পোশাক খাতের অভিজ্ঞতায় অন্যান্য শিল্প ‘নিরাপদ’ করার তাগিদ

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স উদ্যোগ দেশের পোশাক শিল্পে নিরাপদ কর্ম পরিবেশ তৈরিতে যেভাবে ভূমিকা রেখেছে, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের অন্যান্য শিল্প খাতের নিরাপত্তা ও কর্ম পরিবেশ উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এক আলোচনায়।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 July 2021, 03:12 PM
Updated : 11 July 2021, 03:12 PM

রোববার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি এবং জার্মান ভিত্তিক ফ্রেডরিখ এবার্ট ফাউন্ডেশন (এফইএস) আয়োজিত ‘অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স পরবর্তী পোশাক শিল্পে নিরাপত্তা’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংলাপে সরকার এবং শিল্প উদ্যোক্তাদের এই পরামর্শ দেন বক্তারা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও শিল্প উদ্যোক্তা সৈয়দ মঞ্জুর ইলাহীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আলোচনায় অংশ নেন বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হোসেন এবং বিকেএমইএ জ্যেষ্ঠ সহ সভাপতি মো. হাতেম।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুনের স্বাগত বক্তব্যে শুরু হওয়া সংলাপে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আবাসিক প্রতিনিধি জর্জ ফলার এবং সিপিডি চেয়ারম্যান রেহমান সোবহানও বক্তব্য দেন। সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

ফারুক হাসান বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরে অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের হাত ধরে দেশে পোশাক শিল্পের কর্ম পরিবেশ ও নিরাপত্তায় ‘অভূতপূর্ব উন্নয়ন’ ঘটেছে।

“এই উন্নয়ন ধরে রেখে মালিক শ্রমিক ও সরকার- এই তিন পক্ষের সমন্বয়ে দেশের পোশাক খাতসহ সকল শিল্প কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।”

নারায়ণগঞ্জের হাসেম ফুডসে গত সপ্তাহের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “এখন আমাদের উচিত পোশাক খাতকে নিরাপদ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের অন্যান্য শিল্প কারাখানাতেও নিরাপদ কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করা।

“আমি মনে করি, আমাদের, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী শিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে নিরাপদ কর্মপরিবেশ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।”

মো. হাতেম বলেন, “শিল্পে নিরাপত্তার জন্য কী ধরনের কাজ করতে হয় তা আমাদের জানা ছিল না। গত প্রায় দশ বছরে শিল্প নিরাপত্তায় ধারবাহিকভাবে কাজ করে এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের ইমেজ সঙ্কট কিছুটা কেটেছে। শিল্প টিকিয়ে রাখতে সবাই একমত ছিলেন, বলেই এ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।”

তিনি বলেন, “পোশাক খাতের বাইরে অন্য শিল্পের কর্মপরিবেশের মুখোশ উম্মোচন করেছে হাসেম ফুডস। এখন আমাদের সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।”

২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে ক্রেতা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। বিদেশি অনেক সংগঠন বাংলাদেশি পোশাক বর্জনের ডাক দেয়।

সেই প্রেক্ষাপটে কারখানা পরিদর্শনে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে গঠিত হয় অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ, যা সংক্ষেপে অ্যাকর্ড নামে পরিচিতি পায়। আর একই লক্ষ্যে গঠিত আমেরিকার ক্রেতাদের জোট পরিচিতি পায় অ্যালায়েন্স নামে। পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় রিমেডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল (আরসিসি) গঠন করে সরকার।

এরপর বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার কাজ শুরু হয়। কারখানার অবকাঠামো উন্নয়ন, আগুন থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা, শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে বাস্তবায়ন করা হয় বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা। এর বাইরে বিভিন্ন দাতা সংস্থার উদ্যোগে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ শুরু হয়।

এছাড়া মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর উদ্যোগে উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদন, পোশাকপণ্যের ভ্যালু সংযোজন ও পণ্যের বহুমুখীকরণেও বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যাতে বিনিয়োগ করা হয় বিপুল অংকের টাকা।

ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে কারখানার নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশের সুনাম বেড়েছে। হংকংভিত্তিক সাপ্লাই চেইন কমপ্লায়েন্স সল্যুশনস প্রোভাইডার, ‘কিউআইএমএ’  তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ‘ইথিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং’ দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে।

কিন্তু পোশাক খাতের এই পরিবর্তনের হাওয়া যে দেশের অন্যান্য শিল্পে পৌঁছায়নি, তার প্রমাণ মেলে হাসেম ফুডসে অগ্নিকাণ্ডের মত ঘটনায়।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের ওই কারখানায় সেজান জুস, নসিলার মত জনপ্রিয় সব খাদ্যপণ্য তৈরি হত। গত বৃহস্পতিবার সেখানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অর্ধশতাধিক কর্মীর মৃত্যু হয়। তখন জানা যায়, ওই কারখানায় অগ্নি নিরাপত্তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না, কাজে লাগানো হত শিশু শ্রমিক।

রেহমান সোবহান বলেন, “আমাদের পোশাক খাতের উন্নয়ন ঘটাতে পারলেও অন্যান্য শিল্পে একই সমস্যা রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক হাসেম ফুডসের দুর্ঘটনা তা দেখিয়ে দিল।

তিনি বলেন, “আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সক্ষমতা নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যদি ঠিকমতো কাজ করত তাহলে অবশ্যই শিল্প কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা আরও অনেক বৃদ্ধি পেত।

“বিদেশি বিনিয়োগ ও রপ্তানি বাড়াতে চাইলে অবশ্যই সকল ক্ষেত্রে শ্রমিকের জীবন ও কর্মপরিবেশ নিরাপদ করতে হবে।”

অনুষ্ঠানে আইএলও প্রতিনিধি জর্জ ফলার বলেন, “যে কোনো কারখানায় শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে, বিশেষ করে রপ্তানি খাতে, তাহলে বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। তাই সকল পক্ষ মিলে শিল্পের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।”

মূল প্রবন্ধে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাপে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা বিধানে অনেক পোশাক কারখানা সংস্কার কার্যক্রম হাতে এখনো অনেক মাঝারি কারখানায় অগ্নি এবং কাঠামোগত দুবলর্তা রয়েছে।

কারখানাগুলোতে নিরাপত্তার জন্য সার্বজনীন নিয়ম বেঁধে না দেওয়ার কারণেই একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।  

মোয়াজ্জেম বলেন, অ্যালায়ান্সে থেকে ৭১৪টি কারখানা এবং অ্যাকর্ড থেকে ১ হাজার ৬০০টি কারখানার সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে বিদ্যুৎ এবং অগ্নি নিরাপত্তার সমস্যা প্রায় ৯৮ শতাংশ সমাধান করা গেছে। কিন্তু এখনো ৩২ শতাংশ ক্ষেত্রে কাঠামোগত সমস্যা বিদ্যমান, যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে।

অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স পরবর্তী, অর্থাৎ ২০১৮ সালের মে মাস থেকে ২০২১ এর এপ্রিল পর্যন্ত তিন বছরে গণমাধ্যম থেকে ৪৬টি দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক বলেন, বৈদ্যুতিক শটসার্কিটের কারণেই মাঝারি আকারের কারখানায় দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। এছাড়া বয়লার ও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকেও দুর্ঘটনা ঘটেছে।

“অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স থাকার সময় ওইসব কারখানায় নিয়মিত যে পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হত, তারা চলে যাওয়ার পর সেটা আর করা হচ্ছে না।”

দেশের শিল্প নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন মোয়াজ্জেম।