অর্থনীতি ২০২১: ঘুরে দাঁড়ানোর বছরে সঙ্গী হল দ্রব্যমূল্যের চাপ

করোনাভাইরাসের রেকর্ড সংক্রমণ আর মৃত্যুর মধ্যেও ২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলো মহামারীর প্রথম বছরের তুলনায় ইতিবাচক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।

ফয়সাল আতিক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Dec 2021, 06:48 PM
Updated : 29 Dec 2021, 06:48 PM

অর্থনীতির সব সূচক অবশ্য খেটে খাওয়া মানুষের গল্প সব সময় বলে না। ২০২০ সালে কাজ হারিয়ে যারা সরকারি সহায়তা আর ধারকর্জে টিকে ছিলেন, ২০২১ তাদের অনেকের কাজ ফিরিয়ে দিলেও দুর্দশা কাটাতে পারেনি।

এর মধ্যে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়, মধ্যবিত্তের চাল-তেলের অর্থনীতিতে তাই ২০২২ আসছে কঠিন মূর্তি নিয়েই।

মহামারীর ধাক্কা সামলে কোভিডকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকা আর ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার বিদায়ী এ বছর শেষে নতুন বছরের চ্যালেঞ্জও কম নয়; ব্যয়ের ফর্দ লম্বা হওয়ায় তা মেটানোর চাপ থাকছে সরকারের ওপরও।

আরেকটি পঞ্জিকা বর্ষ শেষে আসছে বছরে রয়েছে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে ঊর্ধ্বমুখী পণ্যমূল্য বিশেষ করে জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম ও বাড়তি আমদানি ব্যয় নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ভাবনাও।

একইভাবে স্থবিরতা কাটিয়ে কোভিড পূবর্বতী সময়ের মতো অর্থনীতিকে গতিশীল করতে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর তাগিদও অনেক, থাকছে উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আহরণের দূরহ পথ পাড়ি দেওয়ার চেষ্টাও।

মাঝ নদী থেকে দেখা পদ্মা সেতু। কোভিডের মধ্যেও কাজ চলেছে পুরোদমে। এ মেগা প্রকল্প সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতীক হয়ে থেকেছে বছরজুড়ে। সব ঠিক থাকলে আগামী জুনে সেতুতে যান চলাচলে আশাবাদী সরকার। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

 

প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি শেষের পথে থাকা ‘মাইলফলক’ কিছু মেগা প্রকল্পসহ অনেকগুলো বড় প্রকল্পের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিশাল ব্যয়ের পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবরূপ পাবে সেই চিন্তাও কম নয়।

চ্যালেঞ্জ এখানেই শেষ নয়, রয়েছে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় মূল্যস্ফীতির শঙ্কা, রেমিটেন্সের নিম্নমুখী ধারার মধ্যে বাড়তি আমদানি ব্যয় মেটানোর চাপ। আর ওমিক্রনের বিস্তারে ইউরোপ ও আমেরিকার পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেই শঙ্কা ভাবাচ্ছে রপ্তানি খাতকেও।

আগামীর এতসব জটিল হিসাব নিকাশ এবং মহামারীকালের চড়াই উৎড়াইয়ে অনেক দুঃসংবাদের মধ্যে বিদায়ী বছরের সুসংবাদটাও কম নয়। বছরের শুরুতেই স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার মাধ্যমে অনেক অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিয়েছে বাংলাদেশ।

লকডাউন অমান্য করে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গাড়ি নিয়ে বের হওয়ায় টাইগারপাস এলাকায় ২৩ জুলাই এক চালককে জরিমানা করছেন দায়িত্বরত ট্রাফিক সার্জেন্ট। ছবি: উত্তম সেন গুপ্ত

এমন সুসংবাদের মধ্যেই মুখোমুখি হতে হয়েছে জীবনযাত্রা থমকে দেওয়া একের পর এক লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধের। ছোট-বড় সব পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের লড়াকু মনোভাব আর সরকারি প্রণোদনা ও নীতি সহায়তায় শেষ পর্যন্ত সব খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর বছর হিসেবে দেখা দিয়েছে ২০২১।

