তিন বছর পর বাংলাদেশ থেকে কাজ নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
Published : 21 Dec 2021, 11:01 PM
কৃষি, শিল্প, সেবা, খনি, নির্মাণ ও গৃহস্থালি সেবাসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশি কর্মী নেবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটি। আর কর্মী নেওয়ার খরচ নিয়োগকর্তাই বহন করবে।
সম্প্রতি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদের মালয়েশিয়া সফরে কর্মী নেওয়ার বিষয়ে দেশটির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই হয়।
মালয়েশিয়া থেকে ফিরে মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে ইমরান আহমদ জানিয়েছেন, আরও কিছু কাজ চূড়ান্ত হওয়ার পর মালয়েশিয়া প্রান্ত থেকে চাহিদা আসার পর পাঠানো শুরু হবে প্রবাসীকর্মী।
চুক্তিতে কী আছে এবং কোন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হবে, তা জানিয়েছেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন।
মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুকদের সরকারি নির্দেশনা মেনে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা, সাবধান করেছেন দালাল চক্রের খপ্পরে না পড়তে।
মালয়েশিয়া সরকার তাদের পাঁচটি খাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বয়ে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হওয়ার পর ২০১৬ সালে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়।
পাঁচ বছর মেয়াদী এই চুক্তির আওতায় লোক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয় ১০টি জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিকে।
কিন্তু প্রবাসী এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসাজশে একটি চক্র ওই ১০ এজেন্সিকে নিয়ে সিন্ডিকেট করে শ্রমিকদের কাছ থেকে দুই বছরে ২০০ কোটি রিঙ্গিত হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
এরপর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে বাংলাদেশি কর্মীদের আর ভিসা দেয়নি মালয়েশিয়া। তবে আগে যারা ভিসা পেয়েছিলেন, তারা পরেও মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পান।
এবার কর্মী নিয়োগ যেসব খাতে
গত ১৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে আবার শ্রমিক নেওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেয় মালয়েশিয়ার মন্ত্রিসভা।
দেশটির মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান সেদিন এক বিবৃতিতে বলেন, রবার বাগান, কৃষি, শিল্প, সেবা, খনি ও পাথর আহরণ, নির্মাণ ও গৃহস্থালি সেবাসহ বিভিন্ন খাত বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে।
শুধু রাবার বাগানে বিদেশি কর্মী নিয়োগের আগের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সব খাত উন্মুক্ত করার প্রস্তাবও সরকার অনুমোদন দিয়েছে বলে জানান তিনি।
সেদিন প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান জানান, নতুন খাত হিসাবে হাউজহোল্ড বা গৃহকর্মী নিয়োগের পথও খুলে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে নিরাপত্তাকর্মীও নিয়োগ দেবে মালয়েশিয়া; এজন্য পুত্রাজায়ায় সোমবারের বৈঠকে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হামজা বিন জয়েনউদ্দিনকে ধন্যবাদ জানান ইমরান।
মালয়েশিয়ার প্রাইমারি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমোডিটিজ মন্ত্রীর বরাতে অক্টোবরে মালয় মেইলের এক খবরে বলা হয়, পাম গাছ রোপণের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে ৩২ হাজার বিদেশি কর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে। এসব নিয়োগের প্রাথমিক উৎস ইন্দোনেশিয়া এবং তারপর আসবে অন্যান্য দেশ।
মালয়েশিয়া মোট কত লোক নিয়োগ দেবে- এ প্রশ্নে মঙ্গলবার প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, “আমরা শুনি ৬-৭ লাখ শ্রমিক দরকার আছে ওদের। কিন্তু কোন খাতে দরকার সেটা আমরা জানি না। ৬-৭ লাখ হলেও ওখান থেকে চাহিদা আসার পর জানতে পারব, আমরা কতজন পাঠাব- দুই, তিন না পাঁচ লাখ।”
যেভাবে হবে নিয়োগ
বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, সমঝোতা স্মারকের আলোকে শ্রমিক পাঠানোর চাহিদা দিয়ে মালয়েশিয়া থেকে প্রস্তাব এখনও আসেনি। দুয়েকদিনের মধ্যে প্রস্তাব আসবে বলে আশা করছেন তিনি।
“আমরা তিন বছর ওয়েট করেছি, আমরা চাই তিন দিনে হয়ে যাক। কিন্তু আমিও জানি তিন দিনে হবে না। সুতরাং আরেকটু সময় দেন।”
সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী চাহিদা পাওয়ার পর নিয়োগ প্রক্রিয়া এগোবে; নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চাইলে মালয়েশিয়া প্রান্তেও রিক্রুটিং এজেন্সিও নিয়োগ করতে পারবেন।
বাংলাদেশ থেকে সেসব কর্মী যেতে চান, সবাইকে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) ডেটাবেইজে অবশ্যই নিবন্ধিত হতে হবে।
মন্ত্রী এ বিষয়ে বলেন, “আমাদের টার্গেট হল বিএমইটির ডেটাবেইজের মাধ্যমে আমরা কিন্তু লোক পাঠাব। এই মেকানিজম ওয়ার্কআউট করা হচ্ছে।”
