ব্যয় কমানোয় দুই প্রকল্প থেকে সরে গেল চীন, বিকল্পের খোঁজ

প্রকল্প ব্যয় কমানোর কারণে রেলওয়ের দুই প্রকল্পে চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে দেশটিও অর্থায়ন করবে না বলে জানিয়েছে; এতে বিকল্প অর্থায়ন খোঁজা শুরু হয়েছে।

জাফর আহমেদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2021, 07:28 PM
Updated : 14 Dec 2021, 11:31 AM

প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনার পর রেল মন্ত্রণালয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে অর্থায়ন পেতে চেষ্টা চালাতে অনুরোধ জানিয়েছে।

চীনের বিকল্প অর্থায়ন খোঁজা শুরু হলে একটি প্রকল্পে জাপান সরকারের প্রতিষ্ঠান জাইকা আগ্রহ দেখিয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন।

প্রকল্প দুটি হল- জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং আখাউড়া-সিলেট সেকশনের মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ রেললাইনে রূপান্তর।

২০১৮ ও ২০১৯ সালে একনেকে অনুমোদিত প্রকল্প দুটির প্রস্তাবিত সম্মিলিত ব্যয় ছিল ৩০ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন প্রকল্পে ১৪ হাজার ২৫১ কোটি টাকা এবং আখাউড়া-সিলেট ডুয়েলগেজ প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১৬ হাজার ১০৪ কোটি কোটি টাকা।

পরে বাড়তি ব্যয়ের বিষয়টি সামনে এলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের তৎকালীন সদস্য শামীমা নার্গিসকে আহবায়ক করে গঠিত কমিটি ব্যয় বিশ্লেষণ করে দুই প্রকল্প থেকে ৪ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা কমানোর প্রতিবেদন দেয়।

ওই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্প দুটি থেকে ব্যয় কমানোর নির্দেশনা দেন।

এরপরই চীনা ঠিকাদার কোম্পানি সরে যাওয়ার কথা জানায় এবং দেশটির অর্থায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান চীনা কর্তৃপক্ষ অর্থায়ন করবে না বলে জানায়।

এ দুটি প্রকল্প সরকারি পর্যায়ে জি টু জি পদ্ধতিতে চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়নের কথা ছিল। চীনা শর্ত অনুযায়ী এ জন্য দেশটির ঠিকাদার নিয়োগও দেওয়া হয়।

তবে পরিকল্পনা কমিশনের পর্যালোচনার পর প্রকল্প দুটির ব্যয় কমাতে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে একটি কমিটি গঠন করা হয়; যেটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় ওই বছর নভেম্বরে ব্যয় কমানোর নির্দেশনা দেয়।

ইআরডি সরকারের ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত এ বছর ১৭ জানুয়ারি চীনকে জানায়। এ চিঠির জবাবে চীনা কর্তৃপক্ষ অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার কথা বাংলাদেশকে জানায়।

চীনের সিদ্ধান্ত জানার পর এ বছর ২৭ অক্টোবর ইআরডিতে দুটি আলাদা চিঠি পাঠিয়ে নতুন অর্থায়নের চেষ্টা চালাতে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন রেল মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চীনা অর্থায়ন কর্তৃপক্ষ প্রকল্প দুটিতে অর্থায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে রেল মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে। এরপর আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে বিষয়টি জানাই।

“পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিকল্প অর্থায়ন খোঁজার জন্য নির্দেশ দিলে আমরা ইআরডির কাছে নতুন সহযোগী সংস্থা খোঁজার অনুরোধ জানিয়েছি।”

ইতোমধ্যে জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি অর্থায়নের জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা প্রকল্পটি দুই ধাপে করতে চায়।

“প্রথম ধাপে জয়দেবপুর থেকে বঙ্গবন্ধু রেল সেতু পর্যন্ত এবং এরপর ঈশ্বরদী পর্যন্ত বাকিটা দ্বিতীয় ধাপে করতে চায় বলে জানিয়েছে।”

প্রকল্পে চীনা অর্থায়নের প্রেক্ষাপট

২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকা সফরের সময় ২৭ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায় ২২ বিলিয়ন ডলার চীনা অর্থায়নে যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছিল, সেই তালিকায় এ দুই প্রকল্প ছিল।

