বেসিক ব্যাংকে নিয়োগেও ছিল অনিয়ম, তদন্তে সংসদীয় কমিটি

ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় আলোচিত বেসিক ব্যাংকের নিয়োগ ও পদোন্নতিতেও নানা অনিয়ম ছিল।

সাজিদুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Jan 2022, 06:26 PM
Updated : 2 Jan 2022, 06:27 PM

রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকে বিজ্ঞাপন কিংবা পরীক্ষা ছাড়া নিয়োগ, অনভিজ্ঞ ব্যক্তিকে বড় পদে নিয়োগসহ নানা ঘটনা উঠে এসেছে সরকারি এক নিরীক্ষায়।

ব্যাংকটির নিয়োগ নিয়ে ২০১৩-১৪ অর্থ বছরের বিশেষ সরকারি নিরীক্ষায় অনিয়মের বিভিন্ন ঘটনা উঠে আসে।

ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে মোট ৭২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে আপত্তি দেওয়া হয়।

এসব নিয়োগ ও পদোন্নতি সবই হয়েছিল ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর সময়ে।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদের সরকারি হিসাব কমিটিতে অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির জন্য উঠলে সংসদীয় কমিটি এসব অনিয়ম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে।

এসব অভিযোগ আরও খতিয়ে দেখতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে বলে সরকারি হিসাব কমিটির সভাপতি রুস্তম আলী ফরাজী জানিয়েছেন।

তিনি রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বোর্ড চাকরি দেওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু এখানে কিছু অনিয়ম হয়েছে। অনেকের যোগ্যতা ছিল না, বয়স বেশি ছিল। পদোন্নতিতেও অনিয়ম হয়েছে।

“আপত্তির অনেক জায়গা মোটাদাগে করা হয়েছে। সংসদীয় কমিটি এই অনিয়মগুলো আরও খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি করে দিয়েছে। এই কমিটি অভিযুক্ত প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিষয় আলাদাভাবে খতিয়ে দেখবে। দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনের তার ভিত্তিতে সংসদীয় কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবে।”

ওই নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, কোনো পদে চাকরির জন্য আবেদন না করে, জীবন বৃত্তান্ত ও পরীক্ষা না দিয়েও এই ব্যাংকে চাকরি পেয়েছেন অনেকে। আবার অনেকে জীবন বৃত্তান্ত জমা দিয়েছেন নিয়োগপত্র হাতে পাওয়ার পরে। চাকরির বিজ্ঞাপন ছাড়াও হয়েছে নিয়োগ। অনেকক্ষেত্রে চাকরি পেতে বয়সও কোনো বাধা হয়নি।

এসব আপত্তির বিষয়ে জবাব না পেয়ে ২০১৫ সালে বেসিক ব্যাংককে তাগাদা দিয়ে চিঠি দেয় অডিট অধিদপ্তর। জবাব না পেয়ে একই বছর আধা সরকারি পত্র জারি করা হয়।

সর্বশেষ ২০২১ সালের জুনে তারা জবাব দিয়েছে। কিন্তু জবাবগুলো সন্তোষজনক ছিল না। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ-পদোন্নতি দেওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার দায় দায়িত্ব নির্ধারণসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিয়োগকারী অথবা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর কাছ থেকে বেতন ভাতা বাবদ পরিশোধ করা অর্থ আদায় করা এবং নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

দুটি উদাহরণ

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ক‘ নামের ব্যক্তি বিদেশে রেস্তোরাঁয় কর্মরত ছিলেন। তিনি কখনও ব্যংকে চাকরি করেননি। ৫২ বছর বয়সে তিনি বেসিক ব্যংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ পান। এজন্য তাকে কোনো পরীক্ষা দিতে হয়নি। তিনি ২০১৯ সালে চাকরি থেকে অবসরেও চলে গেছেন।

অথচ ব্যাংকের নিজস্ব নিয়োগবিধি ২০০৭ অনুযায়ী, সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ বয়স সীমা ৪২ বছর এবং ব্যাংকিং খাতে ১২ বছরের পূর্ব অভিজ্ঞতা প্রয়োজন।

২০১১ সালে ‘খ’ নামের সহকারী মহাব্যবস্থাপক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। তখন তার বয়স ছিল ৪৩ বছর। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না তার। বেসিক ব্যাংকে চাকরির জন্য কোনো আবেদনও করেননি। তিনি ২০১৬ সালে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন।

দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু (ফাইল ছবি)

সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার পাঁচ বছরে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ২০০৯ সালের ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫ শতাংশ, আর ২০১৪ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশে।

জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য বাচ্চুকে ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়নও হয়। কিন্তু ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলে ২০১৪ সালে চাপের মুখে থাকা বাচ্চু পদত্যাগ করেন।

যা বলা হয়েছে নিরীক্ষায়

২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবন বৃত্তান্ত দেওয়ার আগেই নিয়োগপত্র দেওয়ায় প্রমাণিত হয় যে, ব্যাংকের নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ও সম্পূর্ণ জালিয়াতির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ২৪৮ জন ঢাকা জেলার এবং ২৪২ জন বাগেরহাট জেলার। সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুর বাড়ি বাগেরহাটে।

নিয়োগের নীতিমালায় ছিল সহকারী অফিসার, অফিসার পদে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে সব পাবলিক পরীক্ষায় ন্যূনতম দ্বিতীয় শ্রেণী সম্মানসহ স্নাতকোত্তর পাস হতে হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নিতে হবে। কিন্তু শিক্ষাজীবনে এক বা একাধিক তৃতীয় শ্রেণী পাওয়া ব্যক্তিকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৯ জন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চাকরির কোনো বিজ্ঞাপন ছাড়াই। সাত জন কর্মকর্তা শিক্ষাগত যোগ্যতার যে সনদ জমা দিয়েছেন তা ভূয়া। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের বয়স নিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমার চেয়ে বেশি।

ব্যাংকের কৃতিত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন বা ব্যাংকের কোন অসাধারণ কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হলে সেক্ষেত্রে ‘এক্সিলারেটেড প্রমোশন’ দেওয়া যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এমন ৩০ জনকে এক্ষেত্রে পদোন্নতি দিয়েছে যাদের কৃতিত্বপূর্ণ কাজের নজির নেই।