ফের মেট্রোরেলের পথ আটকাচ্ছে মহামারী

করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে আবারও পিছিয়ে পড়েছে ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প।

জাফর আহমেদ জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 July 2021, 05:09 PM
Updated : 24 July 2021, 05:09 PM

২০ কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের এমআরটি-৬ প্রকল্পের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটারের কাজ আগামী ডিসেম্বর মাসে শেষ করার ঘোষণা থাকলেও তা সম্ভব হচ্ছে না।

শুধু তাই নয়, মহামারী পরিস্থিতি যেখানে পৌঁছেছে, তাতে এখনই নতুন কোনো ‘টার্গেট’ নির্ধারণ করতেও রাজি নয় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেছেন, প্রকল্পের এ অংশের কাজ শেষ করার পর দারা নতুন ‘টার্গেট’ ঘোষণা করবেন।

কেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না জানতে চাইলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “টার্গেট নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি ঠিকই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বিদেশি জনবল। জাপানি কনসালট্যান্ট যারা আছেন, মহামারীর কারণে তারা স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়মকানুন মেনে চলেন।

ঢাকার উত্তরায় মেট্রোরেলের একটি নির্মাণাধীন স্টেশন। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত এরকম ১৬টি স্টেশন হবে। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

“অনেক পণ্য আছে যেগুলো বিদেশ থেকে আনতে হয়। এসব ইক্যুইপমেন্ট সরেজমিনে দেখতে হয়। কিন্তু এই সময়ে বিদেশি কনসালট্যান্টরা সরেজমিনে থাকতে না পারায় দেরি হচ্ছে। আবার ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ ও বিদেশি জনবল দেশে আসতে সংশ্লিষ্ট দেশের এমবার্গোর কারণেও সমস্যা হচ্ছে।”

এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার যে লক্ষ্য তাদের ছিল, তার চেয়ে সময় ‘কিছুটা বেশি’ লাগতে পারে।

নতুন ‘টার্গেট’ কী হতে পারে জানতে চাইলে সাবেক এই সচিব বলেন, “এই পরিস্থিতিতে নতুন টার্গেট নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ পরিস্থিতি আমাদের ওপর নির্ভর করছে না। নির্ভর করছে মহামারীর ওপর। কোভিড পরিস্থিতি যদি আরও খারাপ হয়? আমরা আগে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখব। তারপর আমরা নতুন টার্গেট সেট করব।”

মহামারী কালে রোকেয়া সরণির বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে মেট্রোরেল প্রকল্প-৬ এর কাজের অগ্রগতির চিত্র। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে আস্তে আস্তে কোভিড পরিস্থিতি আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে এটা বিদেশিদের কাছে একটা উদ্বেগের বিষয়। বিদেশি কনসালট্যান্ট, বিদেশি ইঞ্জিনিয়ার এবং বিদেশি এক্সপার্ট যারা, তারা এটা নিয়ে টেনশনে থাকেন।”

এ পরিস্থিতিতে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত দেখে কাজের অগ্রগতি বিবেচনা করে নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করাই ‘যৌক্তিক’ হবে বলে মনে করছেন সরকারের এই কর্মকর্তা।

প্রকল্পটির উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটারের মধ্যে যে নয়টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে, তার সবগুলোরই দুই তলার কনকোর্স ছাদ পর্যন্ত নির্মাণ কাজ হয়েছে।

এর মধ্যে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ ও পল্লবী- এই চার স্টেশনে তৃতীয় তলার স্টিলের ছাদের ফ্রেমও স্থাপন করা হয়েছে। 

এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ঢাকার উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুর কথা থাকলেও তা নিয়ে সংশয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ। এ কাজে এখন পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

পল্লবী স্টেশনে মেট্রোরেলের উড়াল রেল সেতুর সঙ্গে মিলিয়ে সুপরিসর তিন তলা ভবন তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎতের লাইনও টানা হয়েছে সেখানে। বসানো হয়েছে ল্যাম্পপোস্ট। তবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া  হয়নি।

জানতে চাইলে সাইট ইঞ্জিনিয়ার মাশরুর মাহমুদ ইনান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিটি স্টেশনেই তিনটি ফ্লোর থাকবে। দ্বিতীয় তলায় থাকবে নারী ও পুরুষ যাত্রীদের জন্য আলাদা টিকেট কাউন্টার, আলাদা নামাজের ঘর এবং টয়লেট।

