গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ৬৭ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির মামলা

ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনকারী গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে ৬৭ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে মামলা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Sept 2021, 02:14 PM
Updated : 23 Sept 2021, 05:34 PM

এ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবসায়িক কার্যক্রম তদন্ত করে প্রায় ৬৭ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করেছেন ভ্যাট গোয়েন্দারা। ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় ব্যাংকটির বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে মামলা করা হয়েছে।”

এছাড়া ভ্যাট আইন অনুযায়ী নিবন্ধন না নিয়ে ভ্যাটযোগ্য সেবা দেওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে আরেকটি অনিয়মের মামলা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

গ্রামীণ ব্যাংকের অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন এবং মামলার নথিপত্র ঢাকা পশ্চিম ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠানো হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যাতে প্রতি মাসের সকল আয় ও ক্রয়ের তথ্য অনুযায়ী প্রযোজ্য ভ্যাট পরিশোধ করে, তা পর্যবেক্ষণ করার জন্যও সংশ্লিষ্ট ভ্যাট কমিশনারকে অনুরোধ করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকে ভ্যাট অফিসের লোকজন গ্রামীণ সেন্টারে এসেছিল। তারা মঙ্গলবার দেখা করতে বলেছে। কিন্তু মামলার বিষয়ে তো কিছুই বলেনি।”

তিনি বলেন, একটি ‘সামাজিক প্রতিষ্ঠান’ হওয়ায় ভ্যাট থেকে আব্যাহতির সুবিধা ভোগ করে আসছিল গ্রামীণ ব্যাংক। এখন নতুন নিয়মে এ ব্যাংক ভ্যাটের আওতায় পড়ে কি না, তা তাদের দেখতে হবে।

“আমাদের অ্যাকাউন্টসের লোকজন এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে। ভ্যাট-ট্যাক্স দেওয়া লাগলে আমরা দেব। এই ব্যাংকের মালিক সমাজের গরিব দরিদ্র শ্রেণির লোকজন। আলটিমেটলি চাপটা তাদের ওপরেই পড়বে।”

কী অভিযোগ

ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর বলছে, তাদের উপ-পরিচালক নাজমুন নাহার কায়সারের নেতৃত্বে একটি দল ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে গ্রামীণ ব্যাংকের হিসাব পর্যালোচনা করে অনিয়মের বিষয়টি উদঘাটন করেন।

তাদের তদন্তে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গ্রামীণ ব্যাংক এস ০৫৬ কোডের আওতায় ব্যাংকিং ও নন-ব্যাংকিং সেবা দিয়ে আসছে; কিন্তু ভ্যাট আইন অনুযায়ী নিবন্ধন নেয়নি।

১৯৯১ সালের মূল্য সংযোজন কর আইন অনুযায়ী, করযোগ্য পণ্যের সরবরাহকারী বা করযোগ্য সেবাদানকারী সবার ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। আর এনবিআরের নিয়ম অনুযায়ী, টার্নওভার যাই হোক, সব ব্যাংক ও নন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে এ নিবন্ধন নিতে হবে।

এনবিআরের ১৬৮/২০১৩ নম্বর এসআরওতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রয়ত্ব, দেশি বা বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনে সংজ্ঞায়িত  যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা, যারা কমিশন, ফি বা চার্জের বিনিময়ে ব্যাংকিং ও নন-ব্যাংকিং সেবা দেয়, তাদের সবার ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে।

ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর বলছে, গ্রামীণ ব্যাংক কিস্তি সুবিধায় ক্ষুদ্রঋণ দেয়। এসব ঋণের ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন খরচের বিপরীতে চার্জ, ফি ও কমিশন নেয়, আইন অনুযায়ী যার ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য।

এছাড়া ১৯৯১ সালের ভ্যাট বিধিমালা অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের বিভিন্ন খরচের বিপরীতে উৎসে করও দেওয়ার কথা।

ভ্যাট গোয়েন্দাদের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে হওয়া আয়ের বিপরীতে ৩৪ হাজার ৯১০ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে। কিন্তু হিসাব করে দেখা গেছে, ওই সময়ে তাদের ভ্যাট দেওয়ার কথা ছিল ৩০ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৬০০ টাকা।

এই হিসাব দেখিয়ে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তর বলছে, গ্রামীণ ব্যাংক ৩০ কোটি ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার ৬৯০ টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।

এছাড়া পরিশোধ না করা এই ভ্যাটের উপর ২ শতাংশ হারে ১৩ কোটি ৯৯ লাখ ৯৫ হাজার ৭০৬ টাকা সুদ প্রযোজ্য হবে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংক ওই পাঁচ বছরে বিভিন্ন খরচের বিপরীতে উৎসে ভ্যাট বাবদ ৮ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার ৮১৯ টাকা পরিশোধ করেছে। কিন্তু হিসাব করে দেখা গেছে, উৎসে ভ্যাট বাবদ তাদের কাছে রাষ্ট্রের পাওনা হয় ২৩ কোটি ৯৩ লাখ ১০ হাজার ৭৪ টাকা।

এই হিসাবে গ্রামীণ ব্যাংক ১৫ কোটি ৩৮ লাখ ৮৯ হাজার ২৫৬ টাকার উৎসে কর ফাঁকি দিয়েছে এবং পরিশোধ না করায় ওই টাকার ওপর তাদের আরও ৭ কোটি ২৩ লাখ ২৬ হাজর ৯৭৭ টাকা সুদ প্রযোজ্য হয়েছে  বলে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদপ্তরের ভাষ্য।

সব মিলিয়েই গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে রাষ্ট্রের ৬৬ কোটি ৯৮ লাখ ৬০ হাজার ৬২৯ টাকা পাওনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলায়।