সমুদ্রসীমা: জাতিসংঘে ভারতের আপত্তিতে বাংলাদেশের জবাব

আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ের উপর ভিত্তি করে জমা দেওয়া সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারত সরকার জাতিসংঘে যে আপত্তি জানিয়েছে, পাল্টা চিঠিতে তার জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ।

মাসুম বিল্লাহ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Sept 2021, 06:27 AM
Updated : 24 Sept 2021, 06:38 AM

বাংলাদেশ সরকার বলছে, ভারত যে আপত্তি তুলেছে তা সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে ’সঙ্গতিপূর্ণ’ নয়। এখন জাতিসংঘের কমিশন অন দ্য লিমিটস অফ দ্য কন্টিনেন্টাল শেলফ (সিএলসিএস) উভয়পক্ষের অবস্থান দেখে সিদ্ধান্ত দেবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম বিষয়াবলি ইউনিটের সচিব অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল খুরশেদ আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আদালতের রায়ের উপর ভিত্তি করে ২০২০ সালের অক্টোবরে সংশোধিত সীমানা সিএলসিএসে জমা দেয় বাংলাদেশ।

”এটার জন্য ভারত অবজেকশন দিয়েছে, যাতে আমাদের দাবিটা যেন সিএলসিএস বিবেচনা না করে। সেখানে আমরা বলেছি, এটা সঠিক নয়। বলেছি, এটা আইনসম্মত নয়।”

প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। দীর্ঘ সময়ে কয়েকটি বৈঠক হলেও সমাধান না পেয়ে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক আদালতে যায় বাংলাদেশ। সেখানেও সমঝোতা না হওয়ায় ২০১১ সালের মে মাসে বিষয়টি হেগের আদালতে গড়ায়।

এর আগে ২০১২ সালে জার্মানির হামবুর্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের যে রায় দেয়, তাতে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত জলসীমার অধিকার পায় বাংলাদেশ।

এরপর ২০১৪ সালের ৭ জুলাই বিরোধপূর্ণ সাড়ে ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশকে দিয়ে ভারতের সঙ্গে নতুন সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে দেয় আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত।

আদালতের সেই রায়ের উপর ভিত্তি করে গত বছরের ২০ অক্টোবর সমুদ্রসীমা ঠিক করে সংশোধিত আবেদন জাতিসংঘের সিএলসিএসে জমা দেয় বাংলাদেশ। সেই সংশোধিত আবেদনের উপর গত ১৬ এপ্রিল আপত্তি জানিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবর চিঠি দেয় ভারত।

এরপর গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে পাল্টা চিঠি পাঠিয়ে ভারতের বক্তব্যের জবাব দেয় বাংলাদেশ, যা সম্প্রতি সিএলসিএসের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

ভারত বলছে, সংশোধিত সীমানার আবেদনে দুই সীমানার মধ্যবর্তী ‘গ্রে-এরিয়ার’ বিষয়টি স্পষ্ট করতে ’ব্যর্থ হয়েছে’ বাংলাদেশ। তাদের ভাষায়, বিস্তারিত তথ্যের অভাবে এটা ’বোঝা কষ্টকর’ যে সীমানা নির্ধারণ আদালতের রায় অনুযায়ী করা হয়েছে কি-না।

ভারতের চিঠিতে বলা হয়, সীমানা নির্ধারণ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ থাকলে সেটা সিএলসিএসের কার্যবিধির এনেক্স-১ এর মধ্যে পড়ে। সেটাকে কমিশন বিবেচনা করতে পারে। সে অনুযায়ী কমিশন যেন বাংলাদেশের প্রস্তাবিত সীমা ‘বিবেচনা না করে’।   

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সচিব খুরশেদ আলম বলেন, “বঙ্গোপসাগরের মহীসোপান নিয়ে আমাদের সাথে ভারতের কোনো বিরোধ সেই। আদালত ঠিক করে দিয়েছে, আমরাও মেনে নিয়েছি, ওরাও মেনে নিয়েছে।

”সেখানে যেহেতু বিরোধ নাই, সেখানে ভারত বলতে পারে না, বা অন্য কোনো দেশও বলতে পারে না যে, সিএলসিএস যেন আমাদের দাবিটা বিবেচনায় না নেয়। সেটাই আমরা খণ্ডন করেছি।”