দ্বিতীয় তলার কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ করে চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার জন্য তৃতীয় তলায় চলে যাবেন। সেখানে তৈরি করা হচ্ছে যাত্রীদের ওয়েটিং রুম, বসার জন্য থাকছে পর্যাপ্ত চেয়ারের ব্যবস্থা। ট্রেন এলে সেখান থেকে তারা উঠবেন।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রতিটি কোচের দুপাশে অছে সুপরিসর চারটি দরজা। তবে স্টেশনে এলে একপাশেই খুলবে। ট্রেন থাকবে প্ল্যাটফর্মের সমতলে, ফলে সাধারণ ট্রেনের মত সিঁড়ির প্রয়োজন হবে না।

ইনান জানান, অবকাঠামোর কাজের মধ্যে এখন বাকি আছে তৃতীয় তলার স্টিল ফ্রেমের ওপর রুফশিট বসানো। মেঝেতে টাইলস বসানোর কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

পল্লবী স্টেশনের কাজ প্রায় ৮৫ শতাংশ শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে বলে তারা আশা করছেন।

উত্তরা থেকে পল্লবী পর্যন্ত পাঁচ স্টেশনেরই গড় বাস্তবায়ন প্রায় একই রকম বলে জানান সাইট ইঞ্জিনিয়ার।

ঢাকা ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটারের পুরো কাজের মধ্যে গড় বাস্তবায়ন হয়েছে ৬৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত  ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের প্রথম অংশের অগ্রগতি ৮৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দ্বিতীয় অংশের পূর্ত কাজের অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

প্রকল্পটির ইলেক্ট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রেলকোচ ও ডিপো ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহের কাজের অগ্রগতি ৫৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

আকাশ থেকে দেখা ঢাকার মেট্রো রেলের লাইন। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজে এখন পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান

এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী প্রকল্পের মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত অতিরিক্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত অংশের ভূমি অধিগ্রহণ, গৃহজরিপ, সামাজিক সংলাপ ও নকশা প্রণয়নের কাজ চলছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছ, পুরো প্রকল্পের ভায়াডাক্টগুলোর মধ্যে ১৩ দশমিক ২৭৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান হয়েছে।

উত্তরা ডিপোতে রিসিভিং সাব স্টেশনের পূর্ত কাজ শেষ করে বিদ্যুতায়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।

মতিঝিল রিসিভিং সাব স্টেশনের ভবন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ডিপো এলাকার ওয়ার্কশপ শেডের ভেতরে ১২টি রেল লাইনের নির্মাণ কাজও শেষ।

ভায়াডাক্টের ওপর মেইন লাইনের ২ হাজার ৬৭৮টি লে জয়েন্ট ওয়েল্ডিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

আগারগাঁও পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক লাইনের মধ্যে সাড়ে ১৭ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক অ্যালাইনমেন্টের কাজ হয়েছে। তার মধ্যে ১৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন কাজ চলমান।

সাড়ে ১২ কিলোমিটার ওয়্যারিং সম্পন্ন হয়েছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও নয়টি স্টেশন নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে।

উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজে এখন পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে। আগারগাঁওয়ে মেট্রোরেল প্রকল্প-৬ এর কাজের অগ্রগতির চিত্র। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

সব স্টেশনের উপ-কাঠামো নির্মাণ এবং সব ভায়াডাক্টের ওপর রেল ট্র্যাক স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে।

ইতিমধ্যেই মেট্রোরেলের প্রথম ও দ্বিতীয় সেট ঢাকায় পৌঁছেছে। তৃতীয় সেট আগামী ১৩ অগাস্ট ডিপোতে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জাপানের কাওয়াসাকি-মিতসুবিশি কনসোর্টিয়ামকে ২৪ সেট ট্রেন নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০১৭ সালে। দুই পাশে দুটি ইঞ্জিন আর চারটি কোচের সমন্বয়ে ট্রেনের সেটগুলো তৈরি হচ্ছে জাপানে। এরই মধ্যে ৫ সেট ট্রেন তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশের প্রথম এই মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা এর সিংহভাগ অর্থায়ন করছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

গাবতলী ও উত্তরায় কনস্ট্রাশন ইয়ার্ডে ফিল্ড হাসপাতাল চালুর পাশাপাশি কর্মীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে।

প্রকল্পের দেশি-বিদেশি জনবলের মধ্যে ৩০ জুন পর্যন্ত ৭৩৪ জন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, তবে কারও মৃত্যু হয়নি।