এসডিজি: টাকার যোগান বাড়াতে হবে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা

এসডিজি সূচকে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করা তিন দেশের তালিকায় নাম থাকলেও বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে অধিকাংশ লক্ষ্য পূরণে বিরাট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাফর আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2021, 04:32 PM
Updated : 16 June 2021, 05:49 PM

তারা বলছেন, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের (এসডিজি) ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৮টিতে এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চলমান অর্থায়ন দিয়ে কোনোভাবেই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা ‘সম্ভব হবে না’।

তাই সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা বাড়ানোর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি সম্পদ আহরণ এবং দ্রুত বিনিয়োগ বাড়ানোর পথ খোঁজার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. শামসুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও আমাদের কর জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের কম। এটা অন্তত ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে না পারলে চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগ সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে এসডিজি বাস্তবায়নও সম্ভব হবে না।”

আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, পিছিয়ে থাকা ক্ষেত্রগুলোতে উন্নতি করতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সেজন্য দরকার টাকা। 

“বৈদেশিক সম্পদ আহরণে আরও তৎপর হতে হবে আমাদের। মনে রাখতে হবে, আমরা এখন বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে আছি।”

পরিবর্তনশীল বিশ্বে সমতা ও বৈষম্যহীন উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালে জাতিসংঘে গৃহীত এসডিজিতে ২০৩০ সালের মধ্যে পূরণের জন্য মোট ১৭টি লক্ষ্য স্থির করা হয়। 

জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক ২০২১ সালের যে অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বিশ্বের ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এবার ১০৯তম।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের পর থেকে এসডিজি সূচকে স্কোরের দিক দিয়ে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে বাংলাদেশ, কোত দি ভোয়া (আইভরি কোস্ট) এবং আফগানিস্তান।

এসডিজি সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর এবার একশর মধ্যে ৬৩.৫। যে বছর এসডিজি গৃহীত হয়, সে বছর বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৫৯.০১।

এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ১২ নম্বরে পরিমিত ভোগ ও টেকসই উৎপাদনধরন নিশ্চিত করা আর ১৩ নম্বরে জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরি কর্মব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্য বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পূরণ করে ফেলেছে।

এসডিজির ১ নম্বরে সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান এবং ৪ নম্বরে সকলের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং জীবনব্যাপী শিক্ষালাভের সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ লক্ষ্য পূরণের পথেই রয়েছে।

এর মধ্যে এসডিজি-৪ এ বাংলাদেশকে সূচকের হলুদ তালিকায় রাখা হয়েছে। এর অর্থ হল, এসব ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনে আরও অনেক কাজ করতে হবে।

আর এসডিজি-১ এ দারিদ্র্য হ্রাস, এসডিজি-২ এ ক্ষুধামুক্তি, এসডিজি-৫ এ জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন, এসডিজি-৭ এ সাশ্রয়ী, টেকসই জ্বালানি সহজলভ্য করা, এসডিজি-৮ এ শোভন কর্মসুযোগ সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং এসডিজি-১০ এ অন্তঃ ও আন্তঃদেশীয় অসমতা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে কমলা তালিকায়। অর্থাৎ এই ছয় লক্ষ্য অর্জনের পথে বাংলাদেশের সামনে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

এছাড়া এসডিজি-৩ স্বাস্থ্য ও কল্যাণ, এসডিজি-৬ এ পানি ও স্যানিটেশন, এসডিজি-৯ এ অবকাঠামো ও টেকসই শিল্পায়ন, এসডিজি-১১ তে নিরাপদ ও টেকসই নগর গড়ে তোলা, এসডিজি-১৪ তে সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ ও টেকসই ব্যবহার, এসডিজি-১৫ তে বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, ভূমির অবক্ষয় রোধ, এসডিজি-১৬ তে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ, ন্যায়বিচার, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা এবং এসডিজি-১৭ তে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব উজ্জীবিতকরণে বাংলাদেশকে লাল তালিকায় রাখা হয়েছে।

অর্থাৎ এই আটটি ক্ষেত্রে লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে বাংলাদেশকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।  

ড. শামসুল আলম বলেন, “আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দারিদ্র্য ও অসমতা দূরীকরণ। এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যাগপ্রবণ, বিশেষ করে উপকূলীয় এবং ভাঙনপ্রবণ এলাকার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

“এছাড়া সারা দেশের পিছিয়ে থাকা মানুষকে এগিয়ে নিতে পারলে আমরা এসডিজি বাস্তবায়নে এগিয়ে যাব।”

সেজন্য টাকার যোগান দিতে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশীয় ও বৈদেশিক সম্পদ আহরণের মাধ্যমে ‘যথাসময়ে’ প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করার পরামর্শ রাখার কথা জানান তিনি। 

পরিকল্পনার দলিল প্রণয়ন ও এসডিজির মূল্যায়ন পর্যবেক্ষণে থাকা সরকারের এই কর্মকর্তা বলেন, দেশীয় ব্যবস্থা থেকে সম্পদ আহরণ বাড়ানোর জন্য আগামী অর্থবছর থেকে টিআইএনধারী প্রত্যেক নাগরিকের বাধ্যতামূলক রিটার্ন দাখিল নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেকটি বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে ইলেক্ট্রনিক ফিসকাল ডিভাইস (ইএফডি) বসাতে বলা হয়েছে।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের সকল ধরনের ব্যবসায়ীর ট্রেড লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করার কথাও বলা হয়েছে।

“সেই সুপারিশ অনুযায়ী আগামী অর্থবছর থেকে তাও বাধ্যতামূলক করা হবে বলে আমরা আশা করছি।”

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরও এসডিজি বাস্তবায়নের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে অর্থায়নের কথাই বললেন।

সেজন্য বৈদেশিক সম্পদ আহরণে আরও তৎপর হওয়ার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের ঋণ ফেরত দেওয়ায় সুনাম রয়েছে। সুতরাং ঋণ পেতে আমাদের সমস্যা হবে না। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোও প্রতিযোগিতামূলকভাবে এসডিজি বাস্তবায়ন করছে।”

আর এই বাস্তবায়নের কাজে জবাবদিহির মাধ্যমে গুণগত মান নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “দেশীয় সম্পদের যোগান দিতে রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি খাত ও সরকারি-বেসরকারি (পিপিপি) উদ্যোগকে ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। এনজিওগুলোকেও এসডিজি বাস্তবায়নে জড়িত করা দরকার।”

সম্পদ আহরণের পাশাপাশি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার গতি বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “এসডিজির সমন্বয়ক হিসেবে আগে যিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, তাকে যতটা দৌড়ঝাঁপ দিয়ে কাজ করতে দেখা গিয়েছিল, এখন সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। এটা কিন্তু রাজনৈতিক গতি।

“এই রকম একটা পজিশন থেকে যত বেশি পর্যবেক্ষণ ও দৌড়ঝাঁপ করবেন ততই ইতিবাচক ফল পাবেন।”