দেশের সক্রিয় এজেন্সিগুলোর তালিকা মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবে সরকার। সেখান থেকে বাছাই করা এজেন্সিগুলো এই প্রান্তে কর্মী নিয়োগের কাজ দেখভাল করবে।
কতগুলো এজেন্সির তালিকা মালয়েশিয়ায় পাঠানো হবে- এ প্রশ্নে প্রবাসীকল্যাণ সচিব সালেহীন বলেন, “আমার কাছে যারা বৈধ তাদের তালিকা পাঠাব। সেটা যদি ১০ জন হয়, তাহলে ১০ জন পাঠাব। আর যদি ১৯শ হয়, ১৯শ পাঠাব।”
এজেন্সিগুলোর গ্রুপিং বা সিন্ডিকেট ঠেকাতে সরকার সচেষ্ট থাকবে বলে আশ্বস্ত করেছেন ইমরান আহমদ।
মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ নিয়োগকর্তার
সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, মালয়েশিয়া প্রান্তের সব খরচ নিয়োগকর্তাকে দিতে হবে, যার মধ্যে আসা-যাওয়ার বিমানভাড়াও রয়েছে।
নিয়োগকর্তা বেশিরভাগ খরচ বহন করায় শ্রমিকদের ঘাড়ে ব্যয়ের ভার তেমন থাকবে না বলেই আশা করছেন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ও সচিব।
সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, মালয়েশিয়ায় রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি নিয়োগ, মালয়েশিয়ায় আনয়ন, আবাসন, কর্মে নিয়োজন এবং কর্মীর নিজ দেশে ফেরত প্রেরণের খরচ বহন করবে।
মালয়েশিয়ায় আসার পর বাংলাদেশি কর্মীর ইমিগ্রেশন ফি, ভিসা ফি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার খরচ, ইনস্যুরেন্স সংক্রান্ত খরচ, কোভিড পরীক্ষার খরচ, কোয়ারেন্টিন সংক্রান্ত খরচসহ সব ব্যয় মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তা বা কোম্পানি বহন করবে।
নিয়োগকর্তা কর্মীর মানসম্মত আবাসন, বীমা, চিকিৎসা এবং কল্যাণ নিশ্চিত করবে। প্রত্যেক কর্মীকে মালয়েশিয়ার এমপ্লয়িজ সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায় কর্মকালীন দুর্ঘটনা বা কাজের কারণে শারীরিক সমস্যা হলে চিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং ক্ষতিপূরণ পাবে।
ফলে কর্মী ফ্রি চিকিৎসা সুবিধা, অস্থায়ী অক্ষমতার সুবিধা, স্থায়ী অক্ষমতার সুবিধা, নিরবচ্ছিন্ন উপস্থিতি ভাতা, ডিপেন্ডেন্ট বেনিফিট, পুনর্বাসন সুবিধাসহ মালয়েশিয়ার আইনানুযায়ী প্রাপ্য সুবিধাদি পাবেন।
শ্রমিককে দিতে হবে যেসব খরচ
বাংলাদেশ প্রান্তের কয়েকটি খরচ বহন করতে হবে শ্রমিককে; সেসব খরচ যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে সে বিষয়ে সরকার তৎপর থাকবে আশ্বাস দেন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী ও সচিব।
এসব খরচের মধ্যে পাসপোর্টের ফি, দেশীয় এজেন্সির ফি, বিএমইটির ফি, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের ফি এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি রয়েছে।
দেশীয় প্রান্তের খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে কি না- মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় মন্ত্রী ও সচিবকে।
সচিব সালেহীন বলেন, “এখানে সরকারের সুস্পষ্ট আইন আছে, আমরা অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করতে পারি। নির্দেশনা একটা দিতে পারি।
“আমরা অবশ্যই সেটা আমাদের নতুন এমওইউ-র আলোকে নির্ধারণ করব। একজন সর্বোচ্চ কত টাকা নিতে পারবেন। যেমন- স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য একটা প্রতিষ্ঠান কত নিতে পারবে, রিক্রুটিং এজেন্সির চার্জ কত হবে।”
বাংলাদেশে এজেন্সির সার্ভিস চার্জ নির্ধারণের বিষয়ে মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, মন্ত্রণালয় সব নির্দেশনা এক জায়গায় যুক্ত করে একটি ‘গাইডলাইন’ দেবে।
সার্ভিস চার্জ দুই বা তিন মাসের বেতনের বেশি হওয়া উচিত না, এমন ধারণা নিয়োগের ক্ষেত্রে করা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মালয়েশিয়া প্রান্তের খরচ নিয়োগকর্তা দেওয়ার ফলে কর্মীদের খরচ এবার অনেক কমে আসবে বলেই মনে করছেন মন্ত্রী।
‘দালাল থেকে সাবধান’
কর্মী নিয়োগের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালরা কর্মীদের পাসপোর্ট সংগ্রহ এবং বড় অঙ্কের টাকা নেওয়ার বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর কাছে জানতে চান এক সাংবাদিক।
সরকারের চূড়ান্ত নির্দেশনার বাইরে না যেতে এবং কাউকে অতিরিক্ত টাকা জমা না দিতে কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান মন্ত্রী ইমরান।
তিনি বলেন, “আমরা কিন্তু কালকে যদি না হয়, পরশু দিনের মধ্যেই একটা সুস্পষ্ট একটা বিজ্ঞপ্তি দেব। যেখানে বলা হবে, এই যে (টাকা) নেওয়া হচ্ছে, সেটা অবৈধ। এটা আমরা খুব কড়া ভাষায় বলব। আমি আশা করি, মানুষ এই কথাটা শুনবে।
“আর আমরা ওখানে একটা নির্দেশনা দিয়ে দেব যে, কোথা থেকে খবর পাবে আর কোথা থেকে পাবে না। পুরো সিস্টেম সেট করে দেব, যাতে যখন যাওয়া শুরু হবে, সবাই জানতে পারবে।”
সচিব এ বিষয়ে বলেন, “আমরা কর্মী পাঠাব আমাদের ডেটাবেইজ থেকে। এবং আমাদের ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত কর্মী যেন একটি পয়সাও দালালকে না দেন। কারণ, এখনও প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
“যখন প্রক্রিয়া শুরু হবে, সরকারই বলবে। এখন আমাদের ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত না হলে কোনো কর্মী মালয়েশিয়ায় যেতে পারবে না।”