জিডিপিতে মহামারীর ক্ষত: নতুন চিত্র এল বিবিএসের বিলম্বিত হিসাবে

মহামারীর শুরুর ধাক্কায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশে, যা তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 August 2021, 06:55 PM
Updated : 5 August 2021, 06:55 PM

এক বছরের বেশি সময় ঝুলিয়ে রেখে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বৃহস্পতিবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেছে।

সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছিল, ওই অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, যদিও পরিসংখ্যান ব্যুরো এতদিন জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করেনি।  

বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, এরচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে, সে বছর ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেড়েছিল মোট দেশজ উৎপাদন। পরের ত্রিশ বছরে আর কখনও প্রবৃদ্ধি এতটা নামেনি। 

২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির চূড়ান্ত হিসাবের সঙ্গে গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাময়িক হিসাবও বৃহস্পতিবার প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যা ব্যুরো। সেখানে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এবারের জিডিপির প্রাক্কলন তার কাছে ‘অন্যান্য বছরের তুলনায় বাস্তবভিত্তিক’ মনে হয়েছে।

“মহামারীর ওপর কারও হাত নেই। মানুষের কাজ, অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে এটা আঘাত এনেছে। এই মহামারীর কারণে ভারতে প্রায় ১০ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশে ৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি শুনে ভালো লাগছে।”

মহামারীর ধাক্কা সামলে দেশের অর্থনীতি এখনও যেহেতু পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তাই প্রবৃদ্ধির দিকে মনোযোগ না দিয়ে চলতি অর্থবছরে ‘সঠিক নীতি সহায়তা’ দিয়ে অর্থনীতিকে সঠিক পথে রাখার ওপর জোর দেন তিনি।

এক ধাক্কায় খাদে

২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পর ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য যখন ধরেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

কিন্তু ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীন থেকে ছড়াতে শুরু করে নতুন এক করোনাভাইরাস, অল্প সময়ের মধ্যে তা বিশ্বজুড়ে মহামারীর রূপ পায়।

ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে দেশে দেশে লকডাউন শুরু হয়, বন্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট, ফলে বিশ্ব বাণিজ্য এক কথায় অচল হওয়ার দশা হয়।

বাংলাদেশে মহামারীর ধাক্কা শুরু হয় ২০২০ সালের মার্চে। শনাক্ত রোগী বাড়তে শুরু করে বাংলাদেশও অন্যান্য দেশের পথ অনুসরণ করে, ২৬ মার্চ থেকে সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে নাগরিকদের ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।

সরকারি ভাষায় ওই ‘সাধারণ ছুটি’ চলে টানা দুই মাস, এই সময় অর্থনীতির চাকা একপ্রকার অচল হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশের শিল্পোৎপাদনও প্রায় বন্ধই থাকে।

মহামারীর প্রথম ধাক্কায় অর্থনীতির ওই পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের সাময়িক হিসাব দিলে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন অর্থনীতিবিদদের অনেকে।

এখন পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব বলছে, ওই অর্থবছর সরকারের ধারণার চেয়েও ১.৭৩ শতাংশ পয়েন্ট কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মহামারীর ওই সঙ্কটে অর্থনীতির চাকা যেটুকু সচল ছিল, তার মূল কৃতিত্ব কৃষিখাতের।

২০১৯-২০ অর্থবছরে (স্থির মূল্যে) কৃষিখাতে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশ, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ছিল।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে খাদ্য শষ্য, প্রাণিজ ও বনজ সম্পদ আহরণে প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে। তবে মৎস্য উপখাতে প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২১ শতাংশ থেকে কমে ৬ দশমিক ০২ শতাংশ হয়েছে।

অনুমিতভাবেই শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধিতে বড় ধস দেখা যাচ্ছে পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত হিসাবে।

২০১৯-২০ অর্থবছরে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ১২ দশমিক ৬৭ শতাংশ ছিল।

এর মধ্যে ভারী, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ থেকে কমে ১ দশমিক ৮০ শতাংশ হয়েছে। 

শিল্পখাতের মত সেবাখাতের প্রবৃদ্ধিতেও মহামারীর ধাক্কা লেগেছে প্রবলভাবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে প্রবৃদ্ধি কমে ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ হয়েছে, যা আগের অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৮    শতাংশ ছিল।

২০২০-২১ অর্থবছরের প্রাক্কলন

২০২০-২১ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাময়িক যে হিসাব পরিসংখ্যা ব্যুরো প্রকাশ করেছে, সেখানে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

গত অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরলেও মহামারী পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করায় তা সংশোধন করে ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধির প্রাক্বলন করা হয়েছিল। পরিসংখ্যার ব্যুরোর প্রাক্কলনে তা আরও কমল।

এই প্রাক্কলন বলছে, গত অর্থবছরে কৃষিখাতে প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ হবে। তবে শিল্পখাতে তা আগের বছরের ৩ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ১২ শতাংশ হবে।

আর সেবাখাতের প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ১৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ হবে বলে পরিসংখ্যান ব্যুরো হিসাব দিয়েছে।

এই প্রাক্কলন অনুযায়ী দেশের মোট জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে (বর্তমান মূল্যে) ৩০ লাখ ১১ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল ২৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা। 

আর মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২৪ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ২২৭ ডলারে পৌঁছেছে।

বিবিএস এর হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছর জাতীয় বিনিয়োগ (বর্তমান মূল্যে) জিডিপির ২৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১৯-২০  অর্থবছরে ছিল ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ।

এ সময়ে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২ দশমিক ০৬ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ২১ দশমিক ২৫ শতাংশে। তবে সরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২১-২১ অর্বছরে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশে।