লকডাউনে কারখানা খোলা: ‘চাকরি বাঁচাতে’ দুর্ভোগ মেনে শত মাইল পাড়ি

ভোরে শেরপুরের নালিতাবাড়ি থেকে বের হয়ে ময়মনসিংহ আসতে পারভীন বেগমের দুপুর ১২টা বেজে যায়। ভেঙে ভেঙে অটোরিকশায় আসতে তার খরচ হয় ৭০০ টাকা।

ফয়সাল আতিককামাল তালুকদার ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2021, 02:45 PM
Updated : 31 July 2021, 07:29 PM

ময়মনসিংহের বাইপাসে এসে কেনো গাড়ি না পেয়ে অটোরিকশায় ওঠেন তিনি। গন্তব্য ভালুকা।

পারভীন বলেন, “এটায় ভালুকা যাব। ভাড়া দিতে হবে ২০০ টাকা। পরে সেখান থেকে অন্য কোনো উপায়ে গাজীপুর যাব।”

বাস না চলায় পথের দুর্ভোগের পাশাপাশি বাড়তি খরচটাও পোড়াচ্ছে তাকে। ভালুকার পরে কীসে যাবেন, সেটা অনিশ্চিত, কত খরচ হবে, সেটাও জানেন না; তবু যেতে হবে। কারণ মহামারীর এই দুঃসময়ে চাকরি নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি মাঝবয়সী পারভীন।

তার মতো হাজার হাজার কর্মী ও শ্রমিক কাজে যোগ দিতে শনিবার সকাল থেকেই দীর্ঘ অনিশ্চিত যাত্রা জেনেও পথে নেমেছেন। করোনাভাইরাসের ঝুঁকির চেয়েও চাকরি ঠিক রাখাই তাদের কাছে বড় বিষয় বলে জানাচ্ছেন তারা।

শনিবার সাত সকালে বাড়ি থেকে হেঁটে যে পথচলা শুরু হয়েছে সন্ধ্যা বেলাতেও অনেকের তা শেষ হয়নি। রাজধানীর মোড়ে মোড়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর বাহনের অপেক্ষায় ছিল অসংখ্য মানুষ।  

ভেঙে ভেঙে শত শত মাইল পাড়ি দেওয়ার পথে কখনও হেঁটে, কিছুপথ রিকশা-অটোরিকশায়, সুযোগ পেলে পিকআপ ভ্যানের পেছনে দাঁড়িয়ে গাদাগাদি করেই কর্মক্ষেত্রে ফিরতে দেখা গেছে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার এসব কর্মীকে।

রোববার খুলছে কারখানা; তাই শনিবার কঠোর লকডাউনে গণপরিবহন নেই জেনেও গ্রাম থেকে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলমুখী জনস্রোতের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই পথের ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তার গল্পটা প্রায় একই রকম।

নাটোর থেকে খুব ভোরে সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি কখনও পায়ে হেঁটে কখনও মোটরচালিত রিকশায় আবার কিছুপথ সিএনজি অটোরিকশায় চড়ে বিকাল ৩টায় গাবতলী পৌঁছেন।

রাজধানীর পোস্তগোলায় ইউনাইটেড অ্যাপারেলস নামের একটি কারখানায় মাত্র কয়েকমাস আগেই চাকরি নিয়েছেন রাকিব (ছদ্মনাম)। পাশে শোভন গ্রুপের আরেকটি কারখানায় চাকরি করেন তার স্ত্রী।

রাকিব বলেন, “ফ্যাক্টরি থেকে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ১ অগাস্ট থেকে কারখানা খোলা, আপনারা চলে আসতে পারেন। নতুন চাকরি, নতুন সংসার। তাই বিলম্ব না করে চলে আসলাম।”

কারখানা খুললেও লকডাউন শেষ হওয়ার আগে না এলেও কারও চাকরি যাবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।

তবে রাকিব বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম ৫ অগাস্টের আগে কারখানা খুলবে না। কিন্তু হঠাৎ করে খুলে দিল, আবার গাড়িও ছাড়ল না। সে কারণেই ভোগান্তিটা হল। আমি না থাকলে আমার জায়গা আরেকজন দখল নেবে। তখন চাকরিটা থাকবে কী করে?”

রাকিবের স্ত্রী বলেন, “সরকার অনেক ঘোষণাই দেয়। কিন্তু গার্মেন্টেসের ভেতরে যে কী হয়, সেটা কেবল আমরাই জানি।“

নাটোর থেকে তিন হাজার টাকা খরচ করে গাবতলী এসেছেন তারা। এখন ৫০০ টাকায় একটি রিকশা ভাড়া করে কদমতলী পোস্তগোলার পথ ধরেছেন। দুর্ভোগের পরও রিকশায় বসেই নবদম্পতি একটা সেলফি তুললেন হাসিমুখে।

শনিবার গাবতলী সেতু, বাবু বাজার সেতুসহ ঢাকার অন্যান্য প্রবেশ পথগুলোতে এমন হাজার হাজার নারী-পুরুষের দেখা মিলেছে। পথের ক্লান্তি ছিল তাদের চোখে মুখে।

হুট করে কারখানা খোলার ঘোষণায় এত কষ্‌টের মধ্যে পড়েছেন তারা। এরসঙ্গে ৪/৫ গুণ বেশি ভাড়া গুণতে হওয়ায় অনেকেই তীব্র ক্ষোভ আর বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।

দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানার মধ্যে তৈরি পোশাকই বেশি। এই খাতের কারখানাগুলো মূলত ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরকেন্দ্রিক বলে শনিবার দেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকে আসা কর্মীদের সবার গন্তব্যও ছিল এসব এলাকামুখী।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হওয়ায় ঈদের পর শুরু কঠোর লকডাউনে সব শিল্প কারখানাও ৫ অগাস্ট পর্যন্ত বন্ধ থাকবে বলে সরকার জানিয়েছিল।

কিন্তু ব্যবসায়ীদের বারবার অনুরোধে শুক্রবার সরকার জানায়, রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানা- যার মধ্যে পোশাক কারখানাই বেশি রোববার থেকে খোলা রাখা যাবে।

এই সিদ্ধান্ত জানার পর সড়কে বাস নেই জেনেও শনিবার সকাল থেকে বিভিন্ন জেলা থেকে পোশাককর্মীরা কর্মস্থলের পথে রওনা দেন।

গাবতলীতে দেখা যায়, গণপরিবহন না থাকায় মহাসড়কে বিভিন্ন ছোট বাহন বা ট্রাক-পিকআপ, মাইক্রোবাসে চেপে ভেঙে ভেঙে কুষ্টিয়া, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জসহ ঢাকার কাছের জেলাগুলো থেকে শহরের ভেতর দিয়ে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, টঙ্গী এলাকায় কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছিলেন তারা।

শনিবার দিনভর দেখা গেছে, অধিকাংশ শ্রমিকই নবীনগর-আমিনবাজার এলাকা থেকে কাপড়-চোপড়ের বড় বস্তা, কোলের শিশু, স্ত্রী-পরিজন নিয়ে হেঁটেই নগরীতে ঢুকছেন।

দিনভর এই দুর্ভোগের পর রাতে সরকার এক ঘোষণায় রোববার লঞ্চ ও বাস চলাচলের অনুমতি দেয়। তবে ততক্ষণে অধিকাংশ শ্রমিকের দুর্ভোগ পোহানো হয়ে গেছে। 

লকডাউনের মধ্যে গণপরিবহন বন্ধ। এর মধ্যে শিল্প কারখানা খুলে দেওয়ার সরকারি ঘোষণার পর শনিবার দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনির আখড়া এলাকায় দেখা যায় রিকশা ভ্যান ও পিকআপভ্যানে গাদাগাদি করে ঢাকায় আসছে মানুষ। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

ভাড়ায় নেই লাগাম

গাবতলী থেকে রিকশায় পুরান ঢাকার কদমতলীতে ৫০০ টাকা, সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোডের ভাড়া এক হাজার টাকা চাইছিলেন চালকরা।

মোটরসাইকেলের ভাড়াও প্রায় একই। দুএকশ টাকা দরকষাকষি করেই এই ভাড়াতেই চড়তে হয়েছে রিকশায়। অথচ গণপরিবহন চালু থাকলে এই খরচ থাকত একশ টাকার মধ্যে।

গাজীপুরে ওয়ানগ্রুপের একটি কারখানার শ্রমিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “সকালে কুষ্টিয়া থেকে ৬০ টাকার ভাড়া ৫০০ টাকা দিয়ে পিকআপে করে পাটুরিয়া ঘাটে আসলাম। ঘাট থেকে ৪৫ টাকার ভাড়া ৬০০ টাকা দিয়ে সিএনজি অটোরিকশায় হেমায়েতপুরে, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে চলে আসলাম গাবতলীতে। “

কিন্তু সিদ্দিকুরকে যেতে হবে গাজীপুরে। তাড়া না থাকার পরও কেন এত বড় ঝুঁকি নিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অফিস থেকে অতটা তাড়া দেয়নি। কিন্তু সহকর্মীদের অনেকেই চলে আসছেন। তাহলে আমি বসে থাকি কিভাবে। অফিস থেকে তো একেবারে কিছু না বলে ছেড়ে দেবে না।

“মালিক পক্ষের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বেতন কাটা যাবে না কিন্তু চাকরি তো হালকা হয়ে যাবে। চাকরির তাগিদে আমাদের অবশ্যই আসতে হবে। গণপরিবহনগুলো খুলে দিলে আমাদের এত ভোগান্তি হত না।”

নারায়ণগঞ্জের আদমজি ইপিজেডে অবস্থিত ইউনিভার্সেল ফ্যাশন্সের ইলেক্ট্রিশিয়ান রুবেল জানান, কারখানা খোলার আগেই মেশিন চালুর প্রস্তুতি তাকেই নিতে হবে।

তাই দুজনে দুই হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে পাবনা থেকে অটোরিকশা করে গাবতলীতে এসেছেন রুবেল। পথে পুলিশ কিংবা অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ঝামেলা করেনি তাদের।

টাঙ্গাইল ভুয়াপুর থেকে স্ত্রী ও পরিবারের চার সদস্য নিয়ে সকাল ৯টায় যাত্রা করে বিকাল ৩টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে গেলেন মাসুদ রানা। সাভার চন্দ্রা পর্যন্ত জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে মাইক্রোবাসের ভাড়া দিয়েছেন। বাকিপথ এসেছেন অটো রিকশায়।

আদমজি ইপিজেডের এই শ্রমিক নিজের ফ্যাক্টরির নাম বলতে রাজি হননি।

তিনি বলেন, “কারখানা থেকে বলে দিয়েছে ১ তারিখ থেকে খোলা। কোনো হুমকি ধমকি দেয়নি। তবে বিলম্বের কারণে চাকরি যে যাবে না তার কোনো গ্যারান্টি নেই। যে কোনো কারণে যে কারও চাকরি চলে যেতে পারে।“

ঢাকার সব প্রবেশ পথের চিত্র একই

গাবতলীর মত সকাল থেকে রাজধানীর বাবু বাজার ব্রিজ হয়ে অসংখ্য কর্মজীবী মানুষকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখা যায়। তাদের অনেকের কাঁধেই ছিল বড় ব্যাগ ও বোঝা। 

রাজীব নামে এক যুবক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মিরপুরের একটি কারখানায় কাজ করেন। মাদারীপুরের কালকিনি থেকে বিভিন্ন পথ দিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ঢাকায় এসেছেন।

কোতয়ালী থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, অন্য দিনের তুলনায় আজ বাবুবাজার সেতুর উপর দিয়ে অন্যদিনের তুলনায় বেশি মানুষ ঢাকায় আসছে।

লকডাউনের মধ্যে কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণায় শনিবার দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় বাহনের অপেক্ষায় মানুষ। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ থানার ওসি একেএম আবুল কালাম আজাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শনিবার অনেক মানুষ ঢাকায় আসছেন। পোশাক কারখানার পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকে ঢাকার দিকে আসতে দেওয়া হচ্ছে না।

কঠোর লকডাউনের মধ্যে ঢাকার অভ্যন্তরে পুলিশের তল্লাশিচৌকিগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তাদের প্রতি ছিলেন সদয়।

মোড়ে মোড়ে মানুষের ঢল

দুপুরের পর থেকে গুলিস্তানের মোড়, বাবুবাজার ব্রিজ, হাটখোলার মোড় দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে থেকে মানুষজন রাজধানীতে ঢুকতে শুরু করেছেন।

কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ রিকশায়, কেউ ঠেলা গাড়িতে আর কেউ ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে শহরে নিজের গন্তব্যে যাচ্ছেনা তারা।

বরিশাল থেকে আসার কলিমুদ্দিন আহমেদের পরিবারের অভিযোগ কেন লকডাউন শেষ না হতেই কারখানা খুলে দিল সরকার?