মহামারী আর কঠোর লকডাউনের দুঃসহ পথ মাড়িয়ে উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানিসহ বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও অর্থনীতির সাময়িক জড়তা কাটিয়ে এনেছে গতি। রেকর্ড গড়ে একক মাসের রপ্তানি আয়ও চমক দিয়েছে।

বিদায়ী পঞ্জিকা বছরের শেষ দিকে ভালো খবর এসেছে ভোগ, বিপণন, কর্মসংস্থান, অবকাঠামো ও উন্নয়নে সার্বিক কার্যক্রম বাড়ার; যদিও হঠাৎ করে রেমিটেন্সের ছন্দপতন আর রাজস্ব আয়ের কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়া নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি রয়েই গেছে।

লকডাউন শেষে দীর্ঘ বিরতির পর খুলেছে কর্মসংস্থানের দুয়ারও। ২৯ অক্টোবর বিসিএস পরীক্ষা দিতে রাজধানীতে কেন্দ্রে ঢোকার অপেক্ষায় এক চাকরিপ্রার্থী। ফাইল ছবি

 

২০২১ সালকে কোভিডের অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার বছর হিসেবে উল্লেখ করে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, সংক্রমণের প্রথম বছরের তুলনায় পরিস্থিতি অনেক ভালো। অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই ঊর্ধ্বমুখী, আশা করা যাচ্ছে সামনের দিকে এগুলো আরও ভালো হবে। সার্বিকভাবে ধান উৎপাদন ছাড়া অন্য সব খাতেই আমাদের ভালো অবস্থান।

অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরাও কোভিডকালীন সময়কে পেছনে রেখে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া দেখছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের একাধিক ঢেউ নাড়িয়ে দিয়ে গেলেও সরকারের দ্রুত ও সময়োচিত পদক্ষেপে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।

আন্তর্জাতিক এ ঋণদাতা সংস্থা বলছে, সংক্রমণের হার কমে আসায় এবং সরকারের অনুকূল নীতি সহায়তা অব্যাহত থাকায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।

মহামারীর শুরুর ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে, যা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম। পরের ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব দেয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরেছে। তবে বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাসে তা ৬ দশমিক ৪ শতাংশ এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রাক্কলনে তা ধরা হয় ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

বিগত এক বছরের অর্থনীতি নিয়ে সম্প্রতি অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ৫০ বছরের অর্জনে বিশ্বের সব অর্থনীতিবিদ আমাদের সম্পর্কে প্রশংসা করছে। স্বাধীনতার প্রথম ৩৮ বছর লেগেছিল জিডিপির আকার ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে। আজকে সেটা চারগুণ বেড়ে ৪১১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।

“আমরা আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সামাজিক ক্ষেত্রে অসাধারণ ভালো কাজ করেছি। অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত আর্থ সামাজিক সূচকগুলো অনেক ভালো অবস্থানে আছে।”

 

উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা

বাংলাদেশের জন্য ২০২১ সালটি শুরু হয়েছে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখানোর মধ্য দিয়ে। এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা ইউএন-সিডিপির বৈঠক থেকে আসে কাঙ্খিত এ ঘোষণা।

বছরের শেষভাগে গত ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে রাখার প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পর্যবেক্ষণে থাকবে বাংলাদেশ, এর ভেতরে চলতে থাকবে উন্নয়নের বড় প্রস্তুতিগুলো।

এ অর্জনের বিপরীতে এখন কিছু চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়তে হবে বাংলাদেশকে। আগে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিশ্ববাজার ও বিশ্ব বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ বড় রাষ্ট্রগুলো থেকে যেসব সুবিধা পেয়ে আসছিল, সেগুলোর কিছু কিছু কমতে থাকবে। শুল্কমুক্ত সুবিধা কমে পণ্য রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ভালো করার চেষ্টায় নামতে হবে।

দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকের এক কারখানায় কোভিড মহামারী  নিয়ন্ত্রণের লকডাউনের মধ্যে ঢাকার মিরপুরের একটি কারখানায় কাজ করছেন শ্রমিকরা। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

রপ্তানি আয়ে সুবাতাস

মহামারীর কারণে ২০২০ সালে হঠাৎ করে হোঁচট খায় রপ্তানি। এপ্রিল, মে ও জুনে রপ্তানি নেমে গিয়েছিল তলানিতে। জুলাই থেকে আয় কিছুটা বাড়লেও বছর শেষে তা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি।

তবে ২০২১ সালের চিত্রটা একেবারে উল্টো। লকডাউন শেষে পশ্চিমা বাজারগুলোতে পণ্যের চাহিদা বাড়তে শুরু করলে বাংলাদেশের রপ্তানিও গতি পেতে থাকে। এই পঞ্জিকা বছরে আয় বাড়ার ধারায় ভালোভাবেই ফিরেছে রপ্তানি খাত। এর মধ্যে গত অগাস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে একক মাসে রপ্তানি আয়ে হয় রেকর্ড। বরাবরের মতো তৈরি পোশাকই ছিল রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত।

করোনাভাইরাস লকডাউনের সঙ্কট কাটিয়ে বছরের তৃতীয় প্রান্তিক থেকে আমদানি-রপ্তানি বাড়লে পুরোপুরি সচল হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম বন্দর। ছবি: সুমন বাবু (ফাইল ছবি)

আমদানিও বাড়ছে তড়তড়িয়ে

মহামারীকালে লকডাউনের বিধিনিষেধ উঠে যাওয়ার পর চলতি বছরের জুলাইয়ের পর থেকে দেশের আমদানি-রপ্তানি খাত চাঙ্গা হতে থাকে। রপ্তানির ক্রয়াদেশ বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়তে থাকে আমদানিও।

জুলাই মাসে আমদানি হয়েছে ৪৫৫ কোটি ডলারের পণ্য, যা ২০২০ সালের জুলাইয়ের তুলনায় ৩৪ শতাংশ বেশি। ২০২০ সালের ‍জুলাইয়ে আমদানি হয়েছিল ৩৩৯ কোটি ডলার সমমূল্যের পণ্য।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাস চার হাজার ২১৫ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। যেখানে আগের বছরের প্রথম ১০ মাসে আমদানিতে ব্যয় ছিল তিন হাজার ২৯৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার (২০২০ সালে বছরজুড়ে যা ছিল ৪ হাজার ১৭৮ কোটি ৬০ লাখ ডলার)।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যে, আমরা একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বিশ্ব পণ্যবাজার খুব বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের অর্থনীতির ওপর।

“আমদানি বিলটা অনেক বেড়ে গেছে এবছর। প্রায় ৫২ শতাংশ বেড়েছে আমদানি মূল্য পরিশোধের খরচ। পরিমাণও অনেক বেড়েছে। হয়তো মূল্য পরিস্থিতির কারণে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ, বাকিটা আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণে। এটা খুবই ভালো লক্ষণ। আমদানির পাশাপাশি রপ্তানিও বেড়েছে ২০ থেকে ২২ শতাংশ। এটাও একটা ইতিবাচক দিক।“

কোভিডের লকডাউন শেষে আবার বিদেশযাত্রা। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বহির্গমন প্রবেশপথে প্রবাসী শ্রমিকদের ভিড়।

 

রেমিটেন্সে ছন্দপতন

বিদায়ী ২০২১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দুই হাজার ৪৪ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশীরা। বছরের প্রথম ছয় মাস রেমিটেন্স প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও জুলাইয়ের পর তা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তবে এসময়ে সার্বিক প্রবাহ ৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেড়েছে। আগের বছরের একই সময়ে এসেছিল এক হাজার ৯৬৮ কোটি ডলার।

রেমিটেন্সের নিম্নগতির মধ্যে অক্টোবরে আসে ১৬৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ২২ শতাংশ কম।

বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলছেন, মহামারীকালে বৈধভাবে আসত বলে রেমিটেন্স বেড়েছিল। এখন হুণ্ডিসহ অন্য মাধ্যমে আবার আসছে বলে তা সরকারের হিসাবে আসছে না।

এনিয়ে প্রশ্ন করা হলে অর্থমন্ত্রী বলেন, “তিন মাসে এক বিলিয়ন ডলারের মতো কম এসেছে। গত বছর ২৫ বিলিয়নের মতো এসেছিল। এখন যে গতিতে এগুচ্ছে তাতে ২২ থেকে ২৩ বিলিয়নের মতো আসবে বলে মনে হচ্ছে।

“এর মূল কারণ হচ্ছে প্রবাসী ভাই-বোনেরা বিভিন্ন দেশে কর্মরত যারা ছিলেন, তারা কোভিডের সময় দেশে এসে বিভিন্ন কারণে আবার ফেরত যেতে পারেন নাই। এখন আবার যাওয়া শুরু করেছেন। ফলে রেমিটেন্সের বিষয়টি আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে আসবে।”

ফাইল ছবি

রিজার্ভে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি

গত বছরের তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ৯ শতাংশ বেড়েছে। এরমধ্যেই বছরের শেষ দিকে এসে রেমিটেন্স প্রবাহ কমেছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে আমদানি ব্যয় মেটাতে হয়েছে অন্য বছরের তুলনায় বেশি। এরপরও ২০২০ সালের তুলনায় কিছুটা প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ।

বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর শেষে ৪১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন এবং ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভের মজুদ ছিল ৪৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।

অপরদিকে ২০২১ সালের নভেম্বরে এসে রিজার্ভের পরিমান বেড়ে হয়েছে ৪৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলাল। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

চলতি বছরের অগাস্ট শেষে রিজার্ভের সংগ্রহ ৪৮ বিলিয়নের রেকর্ড ছুঁয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ ছির ৪৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা বছরে শেষে ৪৬ বিলিয়নের ঘর ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।

অর্থনীতির সব সূচক ঊর্ধ্বমুখী হলেও রিজার্ভ কেন কমছে? এমন প্রশ্নে আহসান এইচ মনসুর বলেন, রেমিটেন্সের যে প্রবৃদ্ধি ছিল কোভিডকালে, সেটা ছিল সাময়িক। এখন আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। এভাবেই বেশ কিছুদিন চলতে থাকবে বলে মনে হচ্ছে।

“নতুন করে জনশক্তি যদি বিদেশে প্রবেশ করতে পারে, তাহলে হয়তো আগামী দুই থেকে তিন বছর পর আবার রেমিটেন্স ভালো করবে।

রাজধানীর মহাখালীতে জ্বালানি তেলের পাম্প। ফাইল ছবি

চড়া বাজারে ‘হিমশিম’

শীতের সবজি বাজারে এলে কাঁচাবাজারে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও সামগ্রিকভাবে চাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় সংসার চালাতে বছরজুড়েই বেগ পেতে হয়েছে সীমিত আয়ের মানুষকে।

কোভিড মহামারীতে নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে। সবশেষ ডিজেলের দামের ‘রেকর্ড’ বৃদ্ধি আগে থেকে চড়া বাজারে আরও ব্যয় বাড়িয়েছে সবার।

বছরের শেষ দিকে জ্বালানি তেল উত্তাপ ছড়ালেও বড় অংশজুড়েই ভুগিয়েছে ভোজ্যেতেলের ক্রমাগত দাম বৃদ্ধি। থেমে থেমে চালের দাম বাড়ার বিষয়টিও চাপে রেখেছে ক্রেতাদের।

চিনি, পেঁয়াজ, ডালসহ বছরজুড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি ভুগিয়েছে বেশ। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজার পরিস্থিতিও আসছে বছরে অবস্থা বদলানোর কোনো সুখবর দিচ্ছে না।

 

মূল্যস্ফীতি ‘চোখ রাঙাচ্ছে’

