চড়া বাজারে টিসিবির ট্রাকের জন্য প্রতীক্ষার প্রহর

তেল, চিনি, ডালের জন্য ঢাকার মৌচাকে টিসিবির ট্রাকের জন্য দুই দিন অপেক্ষায় ছিলেন স্থানীয় একটি মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী সাইদুর রহমান। অপেক্ষার তৃতীয় দিনের মাথায় তিনি পণ্য পেয়ে বেশ খুশি।

তাবারুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Nov 2021, 07:11 PM
Updated : 3 Nov 2021, 07:56 PM

গত দুদিন বন্ধ রেখে বুধবার থেকে ট্রাকে করে ফের তেল, চিনি ও ডাল বিক্রি শুরু করেছে টিসিবি। দুই দিন যে পণ্য বিক্রি বন্ধ থাকবে, তা জানতেন না সাইদুর।

তিনি বলেন, “গত দুই দিন আমি ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করেছি, কিন্তু তারা আসেনি। আজকেও দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা অপেক্ষার পর ট্রাক আসে, এরপর লাইনে থেকে তেল, ডাল, চিনি কিনেছি।”

টিসিবির ট্রাকে পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩০ টাকায়, সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১০০ টাকায়, চিনি প্রতি কেজি ৫০ টাকায়, মসুর ডাল প্রতি কেজি ৫০ টাকায় মিলছিল।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যেখানে বাজারে পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬০ টাকা, চিনি প্রতি কেজি ৮০ টাকা, মসুর ডাল প্রতি কেজি ৯০ টাকা থেকে ১৪০ টাকা।

তাই দুর্মূল্যের বাজারে কম দামে নিত্যপণ্য পেতে টিসিবির ট্রাকের জন্য কেবল সাইদুরই ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় ছিলেন না, তার মতো আরও বহু মানুষ লাইনে অপেক্ষা করে গত দুই দিন ফিরে গেছেন।

“ট্রাক সাধারণত এখানে (মৌচার) আসে, সেই চিন্তা থেকেই আমি অপেক্ষা করেছি। আমার সাথে আরও অনেকেই অপেক্ষা করেছে, পরে ট্রাক না আসায় দুপুরের পর আমার মতো তারাও ফিরে গেছে।”

শেরপুর থেকে ঢাকায় আসা সাইদুর বলেন, “দেশে (গ্রামে) দুই মেয়ে তিন ছেলে ও স্ত্রী থাকে। আমি একা ঢাকায় থাকি। কিছু দিন পর পর বাড়ি যাই, বাড়ি যাওয়ার সময় এগুলো নিয়ে যাব।”

কেন- প্রশ্নে তিনি বলেন, “জিনিসপত্রের দাম এত বেশি যে বেতন, যা পাই তা দিয়ে সংসারের খরচ চলে না। এরপর ছেলে-মেয়ে স্কুলে পড়ে, এদেরও স্কুলের খরচ বাড়ছে। টিসিবির পণ্য কিনলে কিছুটা সাশ্রয়ী হয়।”

বুধবার মৌচাক দেশ টিভির অফিসের সামনে টিসিবি ডিলার মেসার্স রোহিত এন্টারপ্রাইজ পণ্য বিক্রি করছিল।

এদিন থেকে আগের চেয়ে তেলের লিটার ১০ টাকা বাড়িয়ে ১১০ টাকা এবং মশুর ডালের কেজি ৫ টাকা বাড়িয়ে ৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল। এছাড়া আগের দাম চিনি ৫৫ টাকা ও পেঁয়াজ ৩০ টাকা কেজি বহাল রয়েছে। বুধবার পেঁয়াজ বরাদ্দ ছিল না।

ক্রেতারা জানান, মৌচাকে দুপুর ১২টার দিকে ট্রাক আসে। এর আগে সকাল ৮টা থেকেই অনেকে ট্রাকের জন্য লাইনে অপেক্ষা করেন।

দেড়টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকশ নারী-পুরুষ আলাদা লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনছে। কেউ কেউ লাইন টপকে আগে যেতে চাইলে পেছনের লোকজন প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এ কারণে বেশ কয়েকবার হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।