প্রকল্প দুটিতে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ ব্যয় বহনের কথা ছিল চীনের। আর জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও স্থানীয় ব্যয় হিসেবে বাংলাদেশের বাকি অর্থায়নের কথা ছিল।

চীনের সঙ্গে প্রকল্প দুটির ঋণ চুক্তির শর্ত হিসেবে উন্মুক্ত দরপত্রের সুযোগ না থাকায় জি টু জি ভিত্তিতে চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিইসিসি) ও চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো গ্রুপকে (সিআরবিজি) ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

প্রকল্প অনুমোদন, ব্যয় বিশ্লেষণে কমিটি

২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর একনেক সভায় ১৪ হাজার ২৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়।

পরের মাসে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠকে জি টু জি ভিত্তিতে সিসিইসিসিকে ১৯৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ১১ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকায় প্রকল্পটির কাজ করতে ঠিকাদার হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়।

দেখা গেছে, এ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৫৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। অথচ আখাউড়া-লাকসাম অংশে রেললাইন নির্মাণের প্রায় একই ধরনের প্রকল্পে কাজ চলছে প্রতি কিলোমিটারে ১৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরে।

অপরদিকে আখাউড়া-সিলেট ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এটির ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার ১০৪ কোটি টাকা।

ওই বছরের শেষের দিকে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা বৈঠকে দরপত্র ছাড়া প্রকল্পটির মূল কাজ ১২ হাজার হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরে দেওয়া হয় চীনা কোম্পানি সিআরবিজিকে।

২৩৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৫০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অথচ সিলেটের কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথে একই ধরনের কাজে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

প্রকল্প দুটির অনুমোদন প্রক্রিয়ার সময় পরিকল্পনা কমিশনের পিইসি সভায় সমমানের অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় এ দুটির ব্যয় প্রস্তাব কয়েকগুণ বেশি বলে উল্লেখ করা হয়।

পরে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ আমলে নিয়ে গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এ ব্যয় বিশ্লেষণের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের তৎকালীন সদস্য শামীমা নার্গিসকে আহবায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটি প্রতিবেদনে আখাউড়া সিলেট প্রকল্প থেকে ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি এবং জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী প্রকল্প থেকে এক হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা কমানোর কথা বলে।

জানতে চাইলে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এ দুই প্রকল্প থেকে চার হাজার ৮৫০ কোটি টাকা কমানোর নির্দেশনা দিয়েছে।

“ওই নির্দেশনা জানালে নির্বাচিত চীনের দুই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানই কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এ পরিস্থিতিতে চীনা কর্তৃপক্ষ ওই দুই প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না বলেও জানিয়েছে।”

তিনি জানান, এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ইআরডিতে বিকল্প অর্থায়নের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এই প্রকল্প পরিচালক জানান, বিকল্প হিসেবে এখন জাইকার সঙ্গে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে কথা চলছে। তবে সংস্থাটি জয়দেবপুর থেকে বঙ্গবন্ধু যমুনা রেলসেতু পর্যন্ত করতে আগ্রহী।

আখাউড়া-সিলেট ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. শহীদুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

এ বিষয়ে ইআরডির এশিয়া উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইআরডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, “চীনা কর্তৃপক্ষ এখনও এ বিষয়ে আমাদেরকে কিছুই জানায়নি।

বিকল্প অর্থায়ন চেয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের চিঠিও ‘তাদের হাতে আসেনি’ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

রেলের দুই প্রকল্পের ব্যয় বেশি ধরার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মামুন-আল-রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্রকল্প দুটি অনুমোদনের সময় তিনি ছিলেন না।

“তবে আমি আসার পরও রেলের কয়েকটি প্রকল্প এসেছে। এগুলোতেও অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব লক্ষ্য করেছি আমরা,” যোগ করেন তিনি।

তিনি বলেন, “রেল বিভাগ কেন বেশি ব্যয় নির্ধারণ করে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলাম। তারা জানিয়েছেন যে, অল্প সংখ্যক দেশ ও কোম্পানি রেলের পণ্য তৈরি করে। তারা এসব পণ্যের দাম অনলাইনে দেয় না। যে কারণে অনেক পণ্যের দাম তাদের জানা থাকে না। ফলে দাম কম বেশি হয়।”

তার ভাষ্য, আর্থিক শৃঙ্খলার স্বার্থে এ খাতের পণ্যের দাম আরও যথাযথ হওয়া উচিৎ।

আরও পড়ুন