পশ্চিমা অবরোধ রুশ অর্থনীতির দুর্গে ‘আঁচড় মাত্র’

ইউক্রেইনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অধীনে থাকা দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নতুন অবরোধ ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), তাতে কতটা প্রভাব পড়বে?

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Feb 2022, 04:21 AM
Updated : 1 March 2022, 06:35 PM

গত মঙ্গলবার আরোপ করা পশ্চিমাদের নতুন ওই অবরোধের কেন্দ্রে রয়েছে রাশিয়ার ছয়টি ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা।

তবে রাশিয়ার ওপর নতুন এই অবরোধের প্রভাব সামান্যই হবে বলে উঠে এসেছে রয়টার্সের বিশ্লেষণে।

পশ্চিমা সরকারগুলো এখনও আরও বৃহত্তর পর্যায়ের অবরোধের ‘প্যাকেজ’ আপাতত তুলে রাখতে চাইছে, যাতে সংকট আরও বাড়লে সেগুলো প্রয়োগ করা যায়।

এর অর্থ হচ্ছে রাশিয়ার ব্যাংকার বা মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ট তাদের পশ্চিমা সহযোগীদের সহসাই বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না।

ব্যাংক খাতের তিনজন নির্বাহীর সঙ্গে কথা বলে রয়টার্স লিখেছে, রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অবরোধ আরোপ হলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না বা আকস্মিক কোনো ঝুঁকিও দেখা দেবে না, যেহেতু সেদেশের ঋণদাতাদের সঙ্গে রুশ অর্থনীতির সম্পর্ক খুব কম।

নতুন পশ্চিমা অবরোধে কীভাবে ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে এবং কোন পদক্ষেপগুলো তাদের বেশি বিপাকে ফেলতে পারে তা বিশ্লেষণ করেছে রয়টার্স।

এখন পর্যন্ত কী কী ঘোষণা করা হয়েছে?

রুশ নীতি-নির্ধারকদের অর্থায়ন করছে এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ইউক্রেনীয় অংশে কার্যক্রম চালাচ্ছে এমন ব্যাংকসহ ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

অবরোধের এই প্যাকেজে রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের সব সদস্যকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যারা ইউক্রেইনের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশকে মস্কোর স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ট হিসেবে পরিচিত গেন্নাদি তিমশেংকোসহ তিনজন শতকোটিপতি এবং ৫টি ব্যাংক - রোশিয়া, ইজ ব্যাংক, গেনব্যাংক, প্রমসভিয়াজব্যাংক ও দ্য ব্ল্যাক সি ব্যাংকের বিরুদ্ধে অবরোধ ঘোষণা করেছে ব্রিটেন।

রুশ সামরিক বাহিনীর ব্যাংক ‘প্রমসভিয়াজব্যাংক’ ছাড়া বাকি ব্যাংকগুলো তুলনামূলক ছোটো। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় একমাত্র প্রমসভিয়াজব্যাংকই গুরুত্বপূর্ণ ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত।

২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অংশকে রাশিয়া একীভূত করার পর থেকে ব্যাংক রোশিয়া অবরোধের মধ্যে রয়েছে, যেহেতু ক্রেমলিনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এই ব্যাংকের ঘনিষ্ট যোগসূত্র আছে।

ওয়াশিংটনের অবরোধের তালিকায় আছে প্রমসভিয়াজব্যাংক ও ভিইবি ব্যাংক। তারা রাশিয়ার সার্বভৌম ঋণের বিষয়েও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আখ্যা দিয়েছেন পশ্চিমা সরকারের অর্থায়ন থেকে রাশিয়ার সরকারকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পদক্ষেপ। সাধারণত আর্থিক বাজারে বন্ড বিক্রির মাধ্যমে অর্থায়ন সংগ্রহ করে সরকার - এটা একটি দেশের স্বার্বভৌম ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১ মার্চের পর রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ‘সেকেন্ডারি মার্কেটে’ বন্ড লেনদেন করলে সেগুলোও তাদের বর্তমান নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর থেকে পুঁজিবাজারে রুশ ডলার বন্ডের দরপতন অব্যাহত রয়েছে।

নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কতটুকু হতে পারে?