খাদ্যেপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামের মধ্যে খাদ্য বর্হিভূত পণ্য বিশেষ করে তেলের দাম বাড়ার প্রভাব দেখা গেছে সবশেষ মূল্যস্ফীতির হিসেবে। এতে গেল নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে।

ওই মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে আগের বছর একই মাসে ছিল ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। আর অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৭০।

গেল নভেম্বরের মত আগের মাস অক্টোবরেও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে খাদ্যে কমলেও খাদ্য বর্হিভূত মূল্যস্ফীতি বেশি বাড়ার প্রভাব দেখা গেছে মূল্যস্ফীতিতে।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

সবশেষ হিসাবে এক বছরের গড় মূল্যস্ফীতি নভেম্বরে ছিল ৫ দশমিক ৪৮, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে একটু বেশি।

পরীক্ষামূলক যাত্রায় ১২ ডিসেম্বর সকালে ঢাকার শেওড়াপাড়ায় লাইনের উপরে চলছে মেট্রোরেল। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

দেশের আরেকটি মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আস্তে আস্তে পূর্ণতার পথে এগোচ্ছে।

এডিপি বাস্তবায়নে সেই একই চিত্র

সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় পুরোটাই হয়ে থাকে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায়। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দুই লাখ ৩৬ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা এডিপি ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৪৪ হাজার ৬১ কোটি টাকা, যা মোট এডিপির ১৮ দশমিক ৬১ শতাংশ।

আগের অর্থবছরের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে কিছুটা। ২০২০-২১ অর্থবছরে একই সময়ে বাস্তবায়নের হার ছিল ১৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

এতে আগামী পঞ্জিকা বর্ষের প্রথম ছয় মাসে সরকারকে এডিপির ৭১ শতাংশের বেশি অর্থ ব্যয় করার চাপ বরাবরের মতো রয়েই গেল।

রাজস্ব আহরণের চাপ কমেনি   

চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে এক লাখ ২৬৭ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে, যা আগের ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি।

কোভিডের কারণে গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল; আদায় হয়েছিল ৮৭ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। সে কারণে প্রবৃদ্ধি হলেও তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার, যাকে উচ্চাভিলাসী বলছেন অর্থনীতিবিদরা। নতুন পঞ্জিকা বর্ষের প্রথম ছয় মাসে সরকারের ব্যয় মেটাতে রাজস্বের বড় অংশই আহরণের চাপ থাকছে।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প এলাকা। ফাইল ছবি

মেঘনা ইকনোমিক জোন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

মনোযোগ দিতে হবে প্রস্তুতিতে

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী হতে পারে?

এমন প্রশ্নে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশনটা হয়ে যাবে, সেটা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গ্রাজুয়েশনের পরবর্তীকালের জন্য আমরা কিভাবে নিজেদেরকে প্রস্তুত করছি।

“সেখানে যথেষ্ট গ্যাপ রয়ে গেছে এবং আমাদেরকে অনেক কাজ করতে হবে। বিদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তিগুলো করতে পারিনি, সেগুলো করতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে শুরুও করতে পারিনি। এটা অনেক লম্বা প্রক্রিয়া। বাণিজ্যিক চুক্তি এক বছরে হয় না, এটার জন্য কয়েক বছর লেগে যায়। আমাদের মার্কেট একসেস আমাদেরকেই করতে হবে।“

অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, পরিবহন, বন্দর, বিদ্যুৎ ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ের সমস্যাগুলোর ঠিকঠাক করতে হবে। এগুলো করতে পারলে গ্রাজুয়েশেনের সফলতা আসবে। আগামী কয়েকটা বছরকে এলডিসি গ্রাজুয়েশন ও এসডিজি লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে নিতে হবে।

 “সামনে অনেক সামাজিক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেসব লক্ষ্য আমরা অর্জন করতে চাই, সেগুলো কিন্তু সহজ নয়। সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সার্বিক পদক্ষেপ নিতে হবে। মানসিক, আর্থিক কিংবা শারীরিকভাবে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে হবে।

আরও পড়ুন-