সার্বজনীন পেনশন: এগোতে হবে ‘সতর্কতার সঙ্গে’

সার্বজনীন পেনশনের উদ্যোগকে ‘চমৎকার’ বললেও এর সুফল কার্যকরভাবে মানুষের কাছে পৌঁছাতে তাড়াহুড়ো না করে সতর্কতার সঙ্গে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন দুই অর্থনীতি বিশ্লেষক।

রিয়াজুল বাশারও মাসুম বিল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 April 2022, 06:58 PM
Updated : 4 April 2022, 06:58 PM

পেনশন তহবিলে নাগরিকদের অর্থ জমার সামর্থ্য বিশদভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তবেই আইন চূড়ান্ত করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

সরকারি কর্মচারীদের পেনশন বাদ রেখে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমকে পেনশন কর্তৃপক্ষের অধীনে আনার পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

সবার জন্য পেনশন সুবিধা চালুর লক্ষ্য নিয়ে গত ৩০ মার্চ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ আইনের খসড়া প্রকাশ করেছে সরকার, যাতে আগামী ১২ এপ্রিল পর্যন্ত মতামত দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।

এই উদ্যোগের প্রশংসা করছেন সাবেক গভর্নর এবং অষ্টম জাতীয় বেতন ও চাকরি কমিশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সার্বজনীন পেনশন, এটা কল্যাণ রাষ্ট্রের একটি চমৎকার ধারণা। এটা করা লাগবে, করতে হবে।”

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

তবে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে ফরাসউদ্দিন বলেন, “এটাতে বোধহয় তাড়াহুড়ার অবকাশ কম, কারণ বিষয়টা বেশ টেকনিক্যাল। এ ব্যাপারে বড় ধরনের এক্সপার্টাইজ নিয়ে বোধহয় করা দরকার, খসড়াটা পরীক্ষা করানো দরকার।”

তিনি বলেন, “এটাতে যারা পেনশনভুক্ত হবেন, তাদের কিন্তু কিস্তি দেওয়ার ক্ষমতা খুব কম। যাদের মধ্যে বিশেষ করে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত রয়েছেন। কাজেই, এর অর্থায়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এটা গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।”

বিশ্ব ব্যাংকের মুখ্য আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ সুরাইয়া জান্নাতও একই মত পোষণ করেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারকে কেয়ারফুলি মুভ করতে হবে। কারণ এটা হতদরিদ্র থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করবে।

“সরকারি-বেসরকারি দৃষ্টিভঙ্গীকে এক জায়গায় নিয়ে আসার সুযোগ এখানে আছে। সে কারণে এটার প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য সতর্কতার সঙ্গে সব সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

দেশের ষাটোর্ধ্ব সব নাগরিককে পেনশন সুবিধার আওতায় আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে নতুন এই আইন হচ্ছে।

বর্তমানে দেশে শুধু সরকারি কর্মচারীরা পেনশন পেলেও বেসরকারি চাকরিজীবীসহ সবাইকে পেনশনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি ছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে।

খসড়া আইন অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে ১৮ বছরের বেশি ও ৫০ বছরের কম বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক এই পেনশন ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতে পারবে। অংশ নিতে পারবেন বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি কর্মীরাও।

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ তহবিল গঠন করা হবে যাতে সরকারের অনুদান, এই আইনের অধীনে আদায়যোগ্য ফি ও চার্জ, সেবা বাবদ প্রাপ্ত অর্থ, সরকারের পূর্ব অনুমোদনক্রমে গৃহীত ঋণ এবং অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া অর্থ থাকবে।

কমপক্ষে ১০ বছর ধরে চাঁদাদাতারা মাসিক পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবেন। ৬০ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর পেনশন পাওয়া শুরু করবেন।

সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি অথবা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্ত্বশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবে। এক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দেবে।

নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা দুস্থ চাঁদাদাতাদের ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলের মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসাবে দেব। এক্ষেত্রে সময়ে সময়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে।

খসড়া আইনে বলা হয়, “সরকার কর্তৃক সরকারি গেজেটে বাধ্যতামূলক করিয়া প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত, প্রাথমিকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি স্বেচ্ছাধীন থাকিবে।”

সেখানে আরও বলা হয়, “সরকার কর্তৃক সময় সময় প্রজ্ঞাপন জারী হওয়া সাপেক্ষে, নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকগণের অথবা দুস্থ চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে প্রদান করিতে পারিবে।”

