ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে খোলার আশা

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশ আগামী বছর ডিসেম্বর নাগাদ খুলে দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছে প্রকল্পের পরিচালনা কর্তৃপক্ষ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Nov 2021, 03:15 PM
Updated : 14 Nov 2021, 03:59 AM

শনিবার ঢাকার কাওলা এলাকায় প্রকল্প কার্যালয়ে সরকারের তথ্য অধিদপ্তরের একটি দলের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের পরিচালক এএইচএম সাখাওয়াত আখতার এমন আশাবাদ জানান।

এদিন কাওলা এলাকায় দেখা যা এক কিলোমিটারের বেশি অংশে স্লাব বসেছে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই শ্রমিকরা দ্রুত হাতে রড বাঁধছেন। চলছে ঢালাই, হাঁক-ডাক, নিচে চলেছে কর্মযজ্ঞ।

সভায় সাখাওয়াত বলেন, “আমরা আশা করছি ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে পুরো উড়ালসড়কের কাজ শেষ হবে। আর ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ খুলে দেওয়া হবে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও এফডিসি পর্যন্ত সড়কটি।”

সভায় জানানো হয়, তিনটি ধাপে এ প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রথম ধাপে বিমানবন্দর থেকে বনানী স্টেশন পর্যন্ত ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দ্বিতীয় ধাপ বনানী থেকে মগবাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার।

তৃতীয় ধাপ হচ্ছে মগবাজার থেকে চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার। এই উড়ালসড়কটিতে যানবাহন চলবে উচ্চগতিতে, সেজন্য এখানে তিন চাকার বাহন চলতে দেওয়া হবে না।

প্রকল্প পরিচালক সাখাওয়াত  বলেন, “দ্বিতীয় ধাপটি মগবাজারে গিয়ে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও যে ১২ কিলোমিটার অংশটি আগামী বছর ডিসেম্বরে খুলে দেওয়ার কথা হচ্ছে তা দ্বিতীয় ধাপের চেয়ে একটু কম।

“বনানী পর্যন্ত প্রথম ধাপের কাজ অচিরেই শেষ হবে। তবে এটা এখুনি খুলে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ বিমানবন্দর থেকে বনানী পর্যন্ত মোটে ৭ কিলোমিটার সড়কে টোল দিয়ে উঠতে আগ্রহী হবেন না গাড়ি চালকরা।”

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নে মহামারীর মধ্যেও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন কর্মীরা । ছবি: মাহমুদ জামান অভি

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বনানী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত এ উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য হবে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।

এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে- আট হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। মূল উড়ালসড়কে ওঠানামার জন্য ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি র‍্যাম্প থাকবে। র‍্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়াচ্ছে ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।

প্রকল্পের এসব বিষয় উপস্থাপন করে নির্বাহী প্রকৌশলী ড. মাহমুদুর রহমান জানান, “ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রথম ধাপের ৭০ দশমিক ৭৬ শতাংশ ও দ্বিতীয় ধাপের ২৪ দশমিক ৮৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

“সব মিলিয়ে প্রকল্পের মোট অগ্রগতি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। এর মধ্যেই ২২টি স্লাব (ডেকস্লাব) বসে অনেকখানি দৃশ্যমান হয়েছে উড়ালসড়কটি।”

সভায় জানানো হয়, রাজধানীর যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে শহরের উত্তর-দক্ষিণ সংযোগকারী এই উড়ালসড়কের প্রকল্পটি সরকার হাতে নিয়েছিল ২০১১ সালে।

এক নজরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

# দৈর্ঘ্য: বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ৩১টি র‌্যাম্পসহ মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার

# তিন ধাপে কাজ: প্রথম ধাপে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বনানী রেল স্টেশন পর্যন্ত অংশের দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দ্বিতীয় ধাপে বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। তৃতীয় ধাপে মগবাজার রেলক্রসিং থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে।

# ব্যয়: প্রকল্পের মোট ব্যয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ২ হাজার ৪১৩ কো ৮৪ লাখ টাকা। বাকি টাকা দেবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।

