বর্তমান বিনিময় হার (১ ডলারে ৮৫ টাকা) অনুযায়ী, বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় চার লাখ ৩৪ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। বিদেশি অর্থায়নের আটকে থাকা এই অর্থ চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট বাজেটের প্রায় ৭২ শতাংশ।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট বাজেটের আকার ছয় লাখ তিন হাজার ৬৮১ কোটি টাকা।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত বৈদেশিক অর্থায়নের পাইপলাইনের আকার ছিল প্রায় চার হাজার ৮৮২ কোটি ডলার বা প্রায় ৪৯ বিলিয়ন ডলার। গেল ২০২০-২১ অর্থবছরে নতুন করে আটকা পড়েছে আরও ২২৪ কোটি ডলার। সবমিলিয়ে গত জুন মাস পর্যন্ত মোট ৫ হাজার ১০৬ কোটি ডলার প্রতিশ্রুতির মধ্যেই রয়ে গেছে বলে ইআরডির সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ১৯৭১-৭২ অর্থবছর থেকে বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতির এই হিসাব করে আসছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ঋণ ও অনুদান হিসেবে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেখান থেকে এই বিপুল অর্থ আটকে রয়েছে।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, সরকার প্রতিবছর বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অর্থায়নের জন্য ঋণ চুক্তি করে। এই চুক্তির পর থেকেই তা প্রতিশ্রুতি হিসেবে গণ্য করা হয়।
বিপুল এই অর্থ ছাড় না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে যেসব প্রকল্পের বিপরীতে বিভিন্ন দেশ ও সহযোগীদের অর্থায়ন করার কথা সেগুলো নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে না পারা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, একদিকে সময়মত প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অর্থ ছাড় করা সম্ভব হচ্ছে না, তেমনি বেশি পরিমাণে চুক্তি স্বাক্ষর করার ফলে প্রতিবছর নতুন করে পাইপলাইনে যুক্ত হচ্ছে প্রায় তিন থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার। ফলে প্রতিশ্রুতির আকার প্রতিবছর ফুলে-ফেঁপে উঠছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, গেল ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার প্রায় ৯৩৫ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছে। কিন্তু একই সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ছাড় করতে পেরেছে ৭১০ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরেও প্রায় ২২৫ কোটি ডলার পাইপলাইনে যুক্ত হয়েছে।
একইভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৫৫ কোটি ৪৪ লাখ ডলার অর্থায়নের চুক্তির বিপরীতে ছাড় হয় ৭২৭ কোটি ১৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ ওই অর্থবছরেও ২২৮ কোটি ২৫ লাখ ডলার পাইপলাইনে যুক্ত হয়েছে।
ইআরডির সাবেক সচিব মনোয়ার আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মূলত বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করায় প্রতিশ্রুতি বাড়তে থাকে। কিন্তু প্রথম দিকে প্রতিশ্রুতির সাথে তাল মিলিয়ে অর্থছাড় করতে না পারায় পাইপলাইন বড় হওয়া শুরু করে।
“এরপর বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থ ছাড় বাড়াতে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের তালিকা করে ইআরডি সেগুলো মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় এখন বাস্তবায়নকারী সংস্থা, ইআরডি ও দাতা সংস্থা মিলে প্রতি তিন মাস পরপর ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করা হয়।“
এসব পদক্ষেপে প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে বিদেশি অর্থ ছাড় বেড়ে যায়। এখন পরপর দুই বছর সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি ছাড় হয়েছে।
“এখন কোভিডের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কোভিড পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন ও অর্থছাড় বাড়বে।“
তখন পাইপলাইন থেকে অর্থ ছাড় বেড়ে যাবে বলে আশাবাদী সাবেক এই সচিব।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা আবাসিক কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “পাইপলাইন ছোট করতে চাইলে অবশ্যই বৈদেশিক অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন বাড়াতে হবে।“
অর্থনীতিবিদ ও ব্রাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, “পাইপলাইনের বিপুল অর্থছাড় দ্রুত বাড়াতে না পারলে এই খাতে একটা বিশৃংখলা তৈরি হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এর পরিমাণ ও বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করতে হবে।”
চলতি অর্থবছরে সরকার দুই লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার যে এডিপি গ্রহণ করেছে, যেখানে বৈদেশিক অর্থায়ন আগের কয়েক বছরের চেয়ে কিছুটা বাড়িয়ে মোট বরাদ্দের ৩৯ শতাংশ রাখা হয়েছে।
গত ২০২০-২১ অর্থবছরে এডিপিতে বৈদেশিক অর্থায়নের অংশ ধরা হয় ৩০ শতাংশ। এর আগের বছরও যা প্রায় ৩১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল মোট বরাদ্দের ২৯ শতাংশ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের বাজেট শাখার যুগ্মসচিব সিরাজুন নুর চৌধুরী বলেন, “বাজেট একটি পরিকল্পিত কাঠামোর মাধ্যমে গ্রহণ করা হয়। বিশেষ করে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে অনুসরণ করে সাজানো হয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী এডিপি গ্রহণ করা হয়।“
বিদ্যমান কাঠামোতে যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তা ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা গেলে পাইপলাইনের আকার কমে আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।