পেনশন ব্যবস্থাপনার জন্য সার্বজনীন পেনশন তহবিল গঠন করা হবে। তহবিলের অর্থের উৎস হিসাবে নিবন্ধিত চাঁদাদাতাদের চাঁদা, প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশগ্রহণমূলক চাঁদা, বিনিয়োগকৃত অর্থের পুঞ্জিভূত মুনাফা, সরকারের অনুদান ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া অর্থ থাকবে।

বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধবা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে ভাতাভোগী যারা, তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত সার্বজনীন পেনশন সুবিধার আওতায় কীভাবে আনা হবে, তা আইনের খসড়ায় উল্লেখ নেই।

এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের কর্মকর্তা সুরাইয়া জান্নাত বলেন, “বাংলাদেশে বিভিন্ন পেনশন সিস্টেম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে সোশ্যাল সেফটি নেটগুলো আছে, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এসব আছে, সিভিল সার্ভিস পেনশনে তো আমরা একটা রিফর্মের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।”

২০২০-২১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় ৩৩ হাজার ১৯১ কোটি ১৫ লাখ টাকা নগদ দিয়েছিল সরকার। যার মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের অবসর ও পারিবারিক অবসর ভাতা ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। এই খাতের দেখভাল করে অর্থ মন্ত্রণালয়।

বাকি ১০ হাজার ১৯১ কোটি ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হয় বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাসহ আট খাতের নগদ সহায়তা কার্যক্রমে।

এই আট খাতের নগদ অর্থ প্রদানের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে থাকে সমাজ কল্যাণ, মহিলা ও শিশু এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

২০২১-২২ সালের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমে নগদ প্রদানের জন্য মোট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৯ হাজার ৯৩৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। যার মধ্যে ২৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা যাবে সরকারি কর্মচারীদের অবসর ও পারিবারিক ভাতায়। যা মোট অর্থের ৬৭ শতাংশ।

সুরাইয়া জান্নাত।

সামাজিক নিরাপত্তার এসব উদ্যোগকে পেনশন কর্তৃপক্ষের অধীনে নিয়ে আসা দরকার ছিল মন্তব্য করে দেশের প্রথম নারী চার্টার্ড অ্যাকাউট্যান্ট সুরাইয়া জান্নাত বলেন, যেহেতু সব ক’টা পেনশন বা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, এই কর্তৃপক্ষে তহবিল ব্যবস্থাপনা কাঠামোর মধ্যে যদি সেগুলো নিয়ে আসা যায়, এটা একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পাবে।

“তাহলে এটা বেশি লাভজনক হবে। এর মাধ্যমে সার্বজনীন পেনশন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও এটাকে টেকসই করার পাশাপাশি বেশি ফলপ্রসূ করে তুলবে।”

খসড়া আইন অনুযায়ী, সরকারের সাথে পরামর্শ করে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনা, পেনশন তহবিল ব্যবস্থাপনা, চাঁদাদাতার চাঁদা জমাকরণ, পেনশনের অর্থ প্রদান, ইত্যাদি প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সম্মুখ অফিস প্রতিষ্ঠা বা পেনশন সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি অথবা নিয়োগ ও পরিচালনা করতে পারবে।

এই আইনের আওতায় চাঁদাদাতার সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠানই হইবে পেনশনের সম্মুখ অফিস।

তফসিলি ব্যাংক এবং ডাক অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কার্যালয়সমূহ এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পেনশনের সম্মুখ অফিস হিসেবে কাজ করবে।

পেনশন আদায়কারী ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান, চাঁদার পরিমাণ, কী পরিমাণে অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে বা অ্যানুইটি সার্ভিস প্রদানের বিষয়গুলো বিধি দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে খসড়া আইনে।

এসব বিধি বা প্রবিধি তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত ও বাংলাদেশের জন্য উপযোগী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভালো উদাহরণ অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন সুরাইয়া জান্নাত।

তিনি বলেন, “প্রাথমিকভাবে একটা ধারণাপত্র তৈরি করেছেন, ভালো কথা। এখন আপনাদের কাজ হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এই কাজে সক্রিয় করা। এটা কেমন করে করবো, সেটা ওয়ার্কআউট করা।

“সরকারকে এটার প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করতে হলে, সুচারুভাবে এগিয়ে নিতে হলে অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। ওরা যে আইডিয়াটা দিয়েছে, এটা ঠিক আছে, ভালো।”

বিশেষজ্ঞদের মতামত নিলে আর আগের অভিজ্ঞতা কাজে লাগালে বর্তমানে চালু থাকা সুবিধায় যেসব ‘ঘাটতি’ আছে, তা মেটানো সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।