# টোল: বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাসের টোল ১২৫ টাকা। যে কোনো এক প্রান্তে উঠে যে কোনো র‌্যাম্প ধরে নেমে গেলে সর্বনিম্ন টোল দিতে হবে ১০০ টাকা। বাসের টোল প্রাইভেটকারের টোলের দ্বিগুণ অর্থাৎ ২৫০ ও ২০০ টাকা। ট্রাকের টোল চারগুণ ৫০০ ও ৪০০ টাকা। ট্রেইলারের টোল হবে ছয় গুণ ৭৫০ ও ৬০০ টাকা।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ২৩৫টি ক্রস-বিম স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে, যার পুরোটাই দৃশ্যমান। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

যে কারণে দেরি

প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর নানা জটিলতায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (উড়ালসড়ক) কাজ আটকে ছিল। ২০১৩ সালে প্রকল্পের জন্য ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি হলেও কাজ শুরু হতে আরও সাত বছর গড়িয়ে যায়।

তবে প্রকল্প পরিচালক জানান, গত বছর শুরু হওয়ার পর কাজ এগিয়েছে ‘তড়তড়িয়ে’। মহামারীর মধ্যেও হয়েছে কাজ।

সাখাওয়াত আখতার বলেন, “প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার পর ভূমি অধিগ্রহণ, অর্থের সংস্থানসহ নানা জটিলতায় প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। এর মধ্যেই হানা দেয় মহামারী। তবে মহামারীর মধ্যেও কাজ থেকে থাকেনি।”

প্রকল্পের চুক্তি হওয়ার পর কাজ শুরু হতে সাত বছর দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রকল্প পরিচালক জানান, প্রকল্পের একটা বড় বাধা ছিল ভূমি অধিগ্রহণ।

প্রকল্পের ২১০ একর জমির মধ্যে রেলের জমি ১২৮ একর, সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২৭ একর। সাধারণ মানুষের ২৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বাকি জমি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের।

তিনি বলেন, “এসব জমি অধিগ্রহণ করে ঘর-বাড়ি স্থাপনা ভেঙে প্রকল্পের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে অনেক সময় লেগে গেছে। এর বাইরে প্রকল্পের অর্থের সংস্থানের একটা বিষয়ও ছিল।”

পরবর্তীতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো চীনা দুটি ব্যাংক থেকে ৮৬ কোটি ১০ লাখ ডলার ঋণ নিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করে। প্রকল্পের ২৭ শতাংশ অর্থাৎ দুই হাজার চারশ ১৩ কোটি টাকা (ভিজিএফ) দেবে বাংলাদেশ সরকার।

প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রকল্পের আওতায় রাজধানীর দিয়াবাড়ীতে সাড়ে তেরশ ফ্ল্যাট তৈরি করা হচ্ছে। এসব ফ্ল্যাট বাজারদরের চেয়ে কমমূল্যে ক্ষতিগ্রস্থদের দেওয়া হবে বলেও জানান প্রকল্প পরিচালক।

এখন পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের ১৪৮২টি পাইল, ২৯০টি পাইল ক্যাপ ও ২৮৫টি কলাম বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

দিতে হবে টোল

প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ফাস্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কোম্পানি লিমিটেড। এই কোম্পানির মালিকানার ৪৯ শতাংশ ব্যাংককভিত্তিক  ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির হাতে।

বাকি অংশের মধ্যে ৩৪ শতাংশের মালিকানা চায়না শ্যাংডং ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল করপোরেশনের (সিএসআই) হাতে। ১৫ শতাংশের মালিক আরেক চীনা কোম্পানি সিনো হাইড্রো।

সভায় জানানো হয়, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) আওতায় ঠিকাদারদের সঙ্গে সরকারের চুক্তি ২৫ বছরের। এর মধ্যে সাড়ে তিন বছর নির্মাণকাল। বাকি সাড়ে ২১ বছর টোল আদায় করবে অংশীদার প্রতিষ্ঠান।

সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে বলা আছে একনাগাড়ে ১৫ দিন উড়ালসেতুর ওপর দিয়ে সাড়ে ১৩ হাজার যানবাহন না চললে চুক্তির অতিরিক্ত আরও ১৫ দিন টোল আদায়ের সুযোগ পাবে অংশীদাররা।