এদিন রামপুরা টেলিভিশন ভবনের সামনের সড়কে টিসিবির ডিলার মেসার্স নাজনীন স্টোর পণ্য বিক্রি করে।

সেখানে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কয়েকশ ভোক্তা পণ্য নিয়ে ভিড় করতে দেখা যায়। লাইনের পেছনের দিকে যারা ছিলেন, তাদের অনেককে পণ্য না পেয়ে ফেরত যেতে হয়েছে।

বেশ কয়েকজন বলেন, আগের দিনগুলোতেও পণ্য নিতে এসে প্রায় অর্ধেক লোক খালি হাতে ফিরে গেছেন। ট্রাকে যে পরিমাণ পণ্য আনা হয়, তা চাহিদার অর্ধেকও হয় না।

এর জন্য তারা মহামারীর মধ্যে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখছেন।

বিটিভি ভবনের সামনের সড়কের টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনেছেন সিদ্ধেশ্বরী কলেজের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম। বোনের বাসায় থেকে পড়াশোনা করেন তিনি। তার ভগ্নিপতির একটি স্টেশনারী দোকান আছে, সময় পেলে দোকানে ভগ্নিপতিকে সহযোগিতা করেন তিনি।

রফিকুল বলেন, “বোনের সংসারের খরচ বেড়ে গেছে। তার মধ্যে আমিও এই সংসারে যুক্ত হয়েছি। দুলাভাইয়ের দোকানে বেচাবিক্রি কম। সেই জন্য মাঝে মাঝে এখান থেকে তেল, ডাল, চিনি নিলে বোনের সংসারের খরচ কিছুটা কমে।”

রামপুরার পূর্ব উলনের জমিদার গলির বাসিন্দা শামসুল ইসলাম ছিলেন টিসিবির পণ্য কেনার লাইনে। দুই ছেলে, এক ছেলের বউ ও দুই মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। কয়েক বছর আগে স্ত্রী মারা গেছেন।

তিনি বলেন, “বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। আমি রাজমিস্ত্রীর কাজ করতাম, দুই বছর আগে ভবনের ওপর থেকে ইট পড়ে কোমরে আঘাত পাই। এরপর থেকে কাজকর্ম ছেড়ে দিয়েছি। দুই ছেলে ছোট চাকরি করে, সংসারের খরচ অনেক বেশি। বাজারে জিনিসপত্রের দাম অনেক। সেই জন্য এখান থেকে কিনতে এসেছিলাম।”

পণ্য না পেয়ে শামসুল ইসলাম বলেন, “যারা আগে আসতে পারে, তারাই পায়। আমি একটু দেরি করে এসেছি, যে কারণে লম্বা লাইনের পেছনে পড়ে গেছি। ট্রাকে তো বিক্রি শেষ, শেষ হলে তারা চলে যায়, খালি হাতেও কয়েকশ মানুষ ফেরত যায়।”

টিসিবির ট্রাকের পাশে দাঁড়িয়ে বিক্রয়কর্মীকে পণ্য দেওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ করছিলেন এক নারী।

তিনি বলছিলেন, “এর আগেও আমি বহুদিন এসেছি, লাইনে দাঁড়িয়ে না পেয়ে ফিরে গেছি। আজকে আমাকে দয়া করে দেন, আপনাদের জিনিস শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমাকে দেন।”

ওই নারীর পরিচয় জানতে চাইলে তিনি কেঁদে ফেলেন। সংসারের নানা অভাব-অনটনের কথা বলতে থাকেন।

“ভাই বাসায় আমার তিনটি মেয়ে, স্বামী গাড়ি চালায়। যে বেতন পায়, তা দিয়ে সংসার চলে না। বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম প্রয়োজন থাকলেও কেনার সামর্থ্য নাই। এখানে সকালে একবার ঘুরে গেছি, কিন্তু তখন তারা (ট্রাক) আসেনি। দেড় মাস আগে একবার এসেছিলাম, ওইদিনও কিছু পাইনি।”

ঢাকার তোপখানা রোডে বুধবার টিসিবির ট্রাক থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে মানুষের দীর্ঘ লাইন। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