মহীসোপান কী

সমুদ্র তীরে পানির নিচের যে ভূমি ঢালু হয়ে গভীর সমুদ্রে নেমে গেছে, সেটাকে কন্টিনেন্টাল শেলফ বা মহীসোপান বলে।

১৯৮২ সালের সমুদ্র আইন বিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশন অনুযায়ী, সমুদ্র তীরবর্তী দেশের স্থলভাগের শেষ বিন্দু বা বেইজ লাইন থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল এলাকা সেই দেশের অধিকারে থাকবে। এই ২০০ নটিক্যাল মাইল হবে একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড), যেখানে খনিজ আহরণ বা মাছ ধরার অধিকার একান্তভাবেই ওই দেশের।

এর পরের দেড়শ নটিক্যাল মাইল হল মহীসোপানের বর্ধিত অংশ। সেখানে খনিজ সম্পদের অধিকার তীরবর্তী দেশেরই থাকবে। তবে মাছ ধরার অধিকার পাশের দেশও পাবে।

আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী এই ৩৫০ নটিক্যাল মাইল দৈর্ঘ্যের মহীসোপানের অধিকার বাংলাদেশ দাবি করছে। পুটনি দ্বীপকে ভূমির শেষভাগ ধরে ত্রিভূজাকৃতির এই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করেছে সরকার।

ভারতের অভিযোগ কী

সমুদ্রসীমার অধিকার নিয়ে বাংলাদেশের সংশোধিত আবেদন গ্রহণ না করার দাবি জানিয়ে ভারতের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়েছে, মহীসোপান নিয়ে বাংলাদেশের জমা দেওয়া সংশোধিত সীমানা মেনে নেওয়া হলে ভারতের অধিকারহানী হবে।

”এ কারণে, কার্যবিধির এনেক্স-১ এর ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ বিবেচেনায় নিয়ে কমিশন যেন বাংলাদেশের সংশোধিত আবেদন ‘বিবেচনা ও চূড়ান্ত’ না করে।”

ভিত্তিরেখা নিয়ে ২০১৭ সালে দেওয়া আরেকটি চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে ভারত বলছে, “নতুন ভিত্তিবিন্দুর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) সমুদ্রের দিকে ধাবিত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের স্বীকৃত ’গ্রে-এরিয়াতে’ ভারতের ইইজেডের অংশ দখল করেছে। সংশোধিত আবেদনে বাংলাদেশ গ্রে-এরিয়ার বিষয় তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।”

নতুন সীমানা করার ক্ষেত্রে বিস্তারিত ’তথ্যের অভাবে’ সালিশি আদালতের রায় মেনে তা করা হয়েছে কি-না, তা ’বোঝা কঠিন’ বলেও চিঠিতে অভিযোগ করেছে ভারত।

ভারত বলেছে, কমিশনের ৪৬ নম্বর নিয়ম অনুযায়ী মহীসোপান নির্ধারণ নিয়ে বিপরীত বা নিকটবর্তী বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে বা নদী সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো বিরোধ দেখা দিলে, সেটা কার্যপ্রণালী বিধির এনেক্স-১ অনুযায়ী জমা দিতে হবে।

”সুতরাং এটা বলা যায়, রাষ্ট্রের মধ্যে সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি কমিশনের জন্য অসুবিধাজনক হবে না।”

বাংলাদেশ কী বলছে

দুই আদালতের রায়ের মাধ্যমে ভারত ও মিয়ানমার থেকে সমুদ্রসীমার অধিকার পাওয়ার কথা তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের চিঠিতে।

বাংলাদেশ সরকার বলছে, ২০০ নটিক্যাল মাইল এবং এর বাইরের মহীসোপানের অধিকার বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে পেয়েছে ২০১৪ সালের ৭ জুলাই আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ে। আর মিয়ানমারের কাছ থেকে পেয়েছে ২০১২ সালের ১৪ মার্চে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ল অব দ্য সি-র (আইটিএলওএস) রায়ে।

”বাংলাদেশের ভিত্তিরেখাগুলো নিয়ে ভারত যে আপত্তি তুলেছে, ট্রাইপয়েন্টের অবস্থানের উপর তার কোনো কার্যকারিতা নেই, কারণ তা সব দেশের উপকূলের ২০০ মাইলের অনেক দূরে।