রয়টার্সের বিশ্লেষণ বলছে, রাশিয়ার ওপর প্রভাব হবে সামান্যই।

রাশিয়ার বড় ব্যাংকগুলো বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত, যার অর্থ হচ্ছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অবরোধ দিলে এর প্রভাব সেদেশের সীমানার বাইরেও বিস্তার লাভ করবে।

তবে নতুন অবরোধ ছোট ব্যাংকগুলোতেই কেন্দ্রীভূত।

এমনকী এবারের ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের পদক্ষেপ ২০১৪ সালের ক্রিমিয়া একীভূত করার সময়ের অবরোধের মতোও বিস্তৃত নয়, যদিও ওই সময়ের অবরোধ এখনও অব্যাহত আছে।

ওই সময় পশ্চিমারা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কালোতালিকায় ফেলেছিল, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য পশ্চিমা পুঁজিবাজারে প্রবেশ সীমিত করেছিল, রাষ্ট্রীয় বড় ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল, এবং প্রযুক্তি বাণিজ্যে ব্যাপক সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছিল।

ব্রিটেনের নতুন পদক্ষেপ সেদেশে থাকা রুশ বিত্তশালী যারা ‘রুশ অলিগার্ক’ হিসেবে পরিচিত, তাদের ধন-সম্পদে হাত দেয়নি, রুশ কোম্পানিগুলোর পুঁজির প্রবেশ থামায়নি, রাশিয়ার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম সীমিত করা থেকেও দূরে রয়েছে।

নতুন পশ্চিমা অবরোধের আওতায় না থাকার খবর প্রকাশের পরপরই রাশিয়ার বৃহত্তম ব্যাংক সবেরব্যাংক ও ভিটিবির শেয়ারের দাম বেড়ে গেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আট বছর আগের চেয়ে এখন রাশিয়ার অর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পশ্চিমা অবরোধ মোকাবেলায় অনেক বেশি দক্ষ হয়ে উঠেছে, এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংক পশ্চিমা বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

২০১৪ সালের পর থেকে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের তহবিল ও ডলার থেকে আলাদা হতে শুরু করে এবং নিজেদের বিদেশি মুদ্রার মজুদে বৈচিত্র্য যোগ করতে থাকে। ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সের জানুয়ারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে রাশিয়ার রিজার্ভে স্বর্ণ ও ইউরোর পরিমাণ ডলারের মজুদের চেয়ে বেশি।

রাশিয়া কিছু শক্তিশালী ম্যাক্রোইকনোমিক বা বৃহত্তর আর্থিক সুরক্ষাও রয়েছে। যার মধ্যে আছে ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছুঁইছুঁই এবং জিডিপির তুলনায় ঋণের আনুপাতিক হার কম হওয়া, যা ২০২১ সালে ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের বিষয়ে অরাজনৈতিক ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠান র‌্যান্ড করপোরেশনের একজন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্যামুয়েল শ্যার‌্যাপ বলেন, “এবার যে অবরোধ আরোপ করা হয়েছে, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রশ্ন হচ্ছে এখান থেকে পরবর্তীতে আমরা কোন দিতে যাব। আমি আরও হতাশ হয়ে পড়ছি, এবং আমরা ধারণা আরও বড় পরিসরে রাশিয়ার সামরিক কার্যক্রম বাড়ার সম্ভাবনা আছে এবং সেক্ষেত্রে অতীতের তুলনায় আমরা সত্যিকার অর্থেই আরও গুণগত ও বিধ্বংসী পদক্ষেপ হয়তো দেখতে পাব।”

এরপর কী ধরনের অবরোধ আসতে পারে?

ইইউ জানিয়েছে, রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর তারা ‘কঠোর ব্যবস্থা’ চাপিয়ে দিতে প্রস্তুত, কিন্তু একইসঙ্গে সতর্ক করেছে যে, রাশিয়ার সঙ্গে জ্বালানি ও বাণিজ্য খতে নিবিড় যোগসূত্রের প্রেক্ষাপটে, তারা ধাপে ধাপে অবরোধের পরিধি বাড়াতে চায়।

কর্মকর্তারা মঙ্গলবারের অবরোধ আরোপকে প্রথম পর্যায় হিসেবে বিবেচনা করছেন। এটা এখনও স্পষ্ট হয় যে কখন ইইউ রাশিয়ার বৃহত্তম ব্যাংকগুলোকে নিশানা করবে।

রয়টার্স জানিয়েছে, ওয়াশিংটন একগুচ্ছ পদক্ষেপ সাজাচ্ছে যার মধ্যে আছে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া।

আন্তর্জাতিক লেনদেন ব্যবস্থা থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মস্কোকে দারুণ বেকায়দায় ফেলতে পারে। যদিও এসব পদক্ষেপ হয়ত ভবিষ্যতের জন্য তোলা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেছেন, মস্কো যদি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে, সেক্ষেত্রে রাশিয়ার সবেরব্যাংক ও ভিটিবি আমেরিকানদের অবরোধের মুখে পড়বে।

শ্যার‌্যাপ বলছেন, ওই পর্যায়ের ব্যাংকগুলো যদি অবরোধের কবলে পড়ে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোও হয়ত পাল্টা প্রতিক্রিয়ার শিকার হতে পারে। সেক্ষেত্রে সম্ভাব্য অস্ত্র হিসেবে সাইবার হামলার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে কোন পদক্ষেপ?

পশ্চিমা ঋণদাতা এবং আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হচ্ছে বৈশ্বিক লেনদেন ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত। বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশের ১১ হাজারের বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ও আর্থিক লেনদেনে এই সুইফট ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে।

এ ধরনের পদক্ষেপ রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে ফেলবে কিন্তু এর পরিণতিও জটিল। সুইফট থেকে রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করা হলে ইউরোপের ঋণদাতাদের জন্য তাদের পয়সা ফেরত পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে এবং এ ধরনের আশঙ্কা বিবেচনায় রেখে রাশিয়াও বিকল্প লেনদের ব্যবস্থা গড়ে তুলছে।

ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্টসের (বিআইএস) তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ঋণদাতাদের প্রায় তিন হাজার কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণের সিংহভাগ রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিদেশি ব্যাংকগুলোতে রয়েছে।

কোন বিদেশি ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে?

ইউরোপের ব্যাংকগুলো - বিশেষ করে অস্ট্রিয়া, ইতালি ও ফ্রান্সের ব্যাংকগুলো - রাশিয়ার অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি যুক্ত, এবং যদি সরকারগুলো নতুন অবরোধ আরোপ করে সে আশঙ্কায় তারা উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে।

বিআইএসের তথ্য বলছে ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে ইতালি ও ফ্রান্সের ব্যাংকগুলোর রাশিয়ায় আড়াই হাজার কোটি ডলার করে ঋণ পাওনা ছিল। অস্ট্রিয়ার ব্যাংকগুলোর আটকা ছিল এক হাজার ৭৫০ কোটি ডলার এবং যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোর এক হাজার ৪৭০ কোটি ডলার পাওনা ছিল।

ঋণদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে অস্ট্রিয়ার আরবিআই, যারা রাশিয়া ও ইউক্রেইনে ব্যাপক ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে তারা ‘সংকট মোকাবেলার পরিকল্পনায়’ যাবে। মঙ্গলবার ব্যাংটির শেয়ারের দর সাড়ে ৭ শতাংশ পড়েছে।

অবশ্য ২০১৪ সাল থেকে অনেক বিদেশি ব্যাংকই রাশিয়া থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে, যার ফলে অনেক ব্যাংকারই অবরোধের হুমকিতে খুব একটা উদ্বিগ্ন নন।