কলিমউদ্দিনের স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, “কত কষ্ট কইরা শিমুলিয়া আসছি, তারপরে মাইক্রোবাসে গুলিস্তান। এরপর একটা ঠেলা গাড়িতে বৃষ্টি ভিজা যাইতাছি। এঠা ক্যান?  লকডাউন না হইলে উঠাইয়া দেন?’’

গুলিস্তান থেকে রামপুরায় রিকশা ভাড়া ২০০/২৫০ টাকা, ঠেলা গাড়িতে বুকিং ৫০০ টাকা। এত বাড়তি ভাড়া যারা গুনতে পারছেন না তারা হেঁটেই চলছেন।

রিকশাচালক মালেক বলেন, গুলিস্তান থেকে রামপুরা এমনিতে দেড়শ টাকা ভাড়া আছে। এখন বৃষ্টিবাদলের দিন, লকডাউন বলে ৩০/৪০ টাকা বেশি।

চরম ভোগান্তির কথা জানালেন মরিয়ম বেগম নামের একজনও। কাজ করেন আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায়। রোববার থেকে কারখানা খোলার কথা শুনে পটুয়াখালী থেকে ঢাকায় ফিরতে তার সময়ে লেগেছে ১০ ঘন্টা।

তিনি বলেন, “বেশি ভাড়া দিইয়া ঢাকায় আইছি। তিনশ টাকার ভাড়া ৯শ টাকা। রাস্তায় রাস্তায় একটা পারাপারি অবস্থা। মোগো ভোগান্তির শেষ নাই।” 

“সরকার লকডাউন দিছে আবার কয় কাজে আইতে হইব। এটা কেমন কথা। মানুষরা কী জিন-পরী যে, উইড়া আইবো?”

লকডাউনে ঘোড়ার গাড়ি ঢাকার রাস্তায় সচারাচর দেখা যায়নি। গণপরিবহন বন্ধ হওয়ায় ঢাকামুখী মানুষজনকে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে রিকশা, ঠেলা গাড়ির পাশাপাশি ঘোড়ার গাড়িও দেখা গেলো।

কাকরাইলের মোড়ে এরকম তিনটা ঘোড়া গাড়ি যাত্রী বোঝাই করে যাচ্ছে রামপুরার চৌধুরী পাড়ায়।

ঘোড়া গাড়ির চালক রহিম বাদশা বলেন, “গুলিস্তানে বহু মানুষ জন যানবাহনের অপেক্ষা করছে। রিকশা আছে ভাড়ায় মেলে না। আমার গাড়িতে ১৫ জন যাত্রী উঠেছেন। ৭০ টাকা করে রামপুরার আবুল হোটেলে মোড় যাত্রী নিয়ে যাচ্ছি।”

ক্লান্ত শেফালীরা

অধিকাংশ শ্রমিক ছয় সাতজনের দল বেঁধে ঢাকায় ঢুকছেন। প্রায় প্রতিজনের সঙ্গেই রয়েছে ব্যাগ আর নারী শ্রমিকদের অনেকের সঙ্গে শিশু।

দীর্ঘ বিড়ম্বনা পেরিয়ে বিকালে ঢাকায় ঢোকার আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তারা। বাবুবাজার সেতুর ঢালে ক্লান্ত অনেকেই জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। শিশু সন্তানকে খাওয়াচ্ছিলেন পানি।

কথা বলতে গেলে শারীরিক ভাষায় বলে দেয় তারা ভীষণ ক্লান্ত। কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে বলেন, “মালিকদের বলতে পারেন না, কেন আধা পথে কারখানা খোললো”।

এদেরই একজন শেফালী, তাকে যেতে হবে টঙ্গীতে। কোনো গাড়ি নেই, হেঁটেও সম্ভব নয়। কি করবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।

তার সঙ্গে থাকা আরও কয়েকজনকে মহাখালী পর্যন্ত একটি ভ্যান রিকশায় উঠতে দেখা যায়। উপায় না দেখে ক্লান্ত শরীরে তিনিও হুড়মুড় করে উঠে পড়েন সেটিতে।

‘এভাবে করোনা ছড়ায় না’

শনিবার বিকালে গুলিস্তান মাজারের কাছে একটি ছোট খালি ট্রাক পেয়ে ঠেলাঠেলি করে লাফিয়ে উঠলেন অন্তত ২০ জন। জায়গান নেই তবুও আরও অনেক ওঠার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছিলেন তখনও।

এসময় পাশে দাঁড়িয়ে একজন এই দৃশ্য দেখে বলেন, “এভাবে কী করোনা ছড়ায় না?”