২০১৬ সালে দুটি গেজেট নোটিফিকেশনে ভারত আদালতের রায়ের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের মধ্যে যে একক সীমানা লাইন নির্ধারণ করেছে, তার মধ্যে দুটি ছেদ বিন্দু বাংলাদেশের জমা দেওয়া সংশোধিত সীমানার মতোই।

”সুতরাং বঙ্গোপসাগরে ২০০ মাইলের বাইরের মহীসোপানের অধিকার বাংলাদেশকে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।”

বাংলাদেশ বলছে, ভারতের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইজেড) বাংলাদেশের ২০০ মাইলের বাইরের মহীসোপানে ঢুকে পড়েছে। এখানে তথাকথিত ’গ্রে এরিয়া’ নির্ধারণে কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। কমিশনের ভূমিকা বাংলাদেশকে মহীসোপানের অধিকার দেওয়া ও তার সীমা ঠিক করার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

বাংলাদেশের চিঠিতে বলা হয়, ২০১১ সালে প্রথম জমা দেওয়া মহীসোপানের সীমানার ভিত্তিতে আদালতের রায় হয়। দুই আদালতের রায়ের পর ট্রাই-পয়েন্টের ভিত্তিতে সংশোধিত সীমানা করা হয়েছে।

সিএলসিএসের কার্যপ্রণালী বিধির এনেক্স-১ এর ১ নম্বর অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে চিঠিতে বলা হয়, তথাকথিত গ্রে-এরিয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের ‘মহীসোপানের বহিঃসীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আসে না’। সুতরাং এটা কার্যপ্রণালী বিধির এনেক্স-১ এর আওতায় পড়ে না। এনেক্স-১ এর ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ বাংলাদেশের জমা দেওয়া সীমানা বা তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গেও সম্পর্কিত নয়।

চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ নিশ্চিত করছে যে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে নির্ধারণ করে জমা দেওয়া সীমানা ২০১৪ সালের রায়ের সাথে সঙ্গতি রেখে করা হয়েছে।

 

ভিত্তিরেখা নিয়ে যে বিতর্ক

আদালতের রায়ের ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা ঠিক করার জন্য ভিত্তিরেখা ধরা নিয়েও বিরোধ রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ১৯৭৬ সালে করা টেরিটোরিয়াল ওয়াটার ও মেরিটাইম জোন–সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী ২০০৯ সালে ভিত্তিরেখায় সংশোধনী আনে ভারত।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আদালতের রায় পাওয়ার পর ২০১৫ সালে পুটনি দ্বীপকে স্থলভাগের শেষ বিন্দু ধরে বাংলাদেশ নতুন করে ভিত্তিরেখা ঠিক করে। পুটনি দ্বীপ থেকে দক্ষিণ ভাসানচর ঘেঁষে কক্সবাজারে মিশেছে এই রেখা।

ভিত্তিরেখার বিভিন্ন বিন্দু নিয়ে সিএলসিএসে আপত্তি দিয়েছে দুই দেশই। বাংলাদেশের ভিত্তিরেখার দুই নম্বর বিন্দু পুটনি দ্বীপ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে ভারত।

আর ভারতের তিনটি ভিত্তিবিন্দু পানির মধ্যে থাকায় সেটা নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়ে মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স বিভাগের সচিব খুরশেদ আলম বলেন, এক্ষেত্রে সমুদ্র আইন বিষয়ক জাতিসংঘ কনভেনশনের (আনক্লজ) ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ মানেনি ভারত।

”তারা স্ট্রেইট বেইজলাইন করেছে, যেটা এই আর্টিকেল ফলো করে করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, তাদের বেশ কয়েকটা বেইজ পয়েন্ট পানিতে, অথচ তা ভূমিতে হওয়ার কথা। এবং বিশেষ করে বেইজ পয়েন্ট ৮৭ নম্বরটা উপকূল থেকে সাড়ে ১০ নটিক্যাল মাইল দূরে পানির মধ্যে।”

আর ভারতের ৮৯ নম্বর ভিত্তিবিন্দু বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার প্রায় আড়াই নটিক্যাল মাইল ভেতরে পড়েছে বলেও তার ভাষ্য।

নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা যদি বেইজ পয়েন্ট আইল্যান্ডে করে থাকি, এটা আইনসম্মত। কিন্তু পানির উপর দিয়ে করাটা আইনসম্মত না। আমাদের ভেতরে তাদের বেইজ পয়েন্ট থাকাটাও আন্তর্জাতিকভাবে আইনসম্মত না।”