বাড়লে ডলার দেশেও ঢুকবে।