তালেবান ব্যাংক খোলার নির্দেশ দিলেও ব্যাংকগুলো খুলছে না বলে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বরাতে শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ মাধ্যম সিএনএন।
পরিস্থিতি কী- তা তুলে ধরতে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, “কারও কাছেই টাকা নেই।”
প্রাণের ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, নগদ টাকার অভাবে অনেক পরিবার চরম দুর্ভোগে পড়েছে। অনেকের চেক ব্যাংকে আটকে রয়েছে।
ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণকর্তা তালেবান বলার পরও কেন ব্যাংক খুলছে না- এই প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র সিএনএনকে বলেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন নগদ অর্থের অভাবে ভুগছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা বলছে, তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়েও কোনো সাড়া পাচ্ছে না।
আফগানিস্তানে মুদ্রার নাম আফগানি, এর মূল্যমান বাংলাদেশি টাকার প্রায় সমান।
কয়েক দশক ধরে চলা যুদ্ধ আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে দাঁড়াতেই দেয়নি। এর মধ্যে দুই দশক পর গত ১৫ অগাস্ট সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতার পুনর্দখল নেয় গোঁড়া ইসলামী দল তালেবান।
তালেবান কাবুল ঘিরে ফেলার পর ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তোলার হিড়িক দেখা গিয়েছিল। তারা ক্ষমতা দখলের পর একদিনেই বদলে যায় দেশটির ব্যাংক খাতের চিত্র।
আফগানিস্তানের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে বিদেশি অনুদান আর ঋণের উপর। দেশটির মোট ব্যয়ের ৭৫ শতাংশই হত বিদেশি সহায়তার উপর ভর করে। তালেবান ক্ষমতা দখলের পর সেটাই বন্ধ হয়ে গেছে।
বিশ্ব ব্যাংক ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে সহায়তা স্থগিত করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ৪৫ কোটি ডলার গত সপ্তাহে আফগানিস্তানের পাওয়ার কথা ছিল, সেটাও তড়িঘড়ি স্থগিত করেছে সংস্থাটি।
যুক্তরাষ্ট্রে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে কয়েকশ কোটি ডলার রয়েছে, তাও আটকে দিয়েছে জো বাইডেনের প্রশাসন।
সব মিলিয়ে আফগানিস্তানের ব্যাংক ব্যবস্থা এখন ধসে পড়ার অবস্থায়।
আফগান অর্থনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একজন সিএনএনকে বলেন, “পরিস্থিতি কী, তা সামনে বোঝা যাবে। দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা কতটা নাজুক, তা ব্যাংক খোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ হয়ে যাবে।”
নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগও ব্যাংক না খোলার একটি কারণ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক কর্মী এখনও কাজে যোগ দেয়নি।
“আমার সহকর্মীরা এখন অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে,” বলেন এক কর্মকর্তা।
আর বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খুলছে না টাকার তোলার হিড়িকের ভয়ে।
আফগান ব্যাংকিং গ্রুপ বলছে, তারা ১৫ অগাস্ট থেকে সব ব্যাংক বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন খুলছে না, কারণ তাতে মানুষ জমা সব টাকা তুলে নিতে চাইবে, আর এত নগদ অর্থ দেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই।
আফগান-আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স গত ২৩ অগাস্ট আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি স্মারকলিপি দিয়েছে; তাতে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
আফগানিস্তানের বাণিজ্যিক ব্যাংক, গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদেরও সংশ্লিষ্টতা ছিল এই স্মারকলিপি লেখায়।
এতে আরও বলা হয়, যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারও কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
নগদ সরবরাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অনুরোধ করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলে ব্যাংকাররা অভিযোগ করেছেন।
তালেবান ক্ষমতা দখলের পর কোনো গভর্নর নিয়োগ না দেওয়ার কথাও স্মারকলিপিতে বলা হয়; যদিও তার এক দিন বাদেই একজন ভারপ্রাপ্ত গভর্নর নিয়োগ দেয় নতুন শাসক গোষ্ঠী, যার নাম হাজি মোহাম্মদ ইদ্রিস।
তার সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানা গেছে। সিএনএন বলছে, ফলে আফগান ব্যাংক ব্যবস্থায় আস্থা ফেরানোর মতো দক্ষতা তার রয়েছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে চলমান পরিস্থিতি এক মানবিক দুর্যোগ নিয়ে আসতে যাচ্ছে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তালেবানের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আজমল আজমাদি দেশের চরম দুর্যোগের আশঙ্কা প্রকাশ করে এই সময়ে আফগানিস্তানকে পরিত্যাগ না করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আকুতি জানিয়েছেন।
তার মতে, এখন আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখাই শুধু নয়, এটা বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
বিশ্ব ব্যাংকের হিসেবে, আফগানিস্তানের ৪৭ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এই হার আরও বেড়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন আজমল।
আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তাও একই সুরে বলেন, “আমাদের যা কিছু আশা ছিল, সবই ডুবেছে। সামনে এখন নিরাশার ভবিষ্যৎ।”