শনিবার সকাল থেকেই বাবুবাজার সেতুর উপর দিয়ে ঢাকায় ঢুকছিলেন অনেকে। আর বিকালে নামে ঢল।

আগের কয়েকদিন পুলিশ কঠোর থাকলেও পোশাক শ্রমিকদের এই ঢলে সবই থমকে যায়। গত কয়েকদিন তল্লাশি পেরিয়ে যাওয়া আসা করতেন মাত্র হাতেগোনা লোকজন।

এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “শারীরিক ভাষাই বলে দিচ্ছে তারা পোশাক কারখানার শ্রমিক এবং অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন; ক্লান্ত।

বিজিএমইএ কী বলছে

কারখানা খুলে দিলেও লকডাউন প্রত্যাহারের আগে দূরের শ্রমিকদের ফিরে আসার বাধ্যবাধকতা নেই বলে শুক্রবারই বিজিএমইএর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।

কিন্তু এই সংগঠনের অনেক সদস্য কারখানাই কর্মীদের ফিরে আসার জন্য বার্তা পাঠিয়েছেন বলে শ্রমিকরা জানিয়েছেন।

আবার কোনো ধরনের জোরাজুরি ছাড়াই অনেক শ্রমিক নিজের তাড়া থেকেই ছুটে এসেছেন কর্মক্ষেত্রে।

শনিবার এভাবে শ্রমিকদের ফিরে আসা সম্পর্কে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় আবারও লকডাউন পুরোপুরি প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত গ্রামে অবস্থানরত শ্রমিক-কর্মচারী কাজে যোগ দিতে না পারলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে জানান।

গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, “এ সময়ে কারখানার আশে-পাশে অবস্থানরত শ্রমিকদের নিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সকল সদস্যগণকে আহ্বান করছি।“

করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে শনিবার গাদাগাদি করে যাত্রী নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ। ছবিটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনির আখড়া এলাকার। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

শ্রমিকদের এই আসার দায় দৃশ্যত নিতে রাজি নন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম আপাতত কারখানার আশপাশের শ্রমিকদেরকে নিয়ে শুধু জরুরি রপ্তানিগুলো চালিয়ে নিতে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, যারা ঢাকার বাইরে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন তারাও কষ্ট করে এসে কাজে যোগ দিতে চাচ্ছেন।

“আসলে শ্রমিকরাও কাজ বাদ দিয়ে ঘরে বসে থাকতে চাচ্ছে না। কারণ কারখানায় কাজে যুক্ত থাকলে তারা নিয়মিত বেতনের পাশাপাশি ওভারটাইম বাবদও কিছু টাকা-পয়সা আয় করতে পারেন।”

তবে কারখানা খুলে দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার পর শ্রমিকদের আসার জন্য বাস ও লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করায় সরকারকে ধন্যবাদ জানান বিজিএমইএ সভাপতি।

এদিকে লকডাউনের মধ্যে কারখানা খুলে দেওয়ায় শ্রমিকদের ‘দ্বিমুখী সংকটে’ ঠেলে দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করেছে গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আহসান হাবিব বুলবুল ও  সাধারণ সম্পাদক সেলিম মাহমুদ এক বিবৃতিতে বলেন, সরকার বার বার বলছিল লকডাউনে শিল্প কারখানা বন্ধ   থাকবে। এখন শিল্প মালিকদের চাপে তা খুলে দিল।

“ফলে চাকরি হারানোর ভয়ে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যেয়ে আটকে থাকা লাখ-লাখ শ্রমিককে গণপরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় দুর্ভোগ আর ঝুঁকিকে সঙ্গী করে একদিনের মধ্যে কর্মস্থলে ফিরতে হবে। পরিবহন ও আনুসাঙ্গিক আয়োজন ছাড়া সরকারের এই ঘোষণা একদিকে শ্রমিকদের যাত্রাপথের ঝুঁকি এবং অতিরিক্ত পরিবহন ব্যায়ের ক্ষতি, অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ আর চাকরি হারানোর ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়েছে।”