৭৯ বছর বয়সের রিকশা চালক খলিলুর রহমান, তিনিও টিসিবির ট্রাকের আশপাশে তেল-চিনি কিনতে ঘুরঘুর করছিলেন।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, “শরীরে শক্তি নাই, একটা রিকশা কিনেছি, এটা নিয়ে সকালে বা বিকেলে বের হই, আজ দুপুর পর্যন্ত ২০০ টাকা পেয়েছি। ভাবছিলাম এই টাকা দিয়ে এখান থেকে দুই লিটার তেল নিব, কিন্তু এত বেশি মানুষ, পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই বলে চলে যাচ্ছি।”

মাদারীপুরের খলিলুর রহমান জানান, চার ছেলে ও চার মেয়ের জনক তিনি। সবার বিয়ে হয়েছে। তবে এক মেয়ে স্বামীর সাথে বিচ্ছেদের পর তার সাথে ঢাকায় থাকে। বাবা-মেয়ের সংসার।

“মেয়েটা ছোট একটা চাকরি করে, আমিও সেভাবে আয়-রোজগার করতে পারি না। ঘর ভাড়া, বাজার খরচ, এগুলো কুলাইয়ে উঠা সম্ভব হচ্ছে না। এই কারণে এখান থেকে কিনতে চাইছিলাম।”

টিসিবির ডিলার মেসার্স নাজনীন স্টোরের মালিক নূর-ই নাজনীন বলেন, “আমাদের যতটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা স্পটে বিক্রি শেষ করে তারপর ট্রাক ফিরে যায়। এত বেশি মানুষ কিনতে আসেন তাদের সবাইকে দেওয়া সম্ভব হয় না। এটা এখন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

টিসিবির ডিলার মেসার্স এহসান এন্টারপ্রাইজ শান্তিনগর বাজার এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত পণ্য বিক্রি করেছেন।

প্রতিষ্ঠানটির মালিক এহসান এলাহী বাপ্পী বলেন, “বরাদ্দের চেয়ে সাধারণত লোকজন বেশি আসে, যে কারণে অনেককে পণ্য না পেয়ে ফেরত যেতে হয়।”

তবে রাজধানীর সব এলাকায় টিসিবি গাড়িকে কেন্দ্র করে মানুষের ভিড় সমান থাকে না বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, “টিসিবির পণ্য নিয়ে যদি কোনো ট্রাক সিপাহীবাগ এলাকায় যায়, তখন সেই ট্রাকে ভিড় বেশি থাকবে। কারণ ওই এলাকায় কম আয়ের মানুষের বসবাস বেশি। আবার গুলশান, মহাখালীতে সেই পরিমাণ ভিড় থাকে না। যদি গুলশানের সাততলা বস্তি এলাকায় ট্রাক যায়, তখন সেখানে ভিড় লাগে।”

টিসিবি বুধবার ঢাকা মহানগরীর ৫২টি স্থানে ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি করেছে। আর সারাদেশে মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ৪০০টির বেশি স্থানে ট্রাকে করে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

প্রতিষ্ঠানটি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বাজারের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য মূল্য স্থিতিশীল রাখতে ও সাধারণ আয়ের জনগণের সহায়তায় জন্য টিসিবি ‘ভর্তুকি মূল্যে’ পঞ্চম কিস্তির ভ্রাম্যমান ট্রাকে পণ্য বিক্রি করছেন।

প্রতি শুক্রবার ছাড়া আগামী ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত এই বিক্রি চলবে। প্রতি ট্রাকে ৪০০ থেকে ৬০০ কেজি চিনি, ৩০০ থেকে ৬০০ কেজি মশুর ডাল, ৪০০ থেকে ৬০০ লিটার সয়াবিন তেল ও ৫০০ থেকে এক হাজার কেজি পেঁয়াজ বরাদ্দ দেওয়া হয়।

এসব ট্রাক থেকে প্রতি গ্রাহক সর্বোচ্চ ২ কেজি করে চিনি ও মশুর ডাল, দুই লিটার করে সয়াবিন তেল এবং ২ থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত পেঁয়াজ কিনতে পারেন।