বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেলের নির্মাণকাজ প্রায় তিন চতুর্থাংশ শেষ হওয়ার পর দুই প্রান্তের সম্ভাব্য যানজট নিরসনে নতুন করে পরিকল্পনা করতে বসেছে কর্তৃপক্ষ।
Published : 13 Nov 2021, 11:47 PM
টানেল চালুর ১০ বছর পর দুই প্রান্তে যানজটের সমস্যা হবে বলে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) সতর্কবার্তা পেয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিয়েছে সেতু বিভাগ।
অদূর ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম ঘিরে অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ বিবেচনায় টানেলসহ সংশ্লিষ্ট সড়ক অবকাঠামোকে আগামী ১০০ বছরের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য নতুন পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে সিএমপি কমিশনার সালেহ মো. তানভীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পতেঙ্গা প্রান্তে চট্টগ্রাম শহরমুখী বেশ কয়েকটি রাস্তা রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু টানেল ঘিরে চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটলে টানেলের প্রবেশপথসহ বিভিন্ন স্থানে যানজট তৈরি হতে পারে।
“এছাড়া আট-দশ বছর পরে ব্যবসায়িক চাপ বাড়বে, বন্দরের সক্ষমতা দিন দিন বাড়ছে। সব মিলিয়ে ভবিষ্যতে ১০ বছর পরে সমস্যা তৈরি হবে বলে আমরা মনে করছি।”
টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, এই কমিটির বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। তাতে এপ্রোচ রোডসহ টানেলের আশপাশের রাস্তা এমনভাবে তৈরি করা পরামর্শ দিয়েছেন সবাই, যাতে যানজটের সৃষ্টি না হয়।
নদীর দক্ষিণে আনোয়ারায় রয়েছে কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইপিজেড, সিইউএফএল, পারকি সমুদ্র সৈকত। কর্ণফুলী পেরিয়ে আনোয়ারা দিয়েই কক্সবাজার, বাঁশখালী ও মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দরে যেতে হয়।
টানেলের উত্তর প্রান্ত বা শহরের দিক থেকে ৫টি সড়ক দিয়ে টানেলে যাওয়া যাবে- আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাঠগড় সড়ক, এয়ারপোর্ট সড়ক এবং পতেঙ্গা বিচ সড়ক দিয়ে টানেল সড়কে গিয়ে প্রবেশপথ।
সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর ছিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১০ বছর পর্যন্ত টানেল দিয়ে যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করবে তাতে যানজট হওয়ার আশংকা নেই। আনোয়ারা ও কক্সবাজারকেন্দ্রিক শিল্পাঞ্চলে উৎপাদন শুরু হলে তখন যানবাহনের চাপ বাড়বে।
“সেই চাপ সামাল দেওয়াসহ আগামী ১০০ বছরের জন্য যানবাহন চলাচলে পরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো তৈরির জন্য ‘আলাদা পরিকল্পনা’ করা হচ্ছে।”
বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেতু কর্তৃপক্ষ, নির্মাণকারী সংস্থা চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসিএল) ও অভি অরূপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে টানেল নির্মাণের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করেছিল।
টানেল চালুর ১০ বছর পর যানবাহন ব্যবস্থাপনার রূপরেখা কী হবে সেবিষয়টি এই সমীক্ষায় রাখা হয়নি বলে জানান সেতু সচিব। আর তাই নতুন করে পরিকল্পনা করতে হচ্ছে সেতু কর্তৃপক্ষকে।
চালুর বছরে টানেল দিয়ে ৬৩ লাখ গাড়ি এবং কক্সবাজারের গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চালুর পর ২০৩০ সাল থেকে বছরে এককোটি ৩৯ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারে বলে ওই সমীক্ষায় ধারণা দেওয়া হয়েছে। এর ৫০ শতাংশই পণ্যবাহী গাড়ি।
এই সমীক্ষাকে ‘জোড়াতালি’ হিসেবে অভিহিত করে পরিবহন ও অবকাঠামো ড. এম শামসুল হক বলেন, “এটাকে পরিকল্পিত উন্নয়ন বলা যাবে না, এটা হচ্ছে অস্থায়ী একটা সমাধান।
“শুধু টানেল প্রজেক্ট নয়, প্রত্যেকটা প্রজেক্টে আমাদের এই ঘাটতিটা থেকে যাচ্ছে।”
পেশাদার জ্ঞানের অভাবের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সমীক্ষায় যা দিচ্ছে সরকার তাই গ্রহণ করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এমনকি পরিকল্পনা কমিশনেও এবিষয়ে দক্ষ কোনোও পরিকল্পনাবিদ নেই।
বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। অনুমোদনের দুই বছর পরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। তখন ব্যয় একদফা বাড়িয়ে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ধরা হয়।
প্রকল্পটির মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন থাকবে। মূল টানেলের সঙ্গে পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক থাকবে। আর রয়েছে ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি ওভারব্রিজ।
নির্ধারিত সময় অর্থাৎ আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হয়ে যাবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন।
বুয়েটের পূরকৌশল বিভাগের এই অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও বড় যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরির সময় সেটাকে ওই অঞ্চলের সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুষ্ঠু ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধান হিসেবে পরিকল্পনা করতে হয়, তা বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পে ছিল না।
“এতো বিনিয়োগ করে আমাদের নদীটা পার হওয়ার সমাধান দিল। কিন্তু সরকারের যে উন্নয়ন দর্শন সেটা সমীক্ষায় আনা হল না।”
রাজধানীতে তৈরি সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামোর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “ঢাকার প্রত্যেকটা প্রজেক্ট নেওয়ার সময় বলা হয়, এটা হলে যানজট দূর হয়ে যাবে, কিন্তু হয় নাই।”
যে কোনোভাবে অর্থে যোগান পাওয়ার অভিপ্রায় থেকে এভাবে স্বল্পমেয়াদী, অস্থায়ী ও অসমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় বলে মনে করেন এই অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ।