উন্নয়নকাজ তদারকি জোরদারে বাধা আমলাতন্ত্র, বললেন পরিকল্পনামন্ত্রী

আমলাতন্ত্রের অনিবার্যতা তুলে ধরে তার প্রশস্তি গাওয়ার কয়েকদিন না যেতেই পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কণ্ঠে উল্টো সুর; এবার মাঠ পর্যায়ে উন্নয়নকাজের তদারকি কার্যক্রম জোরদারে আমলাতন্ত্রের বাধা পাওয়ার অভিযোগ করলেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 June 2021, 06:23 PM
Updated : 12 June 2021, 06:23 PM

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, মানসম্পন্ন উন্নয়ন কাজ নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর ‘আগ্রহ থাকার পরও’ আমলাদের বাধার কারণে তিনি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) কার্যালয় স্থাপনে উদ্যোগ নিয়ে সফল হতে পারেননি।

শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেট ডায়লগ-২০২১ শীর্ষক বাজেট পরবর্তী আলোচনা সভার প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ অভিযোগ করেন।

সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।

আলোচনায় প্রায় সব বক্তাই গতি বাড়িয়ে মানসম্পন্ন উপায়ে দেশে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন।

সেই পরামশের্র সূত্র ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী দেশে মানসম্পন্ন কাজ করার জন্য কতটা আগ্রহী তার একটা উদাহরণ আমি আপনাদের দেই। সাত আট মাস আগের এক মিটিংয়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বললাম যে, আমি কাজ করতে পারছি না, আমার লোকবলের অভাব। আমি মনে করি, আমাদের (আইএমইডির) জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে অফিস করার ক্ষমতা দেওয়া হোক।

“সাথে সাথে তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, হ্যাঁ আইএমইডিকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত দরকার। ৭৩ সালে যে আইএমইডি গঠন করা হয়েছিল মাত্র কয়েক কোটি টাকার বাজেটের জন্য। সেই আইএমইডিকে দিয়ে এখন ঢাকায় বসে ৬/৭ লাখ কোটি টাকার বাজেট বা আড়াই লাখ কোটি টাকার (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) এডিপি হচ্ছে। এগুলো দেখাশুনা করার সম্ভব নয়।

প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে তাকে কাজ শুরুর অনুমতি দেন জানিয়ে এম এ মান্নান বলেন, “কিন্তু করতে গিয়েই আমি বাধার সম্মুখীন হলাম। বিউরোক্র্যাসি আমাকে বলে যে, না আপনি এটা করতে পারেন না। সরকারের আবার বিভাজন কেমনে করেন। মন্ত্রণালয়গুলো এটা সরবরাহ করবে। হ্যাঁ অধিদপ্তর হলে পারতেন।“

মন্ত্রী বলেন, “ওই মিটিংয়ের সামারির ওপর ওই স্পটেই প্রধানমন্ত্রী লিখে দিলেন তার নির্দেশনা। এখনো সেই সংশ্লিষ্ট চিঠিও আছে।“

সাবেক আমলা মান্নান দুই বছর আগেও বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রকে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

কিন্তু গত মঙ্গলবার একনেক পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্র পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের প্রশস্তি গান তিনি।

সিপিডির আলোচনায় অর্থবছরের শেষের দিকে গিয়ে বাস্তবায়ন বাড়ানোর প্রবণতার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, “আমরা তাদের (বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান) কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, আগে কাজ এগিয়ে থাকলেও বিল পরিশোধ না করার কারণে এসব কাজ বাস্তবায়ন হিসেবে দেখানো হয় না। পরে জুন ফাইনালে বিল পরিশোধ করা হলে বাস্তবায়ন অনেকখানি বেড়ে যায়।

“এটা আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

অন্যদের মধ্যে এফবিসিসিআই সভাপতি জসীম উদ্দিন, এমসিসিআই সভাপতি নিহাদ কবীর, সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাংসদ রুমিন ফারহানা ও  বিজিএমইএ সহসভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম সভায় বক্তব্য দেন।

দারিদ্র্য হারসহ অন্যান্য খাতের প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত না পাওয়া নিয়ে বক্তাদের সমালোচনার জবাবে মন্ত্রী বলেন, “সিপিডি সম্প্রতি দেশের দারিদ্র্যহার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ার যে তথ্য দিয়েছে তাও আমরা সঠিক-বেঠিক কিছু বলতে পারছি না। কারণ আমাদের কাছে হালনাগাদ তথ্য নেই। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে শক্তিশালী করার কাজ করছি।”

ভবিষ্যতে বিবিএস ও বিআইডিএসের মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তোলার ওপর জোর দেন তিনি।

বৈদেশিক সহায়তা বাড়িয়ে আরও বড় বাজেট করার পরামর্শের জবাবে মান্নান বলেন, “না আমি বিদেশি সহায়তা বেশি নেওয়ার পক্ষে নয়। তাদের উচ্চ অগ্রাধিকারে আমরা কমফোর্ট ফিল করি না। কারণ সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু বিষয় থাকে, যেগুলো আমাদের জন্য মঙ্গলজনক নয়।”

সভাপতির বক্তব্যে রেহমান সোবহান বলেন, সরকারের উন্নয়ন কাজের অগ্রগতিতে দেখা যায়, প্রথম দশ মাসে ৪০-৪৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করে পরের দুই মাসে এটাকে অনেক বড় একটি বাস্তবায়ন দেখানো হয়। এতে উন্নয়ন কাজ গুণগত মানের হয় না। বিবিএসসহ সরকারের কোনও দপ্তর থেকেই তথ্য উপাত্ত যথাসময়ে পাওয়া যায় না। এতে সঠিক চিত্র পাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক সমস্যা কোভিড-১৯ মোকাবিলা করার জন্য সরকার বাজেটে কী পদক্ষেপ নিল এটার কোনও সঠিক চিত্র নেই। কীভাবে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে, কোথা থেকে কীভাবে সংগ্রহ করা হবে, কত দিনের মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া শেষ করতে পারবে এসবের কোনও বর্ণনা নেই।

“প্রবাসীদের কষ্টের রেমিট্যান্সে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ মজুদ করলেও যে প্রবাসীরা কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে দেশে ফিরে আসছেন তাদের জন্য কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার কোনও কথা নেই।”

রেহমান সোবহান বলেন, দেশে টাকা তেমন সমস্যা নয়, সমস্যা নীতি নির্ধারণে। শিগগির প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের ব্যবস্থা করে দারিদ্র্যসীমার নীচের মানুষগুলোর জন্য নতুন কর্মসূচি নিতে হবে।

সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে প্রবৃদ্ধির সাথে এগিয়ে নিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই এবং দুর্নীতি দূরীকরণের উপায় সরকারকে বের করতে হবে।

তিনি বলেন, ২০৩০ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার পাশাপাশি মধ্যমেয়াদী পরিকল্পা গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করতে হবে।

দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশে আলাদা বরাদ্দ রেখে তা বাস্তবায়নের পরামর্শ রাখেন তিনি। এসবের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

এফবিসিসিআই সভাপতি জসীম উদ্দিন বলেন, এই বাজেট দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিয়ে ‘মেইড ইন বাংলোদেশের’ কথা বলা হলেও অগ্রীম করের বুঝা চাপানো হয়েছে। অগ্রীম কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩ শতাংশে নামাতে হবে।

তিনি বলেন, একই প্রতিষ্ঠান দিয়ে নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। দুটোই আলাদা প্রতিষ্ঠান হওয়া এখন সময়ের দাবি।

সেবা খাতের যেসব কর্মী মহামারীতে সংকটে পড়েছেন, তাদের জন্য ঋণ বা অনুদানের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন তিনি।

এমসিসিআিই সভাপতি নিহাদ কবীর বলেন, “এই বাজেট থেকে আমরা বিশেষ কিছু আশা করেছিলাম স্বাস্থ্য খাত নিয়ে। টিকা কীভাবে দেওয়া হবে, স্বাস্থ্য খাতের জন্য কী করা হবে। কিন্তু আমরা এর কিছুই পাইনি।”

কর্পোরেট কর কমানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি অগ্রীম কর কমানোর সুপারিশ করেন।

তথ্য প্রযুক্তি খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কারিগরি সহায়তার সুযোগ তৈরির পাশাপাশি পৃথিবীর কম আয়ের দেশগুলোতে বাংলাদেশি সফ্টওয়্যার রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টির উপর জোর দেন তিনি।

তিনি বলেন, “আমরা দেশের এনআইডিসহ অনেক বড় কাজে দেশীয় প্রযুক্তির ব্যবহার করেছি। আরও অনেক বড় বড় প্রকল্প রয়েছে যেগুলোতে সুযোগ রয়েছে।”

এক্ষেত্রে বিদেশিদের কাজ দিয়ে দেশীয় উদ্যোক্তাদের দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করার আহ্বান জানান তিনি।

এই খাতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কর অবকাশ সুবিধা বাড়িয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ঘোষণা করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ সৃষ্টিরও আহ্বান জানান।